দিশারী। একটি বই প্রকাশ উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদী ও অরুণ জেটলি।
অনুমান করছি এই বছরের বাজেট কেবলমাত্র সরকারি আয়ব্যয়ের হিসেব হয়ে থাকবে না, একটি দিকনির্ণায়ক নথি হয়ে উঠবে। নতুন প্রজন্মের আর্থিক সংস্কারের পথনির্দেশিকা তৈরি করার গুরুভার এই বাজেটের ওপর। ভারতকে আর্থিক বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের নতুন কক্ষপথে নিয়ে যেতে হবে। এই বাজেটের কাজটি নিঃসন্দেহে কঠিন। এক দিকে আর্থিক বৃদ্ধির হারকে ফের চাঙ্গা করতে হবে। অন্য দিকে রাজকোষ ঘাটতির হার কমাতে হবে, মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম পরাতে হবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
কৃষিক্ষেত্রে উত্পাদন এবং উত্পাদনশীলতা বাড়ানোর কথা ভাবতেই হবে। অন্য দিকে, পেট্রোলিয়ম পণ্য এবং সারের ক্ষেত্রে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। গণবণ্টন ব্যবস্থার কর্মকুশলতা বাড়াতে হবে। হিমঘরের মতো পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগ যাতে আকৃষ্ট হয়, তারও ব্যবস্থা করতে হবে।
এগ্রিকালচার প্রোডিউস মার্কেট কমিটি অ্যাক্ট-এর মৌলিক শর্তগুলি যাতে পালিত হয়, এবং দ্রুত পচনশীল কৃষিপণ্যগুলি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে আসে, তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিপণ্যের ন্যূনতম ক্রয়মূল্যের এমন ভাবে পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন যাতে কৃষকের স্বার্থও রক্ষিত হয় আবার মূল্যস্ফীতির চাপও না বাড়ে।
বাজেটে সেচের জন্য ব্যয়বরাদ্দ যথেষ্ট বাড়াতে হবে। ‘এল নিনো’-র মতো প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব ঠেকানোর এটাই একমাত্র পথ। একাদশ পঞ্চবার্ষিক যোজনায় ৯৬ লক্ষ হেক্টর জমিকে সেচের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা হয়েছিল কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা আনুমানিক ২৭ লক্ষ হেক্টরে আটকে গিয়েছে। এখনও দেশের অর্ধেক কৃষিজমি সেচের আওতার বাইরে। অবিলম্বে সব জমিতে সেচের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন।
রাজকোষ ঘাটতি
এই বাজেটে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধির কথা ভাবতেই হবে, সরকারের আয়বৃদ্ধির একটি বড় পথ হল বিলগ্নিকরণ। এই পথে এ বছর ৫০,০০০ কোটি টাকা আয় করা যেতে পারে। আবার, মূলধনী খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে। এখন দেশের মোট ব্যয়ের মাত্র ১২ শতাংশ এই খাতে যায়। ভবিষ্যতের কথা ভাবলে এই ব্যয় বাড়াতেই হবে।
সরকারের উচিত, রাজকোষ ঘাটতির হার কমানোর একটি বাস্তবসম্মত রূপরেখা প্রকাশ করা। ভর্তুকি কাটছাঁট করে আরও ৫০,০০০ কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব। পেট্রোলিয়ম ভর্র্তুকির বোঝা বয়ে চলা বন্ধ করতেই হবে। পেট্রোলিয়ম সংস্থাগুলির ধারবাকির হিসেব চুকিয়ে নতুন করে শুরু করা বিধেয়।
গোটা দেশে অন্তত ৬৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা একেবারে ধুঁকছে। জমি, যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য সম্পদ মিলিয়ে বহু কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ সেখানে আটকে আছে। সেগুলি যথাসম্ভব দ্রুত বিক্রি করে দেওয়াই বিধেয়।
পণ্য ও পরিষেবা কর (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) চালু হলে দুর্নীতির পরিমাণ কমবে এবং মানুষের কর দেওয়ার প্রবণতাও বাড়বে। ফলে, রাজস্ব আদায়ও বাড়বে। দেশে একটি সুস্থায়ী এবং মাঝারি হারের কর ব্যবস্থা চালু হলে অনিশ্চয়তা কমবে। ফলে, অর্থনীতির কুশলতা বাড়বে। জিএসটি বহু দিন ধরেই বকেয়া পড়ে আছে। এই বাজেটে জিএসটি চালু করার খবর প্রত্যশা করছি।
বিনিয়োগ
বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা ছাড়ালেই তাকে ‘ক্যাবিনেট কমিটি অব ইনভেস্টমেন্ট’-এর আওতায় এনে দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। নির্মাণ শিল্পের দিকে আরও বেশি করে নজর দেওয়া কমিটির কর্তব্য।
ডিএমআইসি, এনআইএনজেড বা ডিএফসি-র মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া বাঞ্ছনীয়। ন্যূনতম বিকল্প কর এবং অন্যান্য ফাঁদে আটকে ভারতের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি ঠিক ভাবে বিকশিত হতে পারেনি এবং তার ফলেই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাতেও তাদের যুঝতে সমস্যা হয়েছে। এই কর বিলোপ করলে বিনিয়োগ বাড়বে বলেই আশা করি।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিও বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। সংস্থাগুলির হাতে এখন সম্মিলিত ভাবে ৬.৮ লক্ষ কোটি টাকা রয়েছে। বিভিন্ন জটে সরকারি/বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগগুলি আটকে রয়েছে। সেই জট ছাড়াতে হবে। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বেসরকারি মহল থেকে ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ টানা প্রয়োজন। বিমা, প্রতিরক্ষা, ই-বাণিজ্য, খুচরো ব্যবসা, আবাসন নির্মাণের মতো ক্ষেত্রগুলিকে বিদেশি বিনিয়োগের অনুপাতে বৃদ্ধির ছাড়পত্র দেওয়ার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ টানা সম্ভব।
ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা যায়। উত্পাদন হ্রাস করা তার মধ্যে একটি। মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে আয়কর ছাড়ের সীমাকে যুক্ত করাও সম্ভব। এমনিতেও আয়ের প্রথম ৫ লক্ষ টাকা সম্পূর্ণ করমুক্ত হওয়া বিধেয়।
ভারতে গার্হস্থ্য সঞ্চয় এখনও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সোনার মতো ফিজিকাল অ্যাসেট-এ রাখা হয়। তার ফলে সঞ্চয়ের সঙ্গে বিনিয়োগের হারের গরমিল থেকে যায়। পরিকাঠামো বন্ডে বিনিয়োগ করলে এক লক্ষ টাকা কার্যত আয়কর ছাড় দেওয়া বিধেয়। ব্যাঙ্কের সুদের উপর করও মকুব করা উচিত।
নির্মাণশিল্প
কারখানা ও যন্ত্রপাতিতে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত করেছে সরকার। সমস্যা হল, মাঝারি বিনিয়োগকারীরা এই সুবিধা নিতে পারছেন না। অঙ্কটি ৫০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা বিধেয়।
একই রকম ভাবে নতুন কর্মসংস্থান করার জন্যও ছাড় দেওয়া উচিত। বস্ত্রশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বা চর্মশিল্পের মতো শ্রমনিবিড় ক্ষেত্রে অধিকতর মনোযোগ দিতে হবে। নির্মাণক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ টানার জন্য কর ছাড় দেওয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে।
‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ বা ব্যবসা করার সুবিধার নিরিখে ভারত একেবারে পিছনের সারিতে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের সূচকে ভারতের বর্তমান র্যাঙ্ক ১৩৪। তাকে ৫০-এ নিয়ে আসার জন্য বিশেষ ভাবে সচেষ্ট হতে হবে। বিভিন্ন প্রকল্পকে ছাড়পত্র দেওয়া এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কাজ যাতে নিয়ম মেনে হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কর আদায়ের প্রক্রিয়াটিকেও স্বচ্ছ ও কুশলী করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, বিবাদ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াও দ্রুততর হতে হবে। জিএএআর-এর মতো অতীতমুখী কর দেশের ব্যবসার পরিবেশের পক্ষে মারাত্মক। নতুন সরকার এই গোত্রের কর বিষয়ে কী অবস্থান গ্রহণ করে, সে দিকে নজর থাকবে।
ভারতকে এ বার দ্রুত এগোতে হবে। এই বাজেটেই সেই যাত্রার সূচনা হবে কি না, সেটাই দেখার।
সিআইআই-এর মহানির্দেশক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy