শিল্পী: সুমন চৌধুরী।
দেরি হলেও অবশেষে আমরা জানতে পারছি, সূর্যালোক থেকে বিচিত্র রাসায়নিকে ভর্তি ধরিত্রী, এমনকী আমাদের যৌনাচার পর্যন্ত সবই নাকি ক্যানসারের ‘কারণ’। ধূমপান যে ক্যানসারের কারণ, তা তো আগেই জানতে বাধ্য হয়েছি; এখন আবার জানছি ধূমপানের ফলে এক দিকে যেমন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে, অন্য দিকে নাকি খুনের প্রবণতাও বাড়ে। সবচেয়ে বড় বিপদে পড়েছেন মহিলারা। তাঁরা যদি বিয়ে করে সন্তানসন্ততি নিয়ে সংসার করতে চান, তা হলে জরায়ুমুখের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়বে। আর যদি অবিবাহিত থাকতে চান, তা হলে বাড়বে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি। মায়ের ক্যানসার ধরা পড়লে মেয়েকে নাকি খুঁজে দেখতে হবে তাঁর শরীরে ক্যানসারের ‘জিন’ আছে কি না। যদি থাকে, তা হলে একটা-একটা করে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো উত্পাটন করে ফেললেই নাকি ক্যানসার থেকে মুক্তি।
যে-কোনও ক্যানসার নিয়েই মানুষ আতঙ্কে থাকেন। সেটা অস্বাভাবিক নয়, কারণ ক্যানসার এক জৈবিক সংঘটন হলেও শেষ বিচারে সে নির্মম। তবু মহত্প্রাণ জনহিতৈষীরা এই আতঙ্ক দূর করার কাজে নেমে পড়েন। তাঁরা জানেন, আতঙ্ক দূর করার সর্বোত্কৃষ্ট উপায় হল ক্যানসার নিয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলা। কিন্তু কাজটা সহজ না। কারণ, যাবতীয় প্রাকৃতিক সংঘটনের কারণগুলো প্রকৃতির কোলেই লুকিয়ে থাকে বটে, কিন্তু প্রকৃতি আর দেহপ্রকৃতি নিয়ে জটিল আলোচনায় জনমানুষের মনোযোগ আকর্ষণ কঠিন। তার চেয়ে ঢের সহজ ক্যানসার চিকিত্সার উন্নতি আর অগ্রগতির কথা প্রচার করা, আর কী ভাবে এ ব্যাধি থেকে দূরে থাকা যায়, তার উপায়গুলো বাতলে দেওয়া।
তাই জীবনশৈলীর চর্চা, যাকে বলে ‘লাইফস্টাইল’। তাতে লাইফ না-থাকুক, স্টাইলটা তো বিচিত্র। মহিলারা নাকি দিনে একটি করে ডিম খেলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি ২০ শতাংশ কমে যায়। আবার, দিনে এক গ্লাস করে ওয়াইন পান করলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি নাকি বেড়ে যায় ৬ শতাংশ। এ খবর প্রচারিত হয়েছে ২০০৩ সালে, খাস হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একটা ঐকিক নিয়মের অঙ্ক কি করা যায়? যেমন, দিনে পাঁচটি করে ডিম খেলে অথবা সুরাপান কমিয়ে এক-ষষ্ঠাংশ করে দিলে কি স্তন ক্যানসার থেকে রেহাই পাওয়া যায়? আপেল-চা-কফি-স্যাকারিন-মাংস চর্বি আর নানা রসনাবিলাস ত্যাগ করে তৃণভোজী হয়ে গেলে কি ক্যানসারকে বুড়ো আঙুল দেখানো যাবে? তৃণভোজী পশুদের কি ক্যানসার হয় না?
মানুষ বিস্ফারিতনয়নে শোনেন, শীর্ণতা-পৃথুলতা, ধনাঢ্যতা-ধনহীনতা, শুভ্র ত্বক-কৃষ্ণ ত্বক, মাংসাশী-নিরামিষাশী, বুভুক্ষা-ভোজনবিলাসিতা, সব কিছুতেই নাকি ক্যানসারের ঝুঁকি। বোঝাই যাচ্ছে না, এই সর্বব্যাপী ঝুঁকির মধ্যে মানুষজন কী ভাবে, কোন ঝুঁকি, কতটা, কত কাল এড়িয়ে থাকবেন? ‘হার্ট অ্যাটাক’-এর পিছনে অন্তত ২৪০টি ঝুঁকির সন্ধান পাওয়া গেছে। ক্যানসারের পিছনে ঝুঁকির সংখ্যা তো অগণ্য। সেই হিসেব দেখলে মনে হয়, বেঁচে থাকাটাই স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হল বয়েস। শতকরা ৬০ ভাগ ক্যানসার ষাট বছর বয়সের পরেই হয়, তাই বার্ধক্য নিষিদ্ধ হোক।
আধুনিক দুনিয়ায়, জীবনশৈলীর মধ্যে ক্যানসারের ‘কারণ’ অনুসন্ধান করতে গিয়ে নীতিকথার পাঠ দেওয়া শুরু হয়েছিল হিটলারের জার্মানিতে, তার পর আমেরিকায়। সেই ইতিহাস ঘাঁটলে বোঝা যায়, নীতিকথার পিছনে বিজ্ঞাপনের যতটা সম্মতি ছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল রাজনীতির চাপ আর জনপ্রিয়তার হাতছানি। এমনিতে মানুষের নীতিবোধ যেমনই হোক, কাণ্ডজ্ঞান প্রখর। তাই বোধ হয় এত কালের তুমুল, ঘর্মস্রাবী চেষ্টার পরেও তাঁরা যথাযথ সচেতন হচ্ছেন না। এর পর ক্ষুব্ধ, বিস্রস্ত জনসেবকরা হয়তো বলবেন, ‘অভয় দিচ্ছি শুনছ না যে, ধরব নাকি...’।
নইলে আপাতসুস্থ শরীরের মধ্যে চিরুনি তল্লাশি কেন, যাকে বলে ‘স্ক্রিনিং’? স্ক্রিনিং তো ক্যানসার ‘প্রতিরোধ’ করে না, সে বড়জোর ক্যানসারের শৈশব আবিষ্কার করে। সেই শৈশবও আদৌ ক্যানসার কি না, তা নিয়ে পণ্ডিতমহলে, এমনকী ডাক্তারির সাম্প্রতিকতম পাঠ্যপুস্তকেও গভীর সংশয়। অনেকে বলেন, সে যা-ই হোক, তাকে শৈশবেই মেরে ফেলা ভাল, নইলে সে গোকুলে বাড়ে। যে-কোনও ব্যাধিই শৈশবে ধরে ফেলা ভাল। কিন্তু তাকে তো ব্যাধি হতে হবে। তাই শৈশবে ক্যানসার নিধনের উপদেশ শুনলে মনে হয়, আমরা কি কংসরাজের বংশধর হয়ে গেলাম! তবুও জনমানুষকে ক্রমান্বয়ে ‘ক্যানসার স্ক্রিনিং’-এর দুর্ভর বাসনায় প্রলুব্ধ করার পরিত্রাহী চেষ্টা। তাতে যে ক্যানসারের প্রকোপ কমে যায়, ক্যানসার রোগী বেশিকাল জীবিত থাকেন অথবা এমনকী ক্যানসার-জনিত মৃত্যুহার কমে, এমন প্রমাণ কিন্তু নেই।
তাই সবটা আর শুধু কৌতুক না। এক উদ্ভট, কৃত্রিম, নির্বোধ স্বাস্থ্যপরায়ণতা জনজীবনের পবিত্রতা রক্ষার দায় নিয়ে ‘স্বাস্থ্য-সন্ত্রাস’ রচনা করছে। তৈরি হচ্ছে ভ্রু কোঁচকানো ‘স্বাস্থ্য পুলিশ’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে পারদর্শী-খচিত, তা বটে। কিন্তু এমন সব পারদর্শীদের কথা শুনেই তো পেরুতে জল বিশুদ্ধিকরণের জন্য ক্লোরিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়, কেননা, ক্লোরিন নাকি ক্যানসারের জন্মদাতা, আর তার ফলে ৮ লক্ষ মানুষ মারা যায়। বাসনাবিলাস থেকে অনাবশ্যক, অনাবিল উদ্বেগ রচনা করা বিজ্ঞানের কাজ না। বিজ্ঞান মানুষকে অকারণ, ক্রমাগত হাসপাতালমুখী হওয়ার আহাম্মক আহ্বান জানায় না। বরং পারদর্শীরা যে অজ্ঞ হতে পারেন, এই বিশ্বাসটার নামই বিজ্ঞান।
ঘটনা হল, প্রতি বছর গড়ে সমগ্র জনসংখ্যার মাত্র ০.৮ শতাংশ ভাগ মানুষ ক্যানসারগ্রস্ত হিসেবে নির্ণীত হন। দেশে জনসংখ্যা বাড়ে, বৃদ্ধের সংখ্যাও বাড়ে, কেননা একই সঙ্গে বাড়ে আমাদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল। তাতে সংখ্যার হিসেবে ক্যানসারও বাড়ে, এরই সঙ্গে বাড়ে জনসংখ্যার ঘনত্ব। তাতে লোক জানাজানি হয় আগের তুলনায় অনেক বেশি। আর এই সব কিছুর সঙ্গে বাড়ে ক্যানসারের অতি-নির্ণয়। কিন্তু এর কোনও কিছুই ক্যানসারের ‘মহামারী’ত্ব প্রমাণ করে না। এবং শেষ পর্যন্ত ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা বাড়ে না, বাড়ে আতঙ্ক, আর তার পরিণামে দুর্ভোগ। সেই নির্মাণকর্ম অকারণে হয় না। আসলে ব্যাধির অতি-নির্ণয়, অতি-পরীক্ষা, অতি-চিকিত্সা আর তা নিয়ে অতি-কলরব, এ সবই কৃত্রিম। শুধু বাণিজ্যলক্ষ্মীই থাকে অকৃত্রিম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy