চিনে একটি কোম্পানি ছিল, হয়তো এখনও আছে। বেশ কয়েক বছর আগে তার কথা লিখেছিলেন এক মার্কিন সাংবাদিক। কোম্পানিটির কাজ ক্ষমা চাওয়া। অন্যের হয়ে ক্ষমা চাওয়া। ওঁদের স্লোগানই হল: আমরা আপনার হয়ে ‘সরি’ বলব। ব্যাপারটা কী? আসলে ও দেশের মানুষ চট করে ক্ষমা চাইতে পারেন না। সাহেবসুবোরা যেমন কথায় কথায় ‘হে, সরি অ্যাবাউট দ্যাট’ বলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সব দুঃখ-টুঃখ ঝেড়ে ফেলে নিজের কাজে চলে যেতে পারেন, চিনে অনেকেরই এখনও সেটা রপ্ত হয়নি। এ ব্যাপারে হিন্দি-চিনি ভাই ভাই বলা যায়, আমাদের এ-দিকেও অনেকেই এখনও সাহেবি কেতায় তেমন অভ্যস্ত হননি, বাসে-ট্রামে কারও পা মাড়িয়ে দিয়ে ‘সরি’ বললে নিস্তার মেলে না, উল্টে মুখঝামটা খেতে হয়, ‘ওই এক বুলি শিখিয়ে দিয়ে গেছে ইংরেজরা, বললেই অমনি সাত খুন মাপ হয়ে গেল!’
তবে ভাইয়ে ভাইয়ে সব কিছু তো আর মেলে না, একটা ব্যাপারে চিনের লোকেরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ওস্তাদ। ওঁরা ব্যবসাটা ফাটাফাটি বোঝেন। ক্ষমা চাইতে লজ্জা, ‘সরি’ বলতে অস্বস্তি এই স্বভাবটাকেই দিব্যি পুঁজি বানিয়ে কেউ কেউ লক্ষ্মীর সাধনায় নেমে পড়েছেন। যেমন ওই কোম্পানিটি। ওঁরা ক্রেতাদের নানা রকম প্যাকেজ বিক্রি করেন। ক্ষমা চাওয়ার প্যাকেজ। ধরা যাক, দুই বন্ধুর বেধড়ক ঝগড়া হয়েছে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তার পর এক দিন, যেমন হয়, এক বন্ধুর মনটা হু-হু করে উঠল। হয়তো অন্যেরও। কিন্তু বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না, বরফও গলে না। এ-সব বিপদে তৃতীয় বন্ধুর একটা ভূমিকা থাকে, কিন্তু সমাজ পালটেছে, ভাল বন্ধুর সংখ্যা কমেছে, তেমন বৃন্দা দূতী মেলা কঠিন। এখানেই মুশকিল আসান কোম্পানির প্রবেশ। ওঁদের সাফ কথা: ক্ষমা চাইতে চান, কিন্তু লজ্জা পাচ্ছেন? চলে আসুন আমাদের কাছে, বলুন আপনার কেস হিস্ট্রি, জানিয়ে দিন কতটা জোর দিয়ে সরি বলতে চান। আমরা আপনার চাহিদা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা করে দেব। আমাদের লোক চিঠি লিখবে, ফোন করবে বা সশরীর চলে যাবে আপনার অভীষ্ট মানুষটির কাছে, যথাযথ ভাষায় ও ভঙ্গিতে ক্ষমা চেয়ে আসবে তাঁর কাছে। শুকনো সরি-র সঙ্গে যদি কিছু উপহার দিতে চান, তার ব্যবস্থাও আমরাই করে দেব। দাম প্যাকেজ অনুসারে।
এবং এ কোনও শখের কারবার নয়। ওই কোম্পানিতে যাঁরা কাজ করেন, মানে ক্ষমা চেয়ে বেড়ান, তাঁরা রীতিমত শিক্ষিত, সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের মধ্যে আছেন শিক্ষক, আইনজীবী, সমাজকর্মী। তাঁরা স্বভাবে শান্ত, মগজে বিচক্ষণ, চমৎকার কথা বলেন। তার ওপর তাঁদের বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়। ক্ষমা চাইবার ট্রেনিং, যাতে তাঁরা আরও দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন। একটা ব্যাপার খেয়াল করা ভাল। এই কাজে দক্ষতার মূল্যায়ন বেশ সহজ। ক্ষমা চাইবার ফলে মনোমালিন্য মিটল কি না, দূরত্ব কতটা কমল, সেটাই বলে দেবে, পেশাদার ক্ষমাপ্রার্থী তাঁর পেশায় কতটা সফল।
মার্কিন সাংবাদিকটির লেখার সূত্র ধরে চিনের এই কোম্পানিটির কথা জানিয়েছেন মাইকেল স্যান্ডেল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রবীণ অধ্যাপক ন্যায়, নীতি, নৈতিকতা নিয়ে অসামান্য সমস্ত লেখা লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। ‘জাস্টিস’ নামে তাঁর বক্তৃতামালা আক্ষরিক অর্থেই বিশ্ববিশ্রুত। বছর দুই আগে প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘হোয়াট মানি কান্ট বাই’ নামক একটি স্বল্পকায় বইয়ে তিনি আলোচনা করেছেন, আমাদের জীবনের সমস্ত অন্ধিসন্ধিতে বাজার কী ভাবে অনুপ্রবেশ করেছে, এমন অনেক কিছুর দখল নিয়েছে যা আমরা আগে বাজারের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারতাম না। ক্ষমা চাওয়ার চিনাবাজার নিয়ে আলোচনা এসেছে সেই সূত্রেই। খেয়াল করা দরকার, এ বাজার পশ্চিম দুনিয়ায় হয়নি। হবে না, কারণ সেখানে মানুষ অনায়াসে এবং অবলীলাক্রমে ক্ষমা চায়। চিনের মতো দেশে ক্ষমা চাওয়া মানে মুখের কথা নয়, সত্যিই মাথা হেঁট করা। ‘সরি’ বলাটাকে লোকে সিরিয়াসলি নেয় বলেই সহজে বলতে পারে না, পারে না বলেই এই নিয়ে দিব্যি একটা ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এটা আপাতদৃষ্টিতে একটা প্যারাডক্স বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে এখানেই বাজারের ক্ষমতা। যা কিছু আমাদের কাছে মূল্যবান, বাজার তাকেই আত্মসাৎ করে, সেই মূল্যকে মুনাফায় রূপান্তরিত করে ফেলে সে পেশাদার প্রতিনিধিকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ানোই হোক, হিরের আংটি কিনে ভালবাসা জানানোই হোক। তাতে শেষ পর্যন্ত মানবিক অনুভূতিগুলোর মূল্য কমে যাবে কি না, মূল্য কমে গেলে বাজারটাই উধাও হবে কি না, সে-সব ভবিষ্যতের ব্যাপার। ভবিষ্যতে আমরা সবাই মৃত।
আমাদের দেশেও ক্ষমা চাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। বিশেষ করে রাজনীতির মাতব্বররা চট করে ‘সরি’ বলতে রাজি নন। অথচ প্রতিপক্ষ কেবলই তাঁদের পুরনো পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে বলে, তাই নিয়ে শোরগোল তোলে। তাঁরাও ক্ষমা চাইবেন না, শত্রুরাও ছাড়বে না। তাই ভাবছিলাম, একটা কোম্পানি তৈরি করলে হয় না? গুজরাত হোক, দিল্লি হোক, যখন যেখানে দরকার, যার কাছে দরকার, ক্ষমা চেয়ে আসবে। খরচটা দিয়ে দিলেই হল, ব্যস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy