Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২

টাকা নয়, আসল চিন্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে

কাশ্মীরে অর্ধ শতাব্দীতে এমন প্লাবন হয়নি। রাজ্য সরকার বন্যার সম্ভাবনা সম্পর্কে ঠিক মতো পূর্বাভাসও দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই সংকটের মোকাবিলায় তারা কতটা কী করতে পারবে, সে বিষয়ে গভীর সংশয় আছে। সুজাত বুখারিরাজবাগ শ্রীনগরের বর্ধিষ্ণু এলাকা। ফহ্মিদা শাহের বাড়ি ওই পাড়াতেই। তিনি একটি পলিটেকনিক কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, এখন অবসরপ্রাপ্ত। শনিবার সন্ধে থেকে জল বাড়তে লাগল, ফহ্মিদা দরকারি জিনিসপত্র যতটা পারেন সঙ্গে নিয়ে ওপরতলায় উঠে গেলেন।

পঞ্চাশ বছরে প্রথম। প্লাবিত শ্রীনগরের রাজপথে। ৭ সেপ্টেম্বর। ছবি: এপি

পঞ্চাশ বছরে প্রথম। প্লাবিত শ্রীনগরের রাজপথে। ৭ সেপ্টেম্বর। ছবি: এপি

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

রাজবাগ শ্রীনগরের বর্ধিষ্ণু এলাকা। ফহ্মিদা শাহের বাড়ি ওই পাড়াতেই। তিনি একটি পলিটেকনিক কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, এখন অবসরপ্রাপ্ত। শনিবার সন্ধে থেকে জল বাড়তে লাগল, ফহ্মিদা দরকারি জিনিসপত্র যতটা পারেন সঙ্গে নিয়ে ওপরতলায় উঠে গেলেন। কিন্তু ঝিলমের জল যে ভাবে উত্তরোত্তর ঘরের মধ্যে উঁচুতে উঠতে লাগল, খুব একটা বেশি ভাবার অবস্থা রইল না ফহ্মিদার। নিজেকে, স্বামীকে আর বাড়ির অন্য দু-এক জনকে কোনও ভাবে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন তিনি। কোনও ক্রমে ছাদের ঘরে পৌঁছতে পারলেন। সেখানে কোনও বিদ্যুৎসংযোগ নেই। তবুও, অবশেষে, বাকি দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পেলেন ফহ্মিদা। “হাতের কাছে লাল রং-এর যেমন যেটুকু কাপড় পেলাম, সেটাই উড়িয়ে উদ্ধারকারীদের নজর পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তবে মনে হচ্ছিল না বাঁচার কোনও সম্ভাবনা আছে, যা খাদ্য-পানীয় সঙ্গে এনেছিলাম, সে-ও প্রায় শেষ হতে বসেছে ততক্ষণে।”

সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলাম যখন, ফহ্মিদা আমাকে সেই প্রবল আতঙ্কের একটা বিবরণ দিলেন। “সোমবার প্রথম একটা চপার-এর দেখা পাওয়া গেল। আমাকে তুলে নেওয়া হল। কিন্তু বাড়ির কোনও পুরুষকে নেওয়া হল না, সেটাই নাকি দস্তুর। আজও জানি না আমার স্বামী কোথায়। ওরা বলছে, পরের দিন নাকি ওঁদের তোলা হয়েছিল।” ফহ্মিদার মুখে হতাশা আর অসহায়তার এক গভীর ছায়া।

একই রকম কিংবা আরও ভয়ানক সব ঘটনা অন্যান্য জলমগ্ন পরিবারেও। “স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ডুবে যাচ্ছি, প্লিজ কেউ কিছু করুন,” আজাদ বস্তি নাতিপোরা থেকে রবিবার সকালে একটা ফোন আমার কাছে। আমি একাই প্রায় ২০০টা আর্ত ফোনকল পেয়েছি চেনা-পরিচিতদের কাছ থেকে, সকলেই উদ্ধারের জন্য কান্নাকাটি করছে, কিন্তু প্রশাসন থেকে কোনও সাহায্যের দেখা নেই। দিল্লি থেকে নৌকো আসছে শোনা গেল, কিন্তু সোমবার বিকেলের আগে তাদের দেখা মিলল না। এ দিকে তার মধ্যে চতুর্দিকে বিভীষিকা। এয়ারফোর্স কাজে নেমেছে ঠিকই, কিন্তু স্থানীয় মানুষের মুখে শুনছি তারা “কেবল রাজবাগ ও অন্যত্র গেস্ট হাউস থেকে ‘গেস্ট’-দের তুলছে, আর সমস্ত বাইরের লোকদের আগে তুলছে,” সেটাই নাকি তাদের ‘প্রায়রিটি’। প্রায় ছয় লক্ষ ডুবন্ত মানুষের মধ্যে মাত্র সত্তর বা আশি হাজার জনকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া গিয়েছে, বাকিদের সম্পর্কে কোনও খবর প্রশাসনের কাছে নেই! শ্রীনগরে রাজবাগ অত্যন্ত সমৃদ্ধ অঞ্চল, সেখানে বাড়ি কেনার জন্য উঁচুতলার মান্যগণ্যদের হুড়োহুড়ি, পরের পর রাস্তায় সুন্দর অভিজাত বাড়ির লাইন। ভাবাই যায় না রাজবাগ বা জওহরনগরে এই পরিমাণ ধ্বংসলীলা ঘটতে পারে। কিন্তু ২ তারিখ থেকে কাশ্মীরের ইতিহাসে অভূতপূর্ব বৃষ্টি-বন্যার এই তাণ্ডবে এখন সেখানকার বহু বাসিন্দা গৃহচ্যুত, অন্যান্য জায়গায় তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন। দক্ষিণ কাশ্মীরের অবস্থাই বেশি খারাপ, কেননা সে দিকেই ঝিলম অর্থাৎ বিতস্তা নদীর উৎস। বাকি কাশ্মীরের থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে দক্ষিণ। শ্রীনগর তো বিধ্বস্ত বটেই, প্রবল জলের চাপে গোটা অঞ্চলেরই স্থানীয় প্রশাসন ভেঙে পড়ার জোগাড়।

এই লেখার সময় পর্যন্ত দক্ষিণ থেকে মধ্য কাশ্মীরের আশি কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বিপুল এলাকার বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। ঝিলমের উৎস দক্ষিণ কাশ্মীরে, ওই এলাকার খুবই ক্ষতি হয়েছে, অবশিষ্ট রাজ্য থেকে তা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অথচ প্রথমটায় সবাই শ্রীনগরের অবস্থা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে দক্ষিণ কাশ্মীরের কথা যেন ভুলেই গিয়েছিল।

সেনাবাহিনী ও এয়ারফোর্স-এর পাশাপাশি সাধারণ স্বেচ্ছাসেবকরা নেমে পড়েছেন উদ্ধারকাজে। বেশ ভাল কাজ করছেন তাঁরা। যত পরিমাণে সম্ভব, মানুষের প্রাণ বাঁচানো, এবং তাদের খাওয়াদাওয়া, নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। জম্মুর অবস্থাও একই রকম। সবচেয়ে বড় মর্মান্তিক ঘটনাটি সেখানেই ঘটেছে। রাজৌরি জেলায় ৬০ সদস্যের বরাট জলের তোড়ে একেবারে ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন। বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ। এক জম্মুতেই নিহতের সংখ্যা ১১০ ছাড়িয়েছে। তবে কাশ্মীরে যে ভাবে লক্ষ মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েছে, তেমনটা কিন্তু জম্মুতে ঘটেনি।

কাশ্মীরে এমন বন্যা ৫০ বছরের মধ্যে দেখা যায়নি। জলস্ফীতির হারও যেন অনেকটাই কমে এসেছিল। তবে ইঞ্জিনিয়াররা সতর্ক করছিলেন যে কয়েক বছরের মধ্যেই ভয়াবহ বন্যা ঘটতে পারে। এ বছর তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এমন বন্যাকাণ্ড কাশ্মীরে আগে ঘটেছে ১৯০২, ১৯৫৫, ১৯৫৭ আর ১৯৫৯ সালে। ১৯০২ সালে গোটা শ্রীনগর দীর্ঘ দিন জলমগ্ন ছিল, কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, হিসেবও করা যায়নি। অন্য তিন বারের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম ছিল, কেননা নানা রকম বন্যা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছিল। তবে নিম্ন বিতস্তা অববাহিকা সংলগ্ন এলাকাগুলির উপর বন্যার জের টের পাওয়া গিয়েছিল ভালই। পরবর্তী দশকগুলিতে শহরায়ণের চাপ, কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই নির্মাণকার্যের বাড়াবাড়ি এবং এই ব্যাপক নির্মাণযজ্ঞে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে সরকারের অনন্ত গড়িমসি, এ সবের ফল কী দাঁড়িয়েছে, এ বারের বন্যার ভয়াবহতাই সেটা বলে দিচ্ছে।

বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে জলমগ্ন এলাকাগুলি থেকে জল বার করাটাই একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯০২ সালের মতো এ বারেও স্বাভাবিক জলমাত্রায় ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। গোটা উপত্যকার জলনিকাশি ব্যবস্থা ভর করে আছে বিতস্তা নদীর উপর। এটাই এখানকার প্রধান নদী। উৎস থেকে প্রায় ২৪১ কিলোমিটার অববাহিকা পার হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে বিতস্তা। ডান দিকে ১১টি, এবং বাঁ দিকে ৬টি তুলনায় অনুন্নত নিকাশি ব্যবস্থা এর সঙ্গে মিশেছে। অর্থাৎ অতিরিক্ত অববাহিকা বলে ধরা যায় আরও ১১,৩৫৩ বর্গ কিলোমিটারকে। শুরুতে এ নদী বেশ শান্ত প্রকৃতির, কিন্তু যখন সে নিয়ন্ত্রণরেখা পার হয়, ততক্ষণে তার শক্তি বিপুল। এ বার সেই শক্তির তাণ্ডব দেখা গেল।

মানুষ এখন প্রাণপণ বাঁচার চেষ্টা করছেন। জল নামবে, অবস্থা আবার স্বাভাবিক হবে, বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত পরিবারের মানুষজন আবার ঘর গোছাবেন, সেই আশায় বুক বেঁধে আছেন তাঁরা। আশঙ্কা, প্লাবনের পায়ে পায়ে আসবে মহামারি, তার মোকাবিলা করতে হবে। যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা সামলে উঠতে নাগরিকদের সাহায্য করা, তাঁদের যথেষ্ট ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা, এ-সবই এখন সরকারের প্রধান দায়। বিরাট দায়।

দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক হাজার কোটি টাকার ত্রাণ বরাদ্দ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু বন্যা-উত্তর পরিস্থিতির মোকাবিলার আয়োজন কী ভাবে করা হবে, সেটা টাকার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান রাজ্য সরকার বন্যার সম্ভাবনা সম্পর্কে ঠিক মতো পূর্বাভাসও দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই সংকটের মোকাবিলায় তারা কতটা কী করতে পারবে, সে বিষয়ে গভীর সংশয় আছে। দেখা যাক।

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial sujato bukhari
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy