মাসখানেক হল। তারিখটা ছিল ৭ ডিসেম্বর, ২০১৪। ১৬ ডিসেম্বর তারিখটা ছুঁতে প্রায় এক সপ্তাহ বাকি। মধ্যরাত্রি। সাতাশ বছরের এক তরুণীকে ধর্ষণের পর তিনি যখন সাহায্যের জন্য চিত্কার করতে যাচ্ছিলেন, তখনই ট্যাক্সিচালক বলল, ‘চিত্কার করলেই পেটে রড ঢুকিয়ে দেব। ১৬ ডিসেম্বরটা মনে আছে তো?’
পরের ঘটনাও গত মাসেরই। সাঁতরাগাছির মসজিদতলায় দম্পতি ভাড়া থাকেন এক বাড়িতে। এক দিন পুরুষটি বাড়ি না থাকার সময় বাড়ির মালিক এসে ভদ্রলোকের স্ত্রীকে ধর্ষণ করে গেলেন। ভোগ্যপণ্য দেখলে সকলেরই তো তাকে উপভোগের অধিকার বর্তায়! এর পর তাঁদের বাড়ি ছেড়ে চলে বলার হুমকি। এমনকী প্রাণে মেরে ফেলার শাসানিও। সংবাদমাধ্যম মারফত জেনেছি, বধূটির শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হল।
নির্ভয়া কাণ্ডের দু’বছর পরের ডিসেম্বরেও চলেছে নারী-নিগ্রহের মিছিল। বর্ধমানের উখড়ায়, সতেরো-আঠারো বছর বয়সি কয়েক জন তরুণ এক নবম শ্রেণির ছাত্রীর বাড়িতে চড়াও হয়। মেয়েটি ঘরে একা ছিল। সময়মতো তার বাবা ফিরে এসে বাধা দেওয়ায় ছেলেগুলি তাঁকে মারতে শুরু করে, ইতিমধ্যে লজ্জায়, অপমানে, সিলিং ফ্যান থেকে গলায় ওড়না জড়িয়ে ঝুলে পড়ে মেয়েটি। তার মাংস নিয়ে কাড়াকাড়ি করা মানুষের হাত থেকে বাঁচতে শেষ করে দেয় প্রাণ।
নারী নিগ্রহের কোনও অন্ত নেই। প্রাণের আরাম আর আত্মার শান্তি মেলার কথা যেখানে, সেই বিশ্বভারতীতেও আবাসিক ছাত্রীদের ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, এক নয় একাধিক বার। ভয় দেখানো হয়েছে যে, বাইরে ঘটনা প্রকাশ করলেই মোবাইলে যে জোর করে আপত্তিকর ভিডিয়ো ও ছবি তুলে নেওয়া হয়েছিল মেয়েদের, তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়া হবে প্রকাশ্য আলোয়। অর্থাত্, সব ক্ষেত্রেই লজ্জা ধর্ষকের নয়, ধর্ষিতার। নববর্ষের, নব আনন্দে একের পর এক ধর্ষণের রোমহর্ষক ঘটনা ঘটে চলে।
‘নব আনন্দে’ বলছি এই কারণে, যে, আমাদের আনন্দ-প্রবাহে কোনও বাদ না সেধেই, লজ্জা যোগ না করেই, ইতিমধ্যে আমাদের নতুন প্রজন্ম, বিজ্ঞাপনে ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’ দেখে দেখে শুদ্ধ-হওয়া চোখে, সবে অতিথিকে যখন নারায়ণ ভাবতে শিখেছে, তা, নারায়ণ তো দেবী নন, দেব, এই ভাবনার বশবর্তী হয়ে, হ্যাপি নিউ ইয়ারে ধর্ষণের হাত বাড়িয়ে দিল বিদেশিনির দিকে। দিনের পর দিন তাঁকে আটকে রেখে ভোগ করল তারা। বছর বদলায়, জীবন বদলায় না। এই তো, খবর জানাচ্ছে, ধূপগুড়িতে দশম শ্রেণির একটি মেয়ের ধর্ষিতা ও মৃত, শরীর মিলেছে বাড়ির পাশের সিমখেতে। কাগজের পাতা উল্টে আরও জানলাম, প্রাচীন কালে যেমন রাজা ও দস্যুরা কোনও অঞ্চলের দখল নেওয়ার পর, সোনা, রুপো, গৃহপালিত পশু ও নারীও সংগ্রহ করতেন, এ কালের তোলাবাজরা আজকাল ‘তোলা’ তুলতে এসে নারীকেও সম্পদজ্ঞানে ধর্ষণ করে যাচ্ছে।
নির্ভয়ার বাবা আজও হতাশকণ্ঠে বলেন, ‘২০১২-র ১৬ ডিসেম্বরের পরও কিছু পাল্টাল না? কেন, এত দিনেও সেই দোষীদের চরম দণ্ড মিলল না?’ মনে হয়, আমাদের সকলেরই এই উত্তরহীন আক্ষেপ।
বাঙালি বড়ই বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধি খাটিয়ে যে-কোনও পরিবর্তনের সূচনায় কিংবা অন্তে সে ঢেলে দেয় প্রতিবাদের জ্বলন্ত লাভাস্রোত। জ্বালানির দাম বাড়লে বন্ধ করে দেওয়া হয় পরিবহণ ব্যবস্থা, এক বা একাধিক দিনের জন্য, প্রতিবাদের সূচনা হিসেবে। রাজনৈতিক অবিচারের বিরুদ্ধে দলে দলে পথে নেমে পড়েন কোনও-না-কোনও পার্টির মতানুসারীরা। দুর্নীতিকারীর বিরুদ্ধে সুবিচার চেয়ে, কিংবা আদৌ দুর্নীতি করেননি কেউ, রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হয়েছেন মাত্র, এই দুই ভাবনারই বশবর্তী মানুষ আলাদা করে পথে নামে। দুর্গতদের জন্য সাহায্য চেয়ে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধতা বেয়ে পথে নামেন লেখক-শিল্পী-কলাকুশলীর দল। এটা যে শুভবুদ্ধির প্রকাশ, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই কোনও। এবং, হ্যঁা, শুরুতে যে সব প্রতিবেদন, যন্ত্রণাবিদ্ধ ঘটনার উল্লেখ করছিলাম, সেই অন্তহীন যৌননিগ্রহে সমবেদনা জানান বটে সুশীল সমাজ। কিন্তু তীব্র প্রতিবাদের ঝঞ্ঝা, জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়া অশনি তো নেমে আসে না কখনও! এই একটি ক্ষেত্রে বড় মৃদু হয়ে যাই আমরা। কয়েকটি নারী সংগঠনের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই থেমে যায় সেই বিক্ষোভের দৌড়। ধর্নামঞ্চ তৈরি হয়ে ওঠে না কোনও। কিংবা অনশনে বসেননি তো কেউ, যখন বীভত্স ভাবে ধর্ষণের শিকার হয় একটি চার বছরের শিশুকন্যাও। আলো-বাতাস কিংবা প্রতিদিনের ভাত-ডালের মতো মন-সওয়া হয়ে যাচ্ছে পারিবারিক ও পরিবারের বাইরে ঘটে-যাওয়া নারী-নিগ্রহগুলি।
আমরা বোধহয় আজও ধরেই নিই যে, মেয়েরা যে জন্ম থেকেই বলিপ্রদত্ত। ‘এলালিং বেলাটিং সই লো, রাজমশাই একটি বালিকা চাইল’, চাইলেই তাকে দিয়ে দিতে হবে, ব্যস। আমরা ব্যাপারটা খেলার ছলেই নিয়ে থাকি। তাই, আজও ইতিহাসসমৃদ্ধ রাজস্থানে ‘কুলধারা’ নামের একটি ধূ ধূ গ্রামকে হেরিটেজ করে রাখা আছে, যেখানে, রাজামশাই কোনও গ্রামবাসিনীকে কামনা করেছিলেন, ফলে গোটা গ্রামবাসী ঘরসংসার ফেলে রেখে বহু দূরে পালিয়ে যায়।
অভিজাত অথবা মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েদের ‘অনার কিলিং’ তাই চলছে চলবে। বধূকে পুড়িয়ে মারলে পাড়ায়-পাড়ায় তাই কোনও অরন্ধন দিবস পালন করা হয় না; অবরুদ্ধ হয় না পথঘাট, যখন রাত্রির ধর্ষণের পর নর্দমায় ভোরের শিশির-ভেজা-রক্ত মেখে পড়ে থাকে যে-কোনও বয়সি নারী। যুগযুগান্ত ধরে মেয়েরা বহন করেছে অপমান, অবজ্ঞা। মাতৃরূপে, সংসারে লক্ষ্মীপ্রতিমা রূপে, শ্রদ্ধার নামান্তরে, নিগ্রহে বহে গেছে সমাজের শিরায়-শিরায়।
আজ যখন হোককলরব পার হয়ে হোকচুম্বন-এর দিকে ঝুঁকি, আমাদের লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের খাতায় তৈরি হয়ে ওঠে এক নিরুপায় কবিতা: চুম্বনের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে ওই প্রেমহীন শরীর!/ ধর্ষণের দিকে বহে যাচ্ছে ওই প্রাণহীন শরীর! /সম্পর্কে জুড়িয়ে যাচ্ছে ওই মনহীন শরীর!/ তবে কি পেলব কিছু কম পড়ল বসন্তে এবার—/ ‘কাটা মুণ্ড, থার্ড ডিগ্রি পুড়ে-যাওয়া-স্তন আর কোন মুখে গান গাইবে কোকিলপাড়ায়!’/ এ-কথা বলতেই, খুব বিশ্রীভাবে হেসে উঠল যুবতীর লাশ,/ সনাক্তকরণ হয়নি, তাই,/ আমাদের সকলেরই বন্ধু হবে, এই অভিলাষ/ হাতে ধরে উড়ে যাচ্ছে চুম্বনের হাটে।/ খুব ভয়ে-ভয়ে কাটে,/ নখগুলি বেঁকে গেছে, বিষ হয়ে গেছে—/ যাক! কাঞ্জিভরম শাড়ি সাঁই-সাঁই শব্দে ফুলে আছে। ঠোঁট মেলে, চোখ মেলে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy