ভারতের সর্ববৃহত্ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব সম্পর্কে অশোক মিত্র (‘আমাদের বামপন্থীরা...’, ১০-৬) মন্তব্য করেছেন, ‘লেনিন যুগে সোভিয়েত পার্টিতে সর্বস্তরের মতামতকে সমান গুরুত্ব দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে শোনা হত। আর হালের পশ্চিমবঙ্গে সেই পবিত্র নীতি নিছক বাঙালি জমিদারিতে পরিণত হয়েছে।’ এ কি কেবল বাঙালি কমিউনিস্ট পার্টির পরিণতি? ইতিহাস কিন্তু আমাদের এই কথাই জানায় যে, কমিউনিস্ট পার্টি যতক্ষণ ক্ষমতার বিরুদ্ধে, শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে, ততক্ষণ তার ভূমিকা লড়াকু, মানবিক, কিন্তু যখনই সে পার্টি ক্ষমতায় বসে এবং কিছুকাল ক্ষমতায় থাকে, সাধারণ স্বাধীনচেতা মানুষ তার জমিদারি দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের অভিজ্ঞতা একই কথা বলে। সত্তর-আশির দশকে পোল্যান্ডের কথা যদি ভাবি? শ্রমিকরাই সে দেশে শাসক কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল। গড়ে উঠেছিল তাঁদের সংহতি, আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের সেই প্রতিস্পর্ধী দল বা সংগঠনের নাম ছিল ‘সলিডারিটি’। শাসক পার্টি নতজানু হয়েছিল তার সামনে।
আসলে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতার ওই মন্তব্যগুলি পড়তে পড়তে আর এই মুহূর্তে চার পাশে ঘটে চলা রাজনীতির ঘটনাবলি এবং তার পিছনে সেই পার্টির অতিদীর্ঘ শাসনের অবদানের কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়েছিল গত বছরের শেষে কেন্দ্রীয় সরকারের চলচ্চিত্র উত্সব ‘ইফি’তে দেখা একটি ছবির কথা। তার পর থেকে ভাবনাটা মাথার মধ্যে পাক খেয়েই চলেছে। ছবির নাম ‘ওয়ালেসা: ম্যান অব হোপ’। (উপরে তার একটি দৃশ্য।) সলিডারিটি নেতা লেখ্ ওয়ালেসাকে নিয়ে ছবিটি করেছেন তাঁর দেশেরই প্রসিদ্ধ চিত্র পরিচালক আন্দ্রে ওয়াইদা। নব্বই ছুঁই-ছুঁই চলচ্চিত্রকার বয়সে সতেরো বছরের ছোট এক রাজনীতিককে নিয়ে ছবি করছেন, বিরল ঘটনা! কেন করলেন তিনি এ ছবি? গত বছর অগস্টে এক সাক্ষাত্কারে ওয়াইদা বলেছেন, ‘বুড়ো হয়েছি। ছবি-করিয়ে হিসেবেও বৃদ্ধ। হয়তো এটাই হবে আমার জীবনের শেষ ছবি। ছবিটা তৈরি করতে না পারলে আর এ-জীবনের অংশীদার হতেও চাইতাম না। এ-ছবি তৈরি করা ছিল আমার কর্তব্য।’
কর্তব্য শব্দটার ওপর ইচ্ছে করেই জোর দিয়েছেন ওয়াইদা, কারণ কিছু দিন ধরেই তাঁর মনে হচ্ছিল, ওয়ালেসাকে মানুষ ভুলে যেতে পারে। পঁচিশ বছর আগে যখন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসা শুরু করল, সেই থেকে স্বাধীনতার সঙ্গে বসবাস করতে করতে জনসাধারণ ভুলতে বসেছেন সেই মানুষগুলোর কথা, যাঁরা শুরু করেছিলেন স্বাধীনতার লড়াই। ওয়াইদা মনে করেন, ওয়ালেসা সম্পর্কে অনেক তর্ক ও অভিযোগ আছে বটে, কিন্তু সে-সব অতিক্রম করে তাঁর ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্বীকার করা দরকার, কারণ তিনি দেশের, বৃহত্তর অর্থে পূর্ব ইউরোপের, স্বাধীনতার উদ্গাতা। ওয়াইদা বলেছেন, ‘তিনি আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন।’ তাই তাঁকে ভুলে যাওয়া অন্যায় হবে।
ওয়াইদার আশঙ্কা যে অহেতুক নয়, সেটা টের পাচ্ছিলাম গোয়ার উত্সবে তাঁর ছবিটা দেখতে দেখতেই। প্রবীণ এবং বামপন্থী বলে পরিচিত কয়েক জন সাংবাদিক রীতিমত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন ছবিটা দেখে। তাঁদের বক্তব্য, ‘এমন এক জন পরিচালক কেন ওয়ালেসাকে ‘ন্যাশনাল হিরো’ বানিয়ে তুলেছেন? এ আসলে পশ্চিম দুনিয়ার বাজার অর্থনীতির কাছে মাথা নোয়ানো’ ইত্যাদি।
অর্থনীতির অনুষঙ্গেই ওয়াইদা ছবিটা শুরু করেছেন, ষাট-সত্তরের দশকে কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত পোল্যান্ডে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট, মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ধর্মঘটে শামিল হচ্ছেন বন্দর-শ্রমিকরা, ওয়ালেসার সর্বক্ষণের সঙ্গী তিরিশ জন শ্রমিক মারা গেলেন কমিউনিস্ট সরকারের পুলিশের হাতে, প্রতিবাদ প্রতিরোধ বেড়েই চলল, বেআইনি জেনেও ধর্মঘট থেকে বিরত হলেন না শ্রমিকরা। কত বার গ্রেফতার হলেন ওয়ালেসা, কত বার চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হল তাঁকে, আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হল। ১৯৮০’তে বাধ্য হয়ে তাঁদের আন্দোলনকে স্বীকৃতি জানিয়েও পরের বছরেই আবার মার্শাল ল’ জারি করলেন পার্টির শাসকেরা। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই দেশের মানুষের কাছে স্বাধীনতার ‘আইকন’ হয়ে উঠলেন ওয়ালেসা। সেটাই তাঁর ছবিতে ধরতে চেয়েছেন ওয়াইদা।
আর সেই সূত্রেই প্রকাশ করেছেন শাসক কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে তাঁর তীব্র সমালোচনা। দেখিয়েছেন, হিটলারের দখলদারি থেকে স্তালিনের দখলদারিতে পৌঁছে পোল্যান্ড সত্যিকারের কোনও স্বাধীনতা পায়নি। এবং স্তালিনের পরেও মস্কোর অঙ্গুলিহেলনে তার ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের ইতিহাস প্রবাহিত থেকেছে। পূর্ব ইউরোপ জুড়েই এক ছবি, দেশভেদে রকমফের ছিল, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। এই ধারাবাহিক নিগড়ের মধ্যে থাকতে থাকতে পূর্ব ইউরোপের প্রতিভাবান পরিচালকরা চাইছিলেন আত্মসংস্কৃতির ভাষা আবিষ্কার করতে, যা তাঁদের বাঁধা পথের খাঁচা থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার অভিজ্ঞান খুঁজতে সাহায্য করবে।
আজও এ দেশে অনেকে স্বপ্ন দেখেন, কমিউনিস্ট পার্টির হাতেই মানুষের ক্রমমুক্তি ঘটবে। তাঁরা খেয়াল করেন না বা করতে চান না, মানবমুক্তির সঙ্কল্পে যে পার্টির জন্ম, ক্ষমতাসীন হলেই তার হাতে বার বার মানবাধিকারের প্রাথমিক শর্তগুলো লঙ্ঘিত হয়েছে, গোটা বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস জুড়ে তার বহু সাক্ষ্য, বহু প্রমাণ। এবং খেয়াল করেন না এটাও যে, কমিউনিস্ট পার্টির চেহারায় ও চরিত্রেই নিহিত থাকে স্বাধীনতাকে দমন করার স্ব-ভাব। ব্যক্তির স্বাধীনতা নয়, প্রশ্নহীন আনুগত্যই তার ধর্ম, তার বিধান। সোভিয়েত-উত্তর পূর্ব ইউরোপে সমস্যা অনেক, অন্যায়ও বিস্তর, কিন্তু সেখানকার মানুষ অন্তত সেই নিশ্ছিদ্র আনুগত্যের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। মাসদুয়েক আগে এক সাক্ষাত্কারে ওয়ালেসা মন্তব্য করেছেন, ‘আজ আমরা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারি যে আমরা গণতান্ত্রিক পোল্যান্ডে বসবাস করছি।’
কেউ যদি এই নতুন শতকে কমিউনিস্ট পার্টিকে নতুন ভাবে গড়ে তোলার কথা ভাবেন, তবে প্রথম কাজ তার চরিত্র সংশোধন। পার্টি নেতৃত্বের প্রতি অশোক মিত্রের সুতীব্র সম্ভাষণ ছিল, ‘বাইরের মানুষ দেখছে আপনারা অনেক নীতি-নিয়ম মানছেন না, তাই আপনারা পার্টির ভিতরে কী আলোচনা করছেন সে কথা তাঁরা জানতে চান। এবং সেটা যতক্ষণ আপনারা তাঁদের জানতে না দেবেন, আপনাদের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস কমবে না।’ এই জরুরি কথাগুলো যে পার্টির নেতারা শুনছেন বা শুনতে চাইছেন, তার কোনও লক্ষণ অন্তত আজও চোখে পড়ে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy