‘শাস্তি চাই’। গণধর্ষণে অভিযুক্ত কিশোর অপরাধীর ফাঁসির দাবিতে। দিল্লি, অগস্ট ২০১৩।
জুভেনাইল জাস্টিস (কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন অব চিলড্রেন) বিল (২০১৪) কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ছাড়পত্র পেয়ে লোকসভায় পেশ হওয়ার পর স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। ২০০০ সালে কার্যকর হওয়া চলতি আইনটি সংশোধনের ক্ষেত্রে নতুন সরকার তার প্রথম অধিবেশনেই যে উদ্যোগ দেখিয়েছে, তা তাত্পর্যপূর্ণ তো বটেই, কিঞ্চিত্ বিস্ময়করও। অত্যন্ত জটিল এই বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এত তাড়াহুড়ো কেন করতে গেল, কেন বিলটি সংশোধিত আকারে পেশ করার আগে বিষয়টি নিয়ে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের পরামর্শ নেওয়া হল না, কেন এ বিষয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের দিকে এক বারও ফিরে তাকানো হল না, সে সব প্রশ্ন তাই উঠছেই। এই প্রশ্নগুলিকে সামনে রেখে আমরা বরং একটু তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে পারি, কেন, কোন প্রেক্ষিতে শিশু অপরাধীদের ‘শাস্তি দেওয়া’র এই নতুন হাতিয়ারটির অবতারণা, তা কত দূর যুক্তিনির্ভর, এবং তার পিছনের ভাবনাভূমিটিই বা কী।
আগের জুভেনাইল জাস্টিস বিলটির প্রত্যাহার ও নয়া বিল পেশের পিছনে সবচেয়ে বড় যে যুক্তিটি খাড়া করার চেষ্টা চলছে, সেটি হল জনসাধারণের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা ও অপরাধীদের শাস্তিবিধান। সামাজিক সুরক্ষা যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তা নিয়ে যেমন কোনও তর্ক থাকতে পারে না, তেমনই অপরাধ করলে শিশুদেরও যে শাস্তি প্রাপ্য, তা নিয়েও মতদ্বৈধ নেই। সমাজের আর পাঁচজন দায়িত্বশীল নাগরিকের মতো আমরাও যে-কোনও ধরনের যৌন অপরাধের নিন্দা করি, এবং এ কথাও নির্দ্বিধায় স্বীকার করি যে, এ ধরনের ঘৃণ্য, জঘন্য অপরাধ সর্ব অর্থেই নিন্দনীয়। কিন্তু, যখন দেখি যে নাবালকদের দ্বারা সংঘটিত যৌন অপরাধের শাস্তিবিধানের নাম করে সুকৌশলে নারীদের অধিকারকে শিশু অধিকারের বিরুদ্ধে কোথাও একটা লড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তখন তা একই রকম উদ্বেগজনক ঠেকে। যেন সেটাই সমাজকে ব্যাধিমুক্ত রাখার, সমাজের মহিলাদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার এক এবং একমাত্র বিকল্প পথ! ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য, সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী’। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই তড়িঘড়ি দাওয়াইয়ে আসল অসুখটা সারবে তো? পৌঁছনো যাবে তো সমস্যার গোড়ায়? যদি তা না যায়, তা হলে যে দুরপনেয় ‘চিকিত্সা-সংকট’ ঘটে যাবে, তার দায়ভার নেব তো আমরা?
শিশু অপরাধ ও তার প্রতিবিধান-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক গবেষণাগুলি কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলছে! সারা বিশ্ব জুড়ে এ বিষয়ে গত কয়েক দশকে যত সমীক্ষা হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিরই রিপোর্ট থেকে পরিষ্কার, যে সব কিশোর অপরাধী প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের জন্য নির্ধারিত সাজা-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়, তাদের ক্ষেত্রে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ফের অপরাধ ঘটানোর প্রবণতা অনেক গুণ বেশি। সে সব সমীক্ষার ফলাফল সামনে আসার পর অনেক দেশেই কিশোর অপরাধীদের প্রথাগত শাস্তিবিধানের নিয়মকানুন পাল্টে ১৮ বছর বয়সকে শৈশবের সীমা হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আচমকা বেড়ে যাওয়া কিশোর-অপরাধ কমাতে সে দেশের আইনে কিশোর অপরাধীদের বয়ঃসীমা কমিয়ে আনা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রেও যুক্তি ছিল যে, আইন হতে হবে বিলক্ষণ ‘কড়া’, যাতে কমবয়স্ক অপরাধীরা ভয়ের চোটে অপরাধ করার আগে দু’বার ভাবে। কিন্তু বাস্তবে তা যে হয়নি, তা সে দেশের গত দু’দশকের কিশোর অপরাধ সংক্রান্ত নথি থেকেই পরিষ্কার। ফলে এখন ‘কেঁচে গণ্ডূষ’ করতে হচ্ছে, ফিরে যেতে হচ্ছে কিশোর অপরাধীদের জন্য পৃথক আইন রচনায়।
শিশুদের মানসিক বিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ কথা অনস্বীকার্য যে, পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতার প্রভাব (যাকে আমরা ব্যাপক অর্থে সামাজিক প্রভাব বলি), তাদের জীবনে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ঢের বেশি। অনেক ক্ষেত্রে তারা পরিণাম না বুঝে কোনও পরিস্থিতির মধ্যে গিয়ে পড়ে, অনেক ক্ষেত্রে তারা তুলনায় বয়োজ্যেষ্ঠদের দ্বারা চালিত হয় বিষয়টির গুরুত্ব না বুঝে, বা আচরণের সম্ভাব্য ফলাফল ও পরিণতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হয়েই। সে দিক থেকে দেখলে তাদের মানসিক বিকাশ ও দায়িত্ব নিতে শেখার পিছনে, তাদের চেয়ে বরং সমাজের দায়দায়িত্বই থাকে বেশি। সেখানে যদি কোনও ফাঁক রয়ে যায়, ভবিষ্যতে তার ফল হতে পারে মারাত্মক।
এবং ঠিক এইখান থেকেই আমরা সরাসরি পৌঁছে যেতে পারি ‘১৮ বনাম ১৬’ বিতর্কের একেবারে কেন্দ্রিক আলোচ্যটিতে। এ প্রসঙ্গে তথ্য হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৮৯-এ ইউনাইটেড নেশনস-এর কনভেনশন অব চাইল্ড রাইটস-এর নির্দেশিকায় খুব স্পষ্ট ভাবে শৈশবের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে ১৮ বছর, এবং সেই নির্দেশনামায় সই করে তার অংশভাক হয়েছে ভারতও। কিন্তু সেই নির্দেশিকায় ১৮ বছরকে কেন শৈশবের সীমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেটাও একটু বুঝে নেওয়া আবশ্যক। এ কথা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত যে, এই বয়সেই একটি শিশুর শারীরিক, মানসিক, ধারণাগত ও আবেগসঞ্জাত (ফিজিক্যাল, মেন্টাল, কগনিটিভ অ্যান্ড ইমোশনাল) বিকাশ মোটামুটি একটি পর্যায়ে পৌঁছয়। এটাই পূর্ণতাপ্রাপ্তি কি না, তা নিয়ে অবশ্য মতান্তর আছে। তবে শিশুমনস্তাত্ত্বিক থেকে সমাজতাত্ত্বিক পর্যন্ত প্রায় সকলেই দ্বিধাহীন ভাবে একমত যে, ১৮-র আগে এই পরিণতি আসা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। এ কারণেই কিশোর অপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া প্রাপ্তবয়স্কদের বিচারের থেকে আলাদা হওয়া জরুরি, এমনকী সংশোধনাগারেও তাদের রাখা উচিত প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের থেকে আলাদা করে। বাস্তবেও সেটাই হয়, এবং এর পিছনেও যুক্তিটা সেই একই।
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, আজকাল নাকি ছেলেমেয়েরা কম বয়সেই ‘অত্যন্ত পরিণত’ হয়ে যায়, ফলে কৈশোরের বয়স নির্ধারণে ১৮-এর সীমা ইদানীং আর নাকি তেমন গ্রহণযোগ্য নয়। খুব ভাল কথা। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই বিষয়ে কোনও গবেষণালব্ধ তথ্যভিত্তি (ডেটাবেস) আমাদের হাতে রয়েছে কি? নিদেনপক্ষে কোনও সমীক্ষা-রিপোর্ট?
এ প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলা যায়। কখনও কখনও শোনা যায়, কোনও ক্লাস এইটের ছাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাঠ্যক্রমের দুরূহ অঙ্ক কষে ফেলছে অবলীলায়। কাগজে এই সব শিশু-প্রতিভার কথা ফলাও করে ছাপাও হয়। কিন্তু এই ব্যতিক্রমী শিশুটির পারঙ্গমতায় প্রাণিত হয়ে ক্লাস এইটের অঙ্কের প্রশ্নপত্রের মান উচ্চ মাধ্যমিকের স্তরে তুলে নিয়ে যাওয়া খুব যুক্তিযুক্ত কি? না কি বাস্তবোচিত? এ ক্ষেত্রে একটি ছাত্রের কম বয়সে পরিণত হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে যদি সাধারণীকৃত করা না হয়, তা হলে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার নিরিখে গুটিকয়েক শিশু অপরাধীকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য গোটা জুভেনাইল জাস্টিস আইনটিকেই পালটে ফেলার প্রশ্ন উঠে কেন?
পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা, ক্রাই (চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy