Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

মেয়ে কোলে আধার লাইনে

নদিয়ার জেলাশাসক বিভু গোয়েল বলছেন, ‘‘এনআরসি-র সঙ্গে আধার কার্ডের কোনও সম্পর্ক নেই। অযথা আতঙ্কিত হওয়ারও প্রয়োজন নেই।’’

মেয়েকে নিয়ে আধার কার্ডের লাইনে অর্চনা গুরুং। নিজস্ব চিত্র

মেয়েকে নিয়ে আধার কার্ডের লাইনে অর্চনা গুরুং। নিজস্ব চিত্র

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৪:৪৬
Share: Save:

মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে বছর সাতেকের টগরী। মেরুদণ্ডের সমস্যার কারণে সে দাঁড়াতে পারে না। কথাও বলতে পারে না। তাকে কোলে নিয়েই সকাল থেকে ঠায় লাইনে দাঁড়িয়ে অর্চনা গুরুং। মেয়ের আধার কার্ড করাবেন।

কৃষ্ণনগর হেড পোস্ট অফিসের সামনে তখনও অন্তত শ’দুয়েক মানুষ দাঁড়িয়ে। মেয়েকে ঝাঁকুনি দিয়ে ভাল করে কোলে নিতে নিতে অর্চনা বলেন, “এত বড় মেয়েকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা যায়? কিন্তু যেমন করে হোক, মেয়ের আধার কার্ডটা করিয়ে নিতে হবে।”

অর্চনার স্বামী মোহন গুরুং আজন্ম নদিয়ার কৃষ্ণনগরের পাশের দোগাছির বাসিন্দা। বহু বছর আগে তাঁর বাবা নিশিরাম গুরুং শিলিগুড়ি থেকে চলে এসেছিলেন। অর্চনা কৃষ্ণনগরের রেড গেটের মেয়ে। স্বামী-স্ত্রীর আধার কার্ড আছে। আছে তাঁদের বছর দশেকের ছেলে সুরজেরও। প্রতিবন্ধী মেয়ের কার্ড করার কথা এত দিন মাথাতেই আসেনি। কিন্তু এখন তাঁরা মরিয়া।

বুধবার দুপুরে লাইনে দাঁড়িয়েও ফর্ম না পেয়ে ফিরতে হয়েছিল তাঁদের। বৃহস্পতিবার সকালে এসে ফের লাইন দিয়েছেন। অর্চনা বলেন, “অনেকেই বলছে, আধার কার্ড না থাকলে নাকি দেশে থাকতে দেবে না। এনআরসি তালিকা থেকে নাম বাদ যাবে।” এক বার ঘুমন্ত মেয়ের মাথায়-মুখে হাত বুলিয়ে নিয়ে অর্চনা ফের বলেন, “ওকে যদি আমাদের থেকে আলাদা করে দেয়, বাঁচবে কী করে?’’

সারা বছর ধরে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এবং পোস্ট অফিসে যে নতুন আধার কার্ড করা ও তথ্য সংশোধনের কাজ চলে, দিনে বড় জোর পাঁচ-দশ জন আসেন, সপ্তাহ দুই ধরে হত্যে দিচ্ছেন হাজারে-হাজারে মানুষ। নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে গেলে ঠিক কী-কী কাগজপত্র হাতের কাছে রাখা দরকার, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই তাঁদের। আধার থেকে ডিজিটাল রেশন কার্ড, যা কিছু পাওয়া যেতে পারে তা জোগাড় করতে মরিয়া বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা নদিয়া জেলার মানুষ। মুসলিমরা তো বটেই, অসমের তালিকা দেখে হিন্দু বাঙালি থেকে গোর্খা, ভয়ে কাঁটা সকলেই।

দুপুর ১২টা থেকে মা-বাবার সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত বছর ছয়েকের আয়ুশ মণ্ডল। পা তার টাটিয়ে উঠেছে। অগত্যা ছেলেকে কোলেই তুলে নেন চাপড়ার চড়ুইটিপির চুমকি মণ্ডল। তাঁর স্বামী অভিজিৎ দিল্লিতে একটি কারখানায় কাজ করেন, থাকেনও তাঁরা সেখানেই। দিল্লিতেই স্বামী-স্ত্রী আধার কার্ড করিয়েছিলেন। চুমকি বলেন, “বাড়ি এসে শুনি, আধার কার্ড না থাকলে দেশে থাকতে না-ও দিতে পারে। ছেলে ছেড়ে থাকব কী করে?”

লাইনের মাঝখানে গোমড়া মুখে মা নারবানু বিবির আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে বছর বারোর জাহির শেখ। তার আধার কার্ড আছে, কিন্তু ‘শেখ’-এর জায়গায় লেখা ‘মণ্ডল’। আলাদা লোক ভেবে যদি দেশ থেকে বার করে দেয়? তাই ঝিটকেপোতা থেকে এসেছে লাইন দিতে। নারবানু বলেন, “কোথাকার জল কোথায় গড়াবে, জানি না। আধার কার্ডটা তো অন্তত ঠিক থাকুক!”

নদিয়ার জেলাশাসক বিভু গোয়েল বলছেন, ‘‘এনআরসি-র সঙ্গে আধার কার্ডের কোনও সম্পর্ক নেই। অযথা আতঙ্কিত হওয়ারও প্রয়োজন নেই।’’

কর্তার কথা দিশেহারা মানুষের কানে পৌঁছচ্ছে কি?

অন্য বিষয়গুলি:

Krishnanagar NRC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy