ডান্সিং উইথ দ্য রিভার: পিপল অ্যান্ড লাইফ অন দ্য চর্স অব সাউথ এশিয়া, কুন্তলা লাহিড়ী-দত্ত, গোপা সামন্ত। ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, মূল্য অনুল্লেখিত
আলোচ্য বইয়ের দুই লেখকের ভিত্তিটা ভূগোলের, গতিপথটা সমাজ সন্ধানের। সন্ধানটা সহজ ছিল না: এক দিকে ভূগোলের নিজস্ব তত্ত্বকাঠামো, অন্য দিকে বিদ্যা চর্চার বিভিন্ন শাখার সঙ্গে তার আন্তঃযোগাযোগ সংক্রান্ত জটিল জ্ঞানতাত্ত্বিক দিকগুলির সমন্বয়সাধন করে তোলা শুধু বুদ্ধির উৎকর্ষ নয়, সঙ্গে সঙ্গে বিপুল দৈহিক পরিশ্রম দাবি করে। তত্ত্ব আলোচনাকে একটা পাঠ্য রূপ দিতে লেখক এবং তাঁদের সহযোগীদের আক্ষরিক অর্থেই দীর্ঘ পথ হাঁটতে হয়েছে, জল-বালি-কাদা ভেঙে। এই শ্রমের ফসলে নির্মিত বইটি হাতে নিয়ে থামা যায় না। পড়ে চলতে হয়।
পদ্ধতিগত ভাবে লেখকরা মানুষের দৈনন্দিন জীবনচর্যার অনুধাবনের মধ্য দিয়ে জ্ঞানানুশীলনের পথে এগিয়েছেন, এবং বেছে নিয়েছেন এমন এক লোকসম্প্রদায়ের জীবন, যাদের কথা সাধারণত শোনা যায় না। অশ্রুতির একটা কারণ যদি হয় ভৌগোলিক— এঁরা দামোদরের ভিতরে জেগে ওঠা কিছু চরের বাসিন্দা, অন্য কারণটা সমাজ-রাজনৈতিক— ‘চরুয়া’ নামের নবগঠিত এই লোকসম্প্রদায় ‘পরিবেশের একটা একটা অশাসনীয় এবং সীমানাশূন্য পরিস্থিতি’র বাসিন্দা বলেই প্রান্তিকদের মধ্যেও প্রান্তিক, যাঁদের আদিভূমি রাজনৈতিক ইতিহাসের তলায় চাপা পড়ে গেছে, আর স্বভূমি জেগেছে নদীর ভিতর, যার ভিতটা এখনও নরম কাদার উপর, অতএব, উপরিকাঠামো টলমলে।
অধ্যয়নের জন্য লেখকরা বেছে নিয়েছিলেন দামোদর নদের ভিতর বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলার সীমানাবর্তী ১২টি চর— ৪৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে যাদের অবস্থান। এদের মধ্যে কয়েকটি নদের উত্তর কিনারা ঘেঁষে জেগে ওঠা, স্থানীয় ভাবে এগুলি ‘মানা’ নামে পরিচিত (যেমন কসবা মানা, ভাসাপুর মানা); অন্যগুলি দ্বীপবিশেষ, স্থানীয় বুলিতে ‘চর মানা’ (যেমন মাঝের চর মানা, কালীমোহনপুর চর মানা)। এদের মধ্যে কোনওটিতে যেতে হয় অনেকটা নদী পেরিয়ে। আবার কোনওটা, যেমন চর গৈতানপুর, একেবারে বর্ধমান শহরের কাছে, যদিও সেখানে পৌঁছতে অনেকটা বালি ভাঙতে হয়।
শিশুরা করে খেলা। দামোদরের চরে ছবিটি তুলেছেন অজয় কোনার।
অধ্যয়নটির সমৃদ্ধি এর পুঙ্খানুপুঙ্খতা: এক দশকেরও বেশি সময় ধরে লেখকরা এই চরগুলির সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়েছেন। ভূগোল-বিশারদের জ্ঞানে তাঁরা যেমন অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু এবং স্থানিকতাকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তেমনই আবার নৃতাত্ত্বিকের ধৈর্যে দিনের পর দিন ‘চরুয়া’দের সঙ্গে আলাপ জমিয়েছেন; তাঁদের দিনচর্যা, খাদ্যাভ্যাস, উৎপাদনশীলতা, সামাজিক আচার-ব্যবহার এবং অর্থনৈতিক স্বভাব ও গতিশীলতাকে তন্নিষ্ঠ ভাবে বোঝার চেষ্টা করেছেন। সামাজিক-অর্থনৈতিক অনুসন্ধানের মান্য সমীক্ষাপদ্ধতিও বেশ ভাল ভাবে কাজে লাগিয়েছেন, যদিও সংখ্যাগাণিতিক উপস্থাপনগুলিতে কিছুটা অস্বাচ্ছন্দ্য চোখে পড়ে। যেমন বই-এর শেষে একটি সারণিতে সমীক্ষাকৃত ‘চরুয়া’ পরিবারগুলির একটি সংক্ষিপ্তসার দেওয়া আছে। কিন্তু এতে ব্যবহৃত সংখ্যাগুলি পূর্ণ মানে দেওয়ার ফলে এর কার্যকারিতা অনেকটা কমে গেছে। যেমন সাক্ষরের একটা সংখ্যা দেওয়া আছে, যা থেকে বোঝা যায় না জনসংখ্যার কতটা অংশ সাক্ষর— একটা ছোট পাটিগণিত করে বুঝতে হল যে এটা ৫১ শতাংশ, অর্থাৎ রাজ্যের মোট সাক্ষরতার হার (২০০১-এ ৬৮%, ২০১১-তে ৭৬%) থেকে এটা অনেকটাই কম।
কিন্তু এ ত্রুটি নগণ্য। বস্তুত, গোটা বইটিতে চরবাসী এই লোকসম্প্রদায়ের নির্মাণ, বাইরে থেকে এসে তাঁদের এখানে বসবাস, রাজনীতি ও ভূগোলের সঙ্গে দর কষাকষি করে টিকে থাকা, রাষ্ট্রের মধ্যে এক নৈরাষ্ট্রিক অস্তিত্ব বজায় রাখা, আবার রাষ্ট্রহীনতা থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলা, প্রান্তিক যে-কোনও জনগোষ্ঠীর যে দৈনন্দিন হিসেবনিকেশ তার এক অতি প্রামাণিক উপাখ্যান তৈরি হয়ে উঠেছে। সম্প্রদায়ের ভিতর সম্প্রদায়ের কাহিনি— বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষের সঙ্গে বিহারি অভিবাসী এবং স্থানীয় কিছু মানুষের সহবাসিন্দা হয়ে ওঠার ক্রমে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, পারস্পরিক আদানপ্রদান, বিশ্বাস ও ঘৃণা, আবার একই সম্প্রদায়ের ভিতরে নারী-পুরুষ সম্পর্ক, জাতি-ভিন্নতা থেকে গড়ে ওঠা সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি নানা বিষয়ের নিবিড় আলোচনা পড়তে পড়তে কেউ ধন্দে পড়ে যেতে পারেন, এটা বিদ্যা চর্চার বই না উপন্যাস।
বাস্তবিক, গভীর বিদ্যা চর্চাকে এত সুপাঠ্য করে তোলা দুরূহ। কিন্তু এই দুরূহতাকে লেখকরা ভেঙেছেন, জ্ঞান চর্চার কাঠামোটাকে না ভেঙেই। ব্যষ্টিকে নিয়ে এত যে গভীর অনুসন্ধান, সেটা একটা সমষ্টিগত উদ্দেশ্যেই— ‘কোনও ব্যতিক্রমপন্থী ফাঁদে’ তাঁরা পড়তে চাননি। সমষ্টিকে জানতে, বুঝতে এবং তাকে পুনর্নির্মাণ করতে গেলে ব্যষ্টিকে সঠিক এবং নিখুঁত ভাবে না জানলে চলে না। আবার, ব্যষ্টির অনুসন্ধানে দৃষ্টির সমষ্টিগত ব্যাপকতাটিকেও বাদ দেওয়া যায় না। লেখকরা এই সমন্বয়টাই করতে পেরেছেন।
এটা করতে গিয়ে তাঁরা যেমন ডাঙা ও জলের সম্পর্ক— চর ও মূলবাসীর সম্পর্ককে ঐতিহাসিক ক্রমে ধরার চেষ্টা করেছেন দক্ষিণ এশীয় ভূভাগে ভিন্ন ভিন্ন চর নির্মাণের আলোচনার মধ্য দিয়ে, তেমনই আবার এই চরগুলির ভূগোল নির্মাণে প্রকৃতি ও রাজনীতির ভিন্ন ভিন্ন প্রভাবও অত্যন্ত সুন্দর ভাবে তুলে এনেছেন। সেই ক্রমে আমরা জানতে পারি ব্রহ্মপুত্রের মাজুলি নামক মহকুমা-চরের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চরগুলির গড়ে ওঠার আখ্যান। এই ব্যাপক প্রেক্ষাপটটিকে পাঠকের সামনে বিছিয়ে দিয়ে লেখকরা তাকে নিয়ে যান দামোদরের চরগুলিতে, যা বস্তুত রাজনীতির ফসল— গত শ’খানেক বছরে, দামোদরের উপর বাঁধের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে যাদের জন্ম এবং নদীর ভিতর এক ‘ডাঙাকেন্দ্রিক অর্থনীতির উদ্ভব।’ এ অর্থনীতিতে ডাঙার প্রভাব যেমন বিরাট, তেমনই আবার এর আছে এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য— দেশের মূলভূমির রাষ্ট্রকেন্দ্রিক অর্থনীতি যেখানে সম্পূর্ণ পরিস্ফুট নয়; সুরক্ষা নয়, ঝুঁকিই এ অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
আটটি পরিচ্ছেদে গড়ে ওঠা এই বই সমাজ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অন্তত দু’ভাবে কাজে লাগছে: এক, এই প্রান্তিক লোকসম্প্রদায় সম্পর্কে জানা এবং রাষ্ট্র ও সমাজের নীতি-নির্ধারণে সেই জ্ঞানকে প্রয়োগসাধ্য করে তোলা; এবং দুই, সমাজ অনুসন্ধানের পদ্ধতিগত ক্ষেত্রটিকে অধিকতর সমৃদ্ধ করে তোলা। জ্ঞানানুশীলনের পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ পদ্ধতির এত চমৎকার মিশ্রণ যে-কোনও অনুসন্ধিৎসু গবেষককে আলোকিত এবং অনুপ্রাণিত করবে। তার চেয়েও বড় কথা, যে কোনও সাধারণ পাঠক এই বইটি কেবল পড়ার আনন্দেই পড়তে পারবেন। পড়ার আনন্দই যেখানে বিস্মৃতির চর, সেখানে অন্য কোনও কারণে না হোক, শুধু আনন্দটার জন্যই এই বই ফুল মার্কস পায়।
প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy