Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

ঠাঁইহারার যন্ত্রণা ধরে রেখেছে সাহিত্য

দেবযানী সেনগুপ্ত-র বইটি পড়তে পড়তে হাতড়ে বার করলাম কবিতাটি। বইটি যেন ধাক্কা দিয়েই মনে করিয়ে দিল। এখানেই হয়তো বইটির সবচেয়ে বড় জোর।

জনস্রোত: পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুর ঢল

জনস্রোত: পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুর ঢল

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৭ ০১:১৩
Share: Save:

দ্য পার্টিশন অব বেঙ্গল/ ফ্র্যাজাইল বর্ডার্স অ্যান্ড নিউ আইডেন্টিটিজ

লেখক: দেবযানী সেনগুপ্ত

মূল্য অনুল্লেখিত

কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস

এস দেখে যাও কুটি কুটি সংসার/ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ছড়ানো বে-আব্রু সংসারে/ স্বামী নেই, গেল কোথায় তলিয়ে/ ভেসে এসে আজ ঠেকেছে কোথায় ও-যে/ ছেঁড়া কানিটুকু কোমরজড়ানো আদুরি, ঘরের বউ/ আমার বাংলা।— কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার প্রথম স্তবক। কবিতার নাম, ‘এস দেখে যাও’। খুব পরিচিত কবিতা নয়। স্বাধীনতা ও দেশভাগের হাজারো সংকলনে একে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। ১৯৪৭-উত্তর বাংলায় স্টেশন-প্ল্যাটফর্ম-শহর জুড়ে কুটি কুটি সংসারের এমন নাড়া-দেওয়া শব্দে শব্দে আঁকা ছবি— সাহিত্যভাণ্ডারের এক কোণায় অনাদরে পড়ে থাকে।

দেবযানী সেনগুপ্ত-র বইটি পড়তে পড়তে হাতড়ে বার করলাম কবিতাটি। বইটি যেন ধাক্কা দিয়েই মনে করিয়ে দিল। এখানেই হয়তো বইটির সবচেয়ে বড় জোর। দেশভাগ নামক ঘটনাটির চর্চা করতে হলেই সাধারণত ইতিহাসের অঙ্গনে বিচরণ করা হয়ে থাকে, সাহিত্যে নয়; সাহিত্যে যদি-বা সন্ধান চলে, পঞ্জাবই গুরুত্ব পায়, বাংলা নয়; বাংলার সাহিত্য নিয়ে যদি-বা আলোচনা চলে, বিস্মৃতির উপরই জোর পড়ে বেশি, স্মৃতিতে নয়। এই সব ক’টি ধারণাকে দেবযানী খণ্ডন করেছেন। দেশভাগ নিয়ে বাংলা সাহিত্য মোটের উপর স্তব্ধ, এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সামনে নিয়ে এসেছেন তথ্যপ্রমাণ, কী ভাবে বাঙালি লেখকরা দেশভাগের বিদারণকে মোটেই এড়িয়ে যাননি, বরং দশকের পর দশক ধরে দীর্ঘ যন্ত্রণাময় কাহিনিকে নিজেদের রচনার মধ্যে ধরে রেখেছেন। ইতিহাসের আর্কাইভ এই সব লিটল্ হিস্টরি বা ছোট ইতিহাসের খোঁজ দিতে পারে না, সাহিত্যই পারে। কিন্তু সেই খোঁজ পেতে গেলে এও মনে রাখতে হবে যে, সাহিত্যেরও নানা রকম ধারা হয়। পঞ্জাবের প্রেক্ষিতে যেমন ধ্বংস-হত্যা-ধর্ষণের মতো মারাত্মক তাণ্ডব ফুটিয়ে তোলার মতো সাহিত্য তৈরি হয়েছে, বাংলার প্রেক্ষিতে কিন্তু সেই সাহিত্য তুলনায় অন্তর্লীন, কম সরব। বাংলার দেশভাগ অনেক দিন ধরে বহমান বলে তাকে বলা হয় ‘লং পার্টিশন’। আর, সাম্প্রদায়িক হিংসা-দাঙ্গা-ধ্বংসের থেকে ‘ডিসপ্লেসমেন্ট’ বা ঠাঁইহারা হওয়ার উপর বেশি জোর পড়েেছ বলে দেবযানী বলেন, ‘পার্টিশন হিস্টরি’র মধ্যে ‘লাইফ স্টোরি’তেই বাংলার সাহিত্যের প্রধান মনোযোগ।

সাহিত্যের অনাদৃত ধারার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ যদি দেবযানীর প্রথম কৃতিত্ব হয়, তবে দ্বিতীয় কৃতিত্ব, ‘ডিসপ্লেসমেন্ট’-এর উপর এতখানি জোর ফেলা। বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ের মধ্যে প্রধান সূত্র ‘ডিসপ্লেসমেন্ট’-এর থিম-টি। ট্রমা সেখানে অনুপস্থিত ভাবলে বিরাট ভুল হবে। বুঝতে হবে যে বাংলা সাহিত্যে দেশভাগের ট্রমা-র আধার ও আকার কত অন্য রকমের। দেশভাগের আগে ছেচল্লিশের দাঙ্গা থেকেই দেবযানীর পর্যালোচনা শুরু, আশাপূর্ণা দেবীর ‘মিত্তির বাড়ি’ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতার স্বাদ’ উপন্যাস দুটিকে ধরে। ব্যক্তি-সম্পর্ক ও পরিবার কাঠামোর পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে নাগরিক সংকটের মোকাবিলা, আর নতুন দেশ তৈরির বোঝাপড়া, বলেন তিনি।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে নোয়াখালির স্মৃতি সম্বলিত সাহিত্য। অশোকা গুপ্ত ও রেণু চক্রবর্তীর স্মৃতিকথা, আর অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকা’, প্রতিভা বসুর ‘সমুদ্রহৃদয়’। দৃষ্টান্তগুলিই বলে দেয়, সংকটবিধ্বস্ত সমাজের মধ্যে নারীজীবনের লড়াই এখানে আলাদা গুরুত্ব পায়। দেশভাগ পরবর্তী বাঙালি সমাজের অবধারিত ভবিতব্য বাঙালি মেয়েদের এই লড়াই। তৃতীয় অধ্যায়ে উদ্বাস্তু কলোনির কাহিনি। শক্তিপদ রাজগুরুর ‘মেঘে ঢাকা তারা’, সাবিত্রী রায়ের ‘বদ্বীপ’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্জুন’ এই নতুন জীবনযাপনের প্রতিরূপ কী ভাবে তৈরি করেছে, তার বিশ্লেষণ করেছেন দেবযানী। এই জীবনেও একটা বড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে যায় উদ্বাস্তু পরিবারের সংগ্রামী মেয়েদের। তৃতীয় অধ্যায়ে মরিচঝাঁপি ও দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তু জীবনের গল্প। সাধারণত সাহিত্য যে মধ্যবিত্ত দৃষ্টিভঙ্গির দ্যোতনার মধ্যে আবদ্ধ থাকে, শক্তিপদ রাজগুরুর ‘দণ্ডকারণ্য থেকে মরিচঝাঁপি’ তার বাইরে চলে যেতে পারে বলে দেবযানীর দাবি। চতুর্থ অধ্যায়ে উত্তরপূর্ব ভারতে, প্রধানত অসম ও ত্রিপুরায়, উদ্বাস্তু জীবনের লড়াই-এর কথা, কী ভাবে তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল এই অঞ্চলের নিজস্ব বিশিষ্ট ভাষাভিত্তিক আইডেন্টিটির সংগ্রামের কাহিনি। অর্থাৎ দেশভাগ এখানে কেবল দেশের থেকে বিচ্যুতি নয়, ভাষা-সংস্কৃতির নিজস্ব বৃত্ত থেকেও বিচ্যুতি। শেষ অধ্যায়ে, ফিরে তাকিয়ে দেখার গল্প, নতুন রাষ্ট্রনির্মাণের প্রেক্ষিতে জীবনের থেমে পড়া এগিয়ে চলার কাহিনি। হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’, সুনন্দা সিকদারের ‘দয়াময়ীর কথা’, মিহির সেনগুপ্তর ‘বিষাদবৃক্ষ’, সেলিনা হোসেনের ‘ভূমি ও কুসুম’ এই অধ্যায়ের আলোচ্য।

শেষ অধ্যায়টি পড়তে পড়তে মনে ধাক্কা দিয়ে যায় আরও কত স্মৃতিকথা, ছোটগল্প, উপন্যাস। যাকে দেবযানী ভূ-রাজনীতিক বন্দোবস্তের শৈল্পিক প্রতিক্রিয়া বলছেন, তার আরও কত ছোট বড় দৃষ্টান্ত। স্বাভাবিক। পুরো সাহিত্যকে একত্রে ধরতে পারা তো কোনও গবেষকের কাজ নয়, দায়ও নয়। মূল প্রবণতাগুলির ইঙ্গিত দিয়ে যাওয়াই প্রধান দায়িত্ব। সেই দিক দিয়ে এই শেষ অধ্যায়টি মনে খুব বেশি দাগ কেটে যায়। সঙ্গে একটা প্রশ্নও তুলে দেয়। আগেকার অধ্যায়ে এই অভিঘাতটি কেন তুলনায় একটু কম? কেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টিটিকে যেন আলাদা করেই আমাদের বিবেচনা করতে হয়? কোনও সমগ্রের অংশ হিসেবে, নিদেনপক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে, তাকে দেখা কেন সম্ভব হয় না? আগেকার সংশয়টি সঙ্গোপনে ফিরে আসে। তবে কি এই ‘স্মরণ’-এর পাশে ‘বিস্মরণ’কেও জায়গা না দিয়ে উপায় নেই? তবে কি সাহিত্য-আলোচকরা এত দিন যে দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন— বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ বিষয়ে স্তব্ধতার পরিসর থেকেই গিয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে, সেটা আমাদের মানতেই হবে? দেবেশ রায় বলেছিলেন, ওই স্তব্ধতার সম্ভাব্য কারণ, শিল্পসাহিত্যের ‘ফর্ম’-এর মধ্যে ভয়ঙ্কর বাস্তবকে তুলে ধরার একটা দীর্ঘকালীন অক্ষমতা। অশ্রুকুমার সিকদার বলেছিলেন, ধর্মসম্প্রদায়-বিষয়ক সংকটের মুখোমুখি হতে কমিউনিস্ট পার্টির যে অনিচ্ছা, তারও কিছু ভূমিকা আছে এই স্তব্ধতার পিছনে। এঁরা কিন্তু কেউই বলেননি যে, এ সব ছাপিয়েও কিছুই লেখা হয়নি বাংলা সাহিত্যে। কেবল বলেছিলেন, যন্ত্রণাময় উচ্চারণের পাশাপাশি একটা স্তব্ধতার বাস্তবও ছিল, ঘোরতর ভাবে ছিল। ওই স্তব্ধতার মধ্যে সমাজগত কিছু প্রবণতা লুকিয়ে ছিল, এটা মেনে নিলে বাংলার অভিজ্ঞতাকে বোঝাটাও সম্পূর্ণ হতে পারে।

দেবযানী সেনগুপ্তের বইটি একটি বিশ্বাসে ভর করে লেখা। সেই বিশ্বাসেই তার জোর। আবার সেই বিশ্বাস থেকেই অভিজ্ঞতার ‘সম্পূর্ণতা’কে বক্তব্যের পরিসরের মধ্যে আনতে না পারার দুর্বলতা। তাই তিনি যখন দাবি করেন, উনিশশো চল্লিশের দশকে কলকাতা শহরের ধ্বস্ত বাস্তব বাংলা সাহিত্যের একটা নতুন ‘জন্্র’ বা ধারা হিসেবে এল, একটু অবাক হতে হয়, তার আগের দশকের কল্লোল যুগের অভিজ্ঞতাকে ঠিকমতো অধিগত করা হয়নি বলে সংশয় জাগে। দাঙ্গা-দেশভাগ নিশ্চয়ই সাহিত্যের নতুন পটভূমি তৈরি করেছিল, কিন্তু নাগরিকতার সংকট আরও আগে থেকেই বাংলা সাহিত্যের উপজীব্য। তত্ত্বগত ভার ও বিশ্বাসগত ভারে এ ভাবেই বইটি কিছু ভ্রুকুঞ্চনের কারণ। তবু ওই বিশ্বাসের জোরেই আবার বইটি এতখানি গুরুত্বপূর্ণ। দেশভাগ-আলোচনার ক্ষেত্রে জরুরি, অবশ্যপাঠ্য সংযোজন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy