হিন্দু কালেজ। প্রসাদ সেনগুপ্ত। সিগনেট প্রেস, ৩০০.০০
হিন্দু কলেজ বলে কিছু একটা ছিল বইকী। সেটা স্থাপন করেছিলেন দেশীয় প্রতিষ্ঠাতৃবর্গ। তার ছিল দু’টি বিভাগ— সিনিয়র আর জুনিয়র। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে ক্রমশ তার মধ্যে ঢুকে পড়ে সরকার। এক সময় রীতিমত নির্দেশনামা জারি করে বলে, সিনিয়র বিভাগ হবে প্রেসিডেন্সি কলেজ আর জুনিয়র বিভাগ থাকবে হিন্দু ইস্কুল নামে। এখন থেকে তাদের হাঁড়ি আলাদা। সেটা ১৮৫৪ সাল। এর ফলে হিন্দু কলেজ বলে আর কিছু রইল না। হিন্দু কলেজের ইতিহাস তাই মোট ৩৭/৩৮ বছরের একটা আখ্যান। সেই গল্প শোনানোর জন্য প্রসাদ সেনগুপ্ত প্রভূত পরিশ্রম করে একটা বই লিখেছেন, যার নাম হিন্দু কালেজ। লেখক চেয়েছিলেন, কলেজের দ্বিশতবর্ষপূর্তি মনে রেখে ১৮১৬-র মে মাসে বের করতে। কেন ১৮১৬-র মে? কারণ, ১৮১৬-র ২১ মে মাসেই কলেজের প্রতিষ্ঠাতারা সিদ্ধান্ত নেন, পরিকল্পিত কলেজের নাম হবে ‘হিন্দু কলেজ’। সুতরাং, ১৮১৭-র ২০ জানুয়ারি ক্লাস শুরু হলেও প্রতিষ্ঠা দিবস ধরা উচিত ১৮১৬-র ২১ মে। গবেষকের এই বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। কলেজের প্রতিষ্ঠাতারা যে ওই দিনটিকেই চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন, তার সমর্থন আছে ১৮১৬ সালের ২৭ অগস্ট অনুমোদিত কলেজের নিয়মাবলিতে। সেখানে ১৪ নং অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা হয়েছে— ‘21st day of may 1817, being the anniversary of the day on which it was agreed to establish the institution’.
একেবারে গোড়া ধরে টান দেওয়া বইটিতে খান পনেরো/ষোলো চিত্রপ্রতিলিপি ও নির্দেশিকা-পরিশিষ্ট সহ ৪৪৪ পৃষ্ঠায় ছড়ানো আছে খান পাঁচেক অধ্যায়। অধ্যায়গুলি এই রকম— প্রাক্ কথন, হিন্দু কলেজ, হিন্দু কলেজের ছাত্র, ইয়ং বেঙ্গল, ডি এল রিচার্ডসন। পরিশিষ্টে আছে প্রেসিডেন্সি কলেজ স্থাপনের সরকারি নির্দেশনামা সহ ছাত্রদের ইংরেজি-বাংলা লেখার কিছু কৌতূহল নিবারক নমুনা।
ধ্রুপদী গবেষকরা যে ভাবে গুছিয়ে, ক্রমবিন্যাস করে, পুঙ্খানুপুঙ্খ উৎস-নির্দেশ সহ নিটোল বৃত্তান্ত রচনা করেন, এ বই সে ভাবে লেখা হয়নি। আবার, রসগ্রাহী পাঠকের উপযোগী করে ইন্দ্রমিত্র বা শ্রীপান্থ চিত্তাকর্ষক রূপে উপজীব্য বিষয়কে যে ভাবে পরিবেশন করেছেন, এ বই সেই সৃজনশীলতার স্পন্দনও পায়নি। বলা যায়, একটু উসকো-খুসকো রীতিতেই লেখা। কিন্তু প্রয়োজনীয় অনুসন্ধিৎসা ও দীর্ঘকালীন শ্রম যে বইটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণেই আছে, তাতে সন্দেহ নেই।
আদি পর্ব, গোলদিঘির বাড়ি, পরিচালন ব্যবস্থা, পরীক্ষা ও পুরস্কারসভা, ছাত্র-বেতন, কর্মচারীর বেতন, ছাত্রসংখ্যা, শিক্ষক, গ্রন্থাগার, ধর্মান্তরিত অধ্যাপক ছাত্র, বাংলা শিক্ষা, বাংলা পাঠশালা, অধার্মিক হেয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়, গরমের ছুটি, হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজ, হিন্দু কলেজ থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ, খ্রিস্টান পুরোহিত সমাজের আক্রমণ, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা— এই সব পরস্পর সম্পর্কহীন প্রসঙ্গ নিয়ে শতাধিক পৃষ্ঠা ব্যেপে হিন্দু কলেজ অধ্যায়টি লেখা। তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট সব প্রসঙ্গ গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে, এমন কথা বলা যায় না। পরিচালন সমিতি নিয়ে আলোচনা অঙ্গুলি পরিমিত। বলা হয়েছে, ‘ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন না নেবার কথা কর্তাদের মাথায় ছিল।’ কিন্তু নিয়মাবলি খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায়, হিন্দু কলেজ পরিচালন সমিতি কলেজটিকে চালাতে চেয়েছিলেন শেয়ার কোম্পানির মতো করে। দাতাদের অংশীদারিত্ব পাকা করে কয়েকটি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল তার পরিচালন অধিকার।
কলেজের আদি পর্বে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, হিন্দু কলেজকে সংস্কৃত কলেজের অট্টালিকায় আনা হয়েছিল— এটা একটা ধাঁধা। ধাঁধা কেন হবে? সিদ্ধান্ত ছিল সংস্কৃত কলেজই হবে। এই সিদ্ধান্ত টাল খেয়ে যায় লর্ড আমহার্স্টকে লেখা রামমোহনের ঐতিহাসিক চিঠিতে। হিন্দু কলেজ ভাড়া বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বিপাকে পড়ে দেশীয় পরিচালন সমিতি সরকারের দ্বারস্থ হয়। তখন সরকার মত পাল্টে ঠিক করে, একই বাড়িতে হিন্দু কলেজকেও ঠাঁই করে দেওয়া হবে। দু’দল সাহেবের (ওরিয়েন্টালিস্ট ও অ্যাংলিসিস্ট) অনেক দিনের বিগ্রহ একই ভবনে সন্ধিবদ্ধ হয়। আর এর দূরপ্রসারী তাৎপর্যও অনুধাবনযোগ্য। হিন্দু কলেজের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি করে ছিল বলেই সংস্কৃত কলেজ থেকে জন্ম নিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। অন্য দিকে, হিন্দু কলেজ থেকে বের হয়েছিলেন মহাকবি মধুসূদন দত্ত। বিনয় ঘোষ ঠিকই ধরেছিলেন, ‘মনে হয় বাস্তব-রাজ্যের নয়, ভাব-রাজ্যের কোনও আর্কিটেক্ট যেন কলেজগৃহটির পরিকল্পনা করেছিলেন।’ প্রসাদবাবু বলেছেন, ‘ভিত্তিপ্রস্তরের হিন্দু কলেজ আসলে সংস্কৃত কলেজ।’ (পৃ ৩৭)। হতে পারে। তবে বিশেষ অর্থে নয়, সাধারণ অর্থে। হিন্দু কলেজও তার মধ্যে আছে। বলা যায়, একই নামে দু’টিকে ধরা হয়েছে। গোলদিঘির বাড়ি সম্পর্কিত আলোচনাটি ভাল। তবে হিন্দু কলেজের সিনিয়র বিভাগ কোন দিকে আর জুনিয়র বিভাগ কোন দিকে চলত, তার মীমাংসা এই বইতেও হল না। হলে ভাল হত।
শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনা বেশ জমাটি। হিন্দু কলেজে প্রণিধানযোগ্য দু’টি যুগ। ডিরোজিও যুগ এবং রিচার্ডসন যুগ। এঁদের জন্যই হিন্দু কলেজ ইতিহাসখ্যাত হতে পেরেছিল। এঁদের সঙ্গে টাইটলার, রিজ, হ্যালফোর্ড, রস্, রামচন্দ্র মিত্রের গল্পও উঠে এসেছে। বলতে দ্বিধা নেই, রিচার্ডসন এ বইতে যে পরিমাণ খাতির পেয়েছেন, সে তুলনায় ডিরোজিও প্রায় চাপা পড়ে গেছেন। না আছে তাঁর কোনও ছবি, না আছে তাঁর সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন। ডিরোজিওর মহা আবর্তে পড়ে (টমাস এডওয়ার্ডের মতো) ডুবতে চাননি বলেই এড়িয়েছেন হয়তো।
কলেজে বাংলা শিক্ষার দুর্বলতা কাটাতে হেয়ারের উৎসাহে বাংলা পাঠশালা খোলা হয় ১৮৩৯ সালে, বর্তমানে যেখানে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধিষ্ঠান। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গির্জা বানানোর জায়গাটা কব্জা করার জরুরি প্রয়োজন থেকেই ওই স্থানটা বাছা হয়েছিল। প্রসাদবাবু অনেকটা খবরই দিয়েছেন। তবে এমন রমরম করে চলা একটা গোটা ইস্কুল কোথায় মিলিয়ে গেল, সে হদিশ তেমন ভাবে দিতে পারেননি। গৌরাঙ্গগোপাল সেনগুপ্ত, প্যারীচাঁদ মিত্র লিখিত হেয়ারের জীবনী সম্পাদনা করতে গিয়ে জানিয়েছেন, হেয়ারের পটলডাঙ্গা স্কুল নানা জায়গায় স্থানান্তরিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত হেয়ার স্কুল রূপে থিতু হয়। কে জানে, ১৮২৩ সালে হেয়ার প্রতিষ্ঠিত পটলডাঙ্গা স্কুলের সঙ্গে ১৮৩৯-এ হেয়ার উদ্বোধিত বাংলা পাঠশালার ছাত্ররাও গিয়ে বসেছিল কি না হেয়ার স্কুলের বেঞ্চে? লেখক ছাত্রদের পরীক্ষা ও পুরস্কারসভা নিয়ে পর্যাপ্ত সংবাদ দিয়েছেন। আরও দেওয়া যেত এশিয়াটিক জার্নালের সঙ্গে ক্যালকাটা গেজেট-এর প্রয়োজনীয় সংখ্যাগুলি দেখার সুযোগ পেলে।
হিন্দু কলেজের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারটির কথা বলেছেন। ছাত্রদের বিদ্বান করার ব্যাপারে মাস্টারদের সঙ্গে তার ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য।
হিন্দু কলেজের পরিচালন সমিতি প্রথম থেকেই স্পর্শকাতরতার কঠিন শালগ্রাম বুকে নিয়ে পথ চলেছিলেন— প্রথমত, রামমোহন দ্বারকানাথদের ছোঁয়াচ বাঁচানো; দ্বিতীয়ত, সরকার যেন এর দখল নিতে না পারে; তৃতীয়ত, খ্রিস্টীয় প্রচারের আগ্রাসন যেন গ্রাস না করে। এ জন্য ধর্মসভার সদস্যবর্গ ধর্মনিরপেক্ষতার নামাবলিই জড়িয়েছিলেন গায়ে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। সরকারকে এড়ানো সম্ভব হয়নি। ১৮৫৪ সালের পর হিন্দু কলেজ বলে কিছু রইল না। ‘সংবাদ প্রভাকর’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিখল— ‘হিন্দু কলেজের হিন্দু মেনেজার দিগের ক্ষমতা সংপূর্ণ অবসান হইয়া শিক্ষা কৌন্সেলের মেয়র সকল ভার গ্রহণ করিয়াছেন।’ (পৃ ১২৯)
‘হিন্দু কলেজ’-এর ছাত্র ও ইয়ং বেঙ্গল— এই দু’টি অধ্যায়ে ছাত্রদের নিয়ে সুপ্রচুর তথ্য ও আলোচনা আছে। সমাজে ‘মননহীন ভোগ সংস্কৃতির বিস্তার-এর পাশে’ হিন্দু কলেজ-এর ছাত্ররা ‘অধ্যয়ননির্ভর, অন্বেষণমুখী জীবনসাধনা’-কে বরণ করেছিল (পৃ ১৮৮-১৮৯) উন্নত সমাজ গঠনের জন্য ‘সেই ছাত্র আগে কখনও তৈরি হয়নি, পরেও নয়, তার কোনও পূর্বসূরি ছিল না, উত্তরসূরিও নেই।’— খানিকটা অমলেশ ত্রিপাঠীর মতো তিনিও এঁদের ‘no father no son’ বলতে চেয়েছেন। বৃহত্তর অর্থে বাংলার ইতিহাসে এঁদের উত্তরসূরি আসেনি— এতটা নিশ্চিত হয়ে বলা চলে কি না সন্দেহ। ‘ইয়ং বেঙ্গল’ অংশটি সুলিখিত। তাঁদের ভূমিকা খারাপ-ভাল দু’দিক থেকেই খতিয়ে দেখা হয়েছে। নাস্তিকতা, শিক্ষা বিস্তার, নীতিবোধ, রাজনীতিচেতনা, দেশপ্রেম, স্বাধীনতার ভাবনা, সব ক্ষেত্রেই তাঁরা এগিয়ে ছিলেন। তবে এঁদের অশ্রদ্ধেয় রূপটিও এড়াননি লেখক।
ডি এল রিচার্ডসন অংশটি তথ্যস্বাতন্ত্র্যে সজীব ও উজ্জ্বল। ডিরোজিও নিয়ে এর মতো একটি অধ্যায় উপজীব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল। এ যেন— যার মেয়ের বিয়ে, তার পাতেই ভাত নেই। এ ধরনের প্রচুর তথ্যভরা গ্রন্থে কিছু ভুল বা বিচ্যুতি থাকা অসম্ভব নয়। কলেজের নিয়মাবলি ২৭ অগস্ট ১৮১৬ তারিখের মিটিংয়ে অনুমোদিত হয়েছিল। তার পূর্ণ রূপ মুদ্রিত হয় Calcutta Directory and Registers for the year 1818-এ। লেখক বলেছেন, ১৮২২ সালের প্রসপেক্টাসে মুদ্রণের কথা (পৃ ৪৪) এই গুরুত্বপূর্ণ নথিটি এ বইতে থাকা জরুরি ছিল। হিন্দু কলেজের নতুন ভবনে ক্লাস শুরু হয়েছিল ২ মে ১৮২৬ থেকে। ১ মে ছিল রবিবার। প্যারীচাঁদ মিত্র কলেজে ছাত্র হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৮২৭ সালের ৭ জুলাই। তিনি বলেছেন, ১৮২৯ সালের জুলাই (পৃ ১৫২)। ১৮২২ সালের ১৫ জানুয়ারি হাইড ইস্ট-কে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন কলেজের ম্যানেজাররা। ছাত্রদের তাতে কোনও সক্রিয় ভূমিকা থাকার কথা নয়। (পৃ ১৯২)
এ সব অঙ্গুলি পরিমিত বিচ্যুতিতে বইটির মর্যাদা কমে না। হিন্দু কলেজের ইতিহাস রচনায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজন। লেখক বহু দিনের শ্রমার্জিত ফসল উপহার দিয়েছেন আমাদের। আশা করি বইটি সমাদৃত হবে সর্ব মহলে। ‘হিন্দু কালেজ’-এর সিল ব্যবহার করে যে প্রচ্ছদ দিয়ে বই-এর শুরু, সেটিও নয়নাভিরাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy