স্মার্ট সিটি: ‘এই-ই আমাদের কালের অশুভ। এই-ই আমাদের উন্নয়ন’
হিন্দুত্ব অর হিন্দ স্বরাজ
লেখক: ইউ আর অনন্তমূর্তি
৩৫০.০০
হার্পার পেরেনিয়াল
অনেকেরই মনে থাকতে পারে, ২০১৩ সালে যখন নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে সারা দেশ সফর করছিলেন, সে সময়ে আমাদের সমকালীন ভারতবর্ষের দার্শনিক কথাসাহিত্যিক, জ্ঞানপীঠ প্রাপক এবং ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্য অন্যতম নির্বাচিত লেখক ইউ আর অনন্তমূর্তি (১৯৩২-২০১৪) সেই প্রার্থীর সাফল্য-সম্ভাবনায় তাঁর আশঙ্কার কথা স্পষ্ট ব্যক্ত করেছিলেন। পরবর্তী কালে সে জন্য তাঁকে কিছু লোকের স্পর্ধার কাছে অসম্মানিত হতে হয়। সেই বিরোধিতা যে কোনও ব্যক্তির প্রতি বিরোধিতা ছিল না, বরং তা ছিল নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর মতাবলম্বীদের দেশভাবনার বিপদ সম্পর্কে লেখকের চিন্তা, হিন্দুত্ব অর হিন্দ স্বরাজ নামে একশো পৃষ্ঠার একটি ছোট বইয়ে অনন্তমূর্তি সেই আশঙ্কার কারণ ও বিকল্প ভাবনা প্রকাশ করেছেন। এক চিন্তাক্রিয় লেখকের নিজস্ব আদর্শ ও বিশ্বাস দেশের সমকালীন সংকটকালে তাঁর ভাবনাকে কতখানি নাড়া দেয়, এবং কত সংহত ভাবে সেই ভাবনাকে তিনি প্রকাশ করেন, তার পাঠঅভিজ্ঞতা পাঠকের কাছে বিরল সম্পদ।
ভারতবর্ষের সামনে যে সমস্যা ক্রমশ সবচেয়ে উৎকট ভাবে আজ মাথাচাড়া দিচ্ছে, অনন্তমূর্তির মতে, তা হল এই বহুবৈচিত্রের দেশকে একটি জাতিরাষ্ট্র বা নেশান স্টেট হওয়ার পথে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য দেশচালকদের প্রবল উৎসাহ। সেই এককেন্দ্রিক জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তি হল ‘হিন্দুত্ব’-এর অবধারণ। ছোট ছোট দশটি বিন্যস্ত অধ্যায়ে তিনি দেখান যে এই ভাবনা নতুন নয়, এর শিকড় নিহিত আছে অন্তত বিশ শতকের প্রারম্ভকালে। দামোদর সাভারকরের বই দি এসেনশিয়ালস অব হিন্দুত্ব-কে (রচনা ১৯২১-’২২) তিনি মনে করছেন এই ধারার প্রথম সংবদ্ধ প্রকাশ বলে। এমনকী, এই বই রচনারও আগে যখন সাভারকর ও গাঁধী উভয়েই লন্ডনে, তখনও সাভারকর কৃষ্ণ বর্মা নামে উভয়েরই পরিচিত এক লন্ডনপ্রবাসী পত্রিকা সম্পাদকের আড়াল থেকে গাঁধীর অহিংসাপন্থার বিরোধিতা করছিলেন এই বলে যে অহিংসা মানুষের মন থেকে নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শসমূহ ধ্বংস করে তাকে কাপুরুষ করে তোলে। এই সাভারকরকেই অনন্তমূর্তি যুক্তি দিয়ে উপস্থিত করছেন প্রথমে নাথুরাম গডসে ও পরে নরেন্দ্র মোদীর চিন্তাগুরু বলে।
একটি সমগ্র অধ্যায়ে অনন্তমূর্তি বিবৃত করেছেন সাভারকরের বইটির সারাংশ। খুঁটিয়ে, ভাঁজ খুলে খুলে তিনি দেখাচ্ছেন কী ভাবে ‘সপ্তসিন্ধবঃ’বর্তী এই দেশ সিন্ধু থেকে হিন্দু হয়ে ওঠে এবং সাভারকরের হাতে সেই ‘হিন্দুত্ব’ই হয় তার জাতিলক্ষণ। হিন্দুস্তানের প্রতি দেশপ্রেম কী ভাবে ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী (majoritarian) জাতিরাষ্ট্রের রূপকল্পনায়। ‘হিন্দুত্ব’কে ব্যাখ্যা করে সাভারকর বলেন, কেবল হিন্দু হওয়াই যথেষ্ট নয়, যথেষ্ট নয় ভারতবর্ষ কারও শুধু মাতৃভূমি হওয়া, যাঁরা এই দেশকে চিহ্নিত ‘পুণ্যভূমি’ বলে মানবেন, সেই প্রকৃত হিন্দুত্ববাদীরাই এদেশকে শাসন করার অধিকারী। অন্যরা কেবল এখানে বাস করতে পারেন মাত্র (পৃ ১৫)। বৈচিত্রময় নয়, একধর্মী অস্তিত্ব— যার ইতিহাসকে নির্মাণ করতে হয়। কাশী হরিদ্বার উজ্জয়িনী— পুণ্যভূমি সকলের নবনির্মাণে নদী-সংহারের পাশেপাশেই নদী-আরতি, মিডিয়ার উচ্চকিত প্রচার, নবভারতের ভূমিকা নির্মাণ।
নিজের সংহত গদ্যে অনন্তমূর্তি উদ্ঘাটন করেন ভারতীয় নাগরিক মানসের বহুলাংশের এক অদ্ভুত দ্বিচারিতা— তাঁরা নিজেদের দৈনন্দিন কাটান অহিংসায় কিন্তু মনে মনে তাঁরা রণনায়কদের পূজারি। সুভাষচন্দ্র, শিবাজি তার প্রমাণ (আরও প্রমাণ হয়ত হিন্দি ফিল্মের মারকুটে নায়কমূর্তিরাও)। ইউরোপও এর ব্যতিক্রম নয়, নেপোলিয়ন সেখানে সফল হিরো। মোদী ভারতীয় জনতার একাংশের মনোজগতের নায়ক হয়ে উঠলেন গুজরাত দাঙ্গার পর। অবিমিশ্র বীরনায়ক হিসাবে মোদী সযত্নে নিজেকে নির্মাণ করছেন। স্ত্রী, পরিবারকে মুছে ফেলেছেন পরিচিতি থেকে, সমাজের সাধারণ স্তর থেকে লড়ে উঠে আসা স্বয়ম্ভূ সত্তা, মহার্ঘ পোষাক, কুশল বাগ্মিতা, প্রবল উপস্থিতি দিয়ে বারে বারে ঘোষণা করছেন এই প্রাচীন সভ্যতা থেকে ‘নতুন ভারত’ নির্মাণ করার কথা।
কেমন সে নতুন ভারত? উন্নয়নই যার একমাত্র পথ। সেই উন্নয়নের চেহারা হবে একমাত্রিক— যা মোদী সাব্যস্ত করবেন, তাই। লেখক অনন্তমূর্তির কাছে ব্যক্তির আত্মমর্যাদার মতোই মূল্যবান সামাজিক সৌভ্রাতৃত্ব, বহুত্ব ও স্থানিকতার অধিকার। তিনি বলছেন মোদীর মানসগুরু দামোদর সাভারকর যে ‘অন্য’হীন ‘হিন্দুশ্রেষ্ঠত্ব’ ও ‘হিন্দু একতা’র কথা বলে গিয়েছেন, মোদী সাভারকরের সেই ‘উই উইল মেক আ স্ট্রং ভারত’ (পৃ ৩৬) বাস্তবে ঘটাতে চেষ্টা করছেন। অনন্তমূর্তি মনে করেন, জিন্নার মতোই সাভারকরও ঈশ্বর বা ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না। সংগঠিত, উগ্র হিন্দুত্ব ছিল তাঁর কাছে শক্তিশালী ভারত গঠনের যন্ত্র। উপায়। আর্যত্ব যেমন হিটলারের। এবং আজ ভারতের প্রশাসনিক প্রধান স্পষ্ট ঘোষণা করছেন, ‘শক্তিশালী, নতুন ভারত’ উদিত হবে কেবল তাঁর নির্দেশিত উন্নয়নের পথে। এই বিকল্পহীন ভোগবাদী উন্নয়নপথই অনন্তমূর্তিকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত করেছে। তাঁর মতে, ‘খনি, বড় বাঁধ, বৃহৎ বিদ্যুৎ-উৎপাদনকেন্দ্র, আর শতাধিক স্মার্টসিটি। হতবৃক্ষ ছায়াবিহীন ছুটে চলা চওড়া রাস্তা, পাঁচতারা হোটেলের ফ্লাশট্যাংক ভরানোর জন্য নদীর পথ বদলে দেওয়া, আদিবাসীদের দেবভূমি অরণ্য ও ছোট পাহাড়গুলি খুঁড়ে ফেলা খনি, চড়ুইহীন বাজার, পাখিহীন গাছ, এই-ই আমাদের কালের অশুভ (evil)। এই-ই আমাদের উন্নয়ন’। (পৃ ১০) এর চূড়ান্ত চেহারাকেও যেন ইতিহাসে প্রত্যক্ষ দেখছেন অনন্তমূর্তি— যখন ইহুদিরা খুন হচ্ছিল, তখনও রাস্তা চওড়া হচ্ছিল জার্মানিতে। বাড়ছিল যুদ্ধ-নির্ভর শিল্পের রমরমা। অনেকে মুগ্ধ হচ্ছিলেন ক্ষমতাদম্ভের সেই অমানুষী প্রকাশে (পৃ ৭৯)।
এই বিকল্পবিহীন, বৃহৎ এককেন্দ্রিক ‘হিন্দুত্বরাষ্ট্র’ ধারণার বিপরীতে অনন্তমূর্তির কাছে অনেক বেশি গ্রহণীয় গাঁধীজির ‘হিন্দ স্বরাজ’। ‘হিন্দ স্বরাজ’-এ উপস্থাপিত বহুকেন্দ্রিক বৈচিত্র, স্থানিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা, প্রয়োজনের স্বল্পতা, অপচয়বিহীন ছোট উৎপাদন ব্যবস্থা যাতে বহু মানুষ কাজে নিযুক্ত থাকতে পারেন— এই পথকে ভারতের পক্ষে অনেক কাঙ্খিত, সুস্থতার পথ বলে মনে করছেন অনন্তমূর্তি। গাঁধীর অন্য একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন, ‘কোনও সামরিক শক্তি ভারতকে ধ্বংস করতে পারবে না। অসংখ্য ক্ষুদ্র, স্বশাসিত, স্বনির্ভর গ্রাম নিয়ে এই দেশ গঠিত।’(পৃ ৭৭) তিনি দেখাচ্ছেন গত শতকের শুরুতে ভারতে জাগ্রত দুটি চিন্তার কথা— একটি প্রবল আবেগে বিরোধিতা করে দেশের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির বৈচিত্রকে, অন্যটি এই বহুত্ব এবং স্থানিকতাকেই দেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা বলে মনে করে।
সেই বইকেই ভাল বই মনে হয় যা চিন্তার দরজা খুলে ভেতরে আলো আসতে দেয়। এই বইটি সেই রকম। এর সব কথার সঙ্গে পাঠক সহমত নাও হতে পারেন কিন্তু ভারতবর্ষের বর্তমান সংকটের স্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই গভীর চিন্তা যে জরুরি তাতে সন্দেহ নেই। এর শান্ত, আবেগবর্জিত উপস্থাপনা রবীন্দ্রনাথের ‘শেষলেখা’কে মনে পড়ায়, যাঁর বহু প্রসঙ্গ এতে বারবার এসেছে। প্রসঙ্গত, অনন্তমূর্তির রচনাটিরও শিয়রে মৃত্যুর ছায়া, ভাষা যেন মোহনাসমীপবর্তী নদীর মতোই— নিরলংকারে বহমান। রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ চেতনাতল থেকে ওঠা, অনন্তমূর্তির চিন্তা থেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy