E-Paper

বাংলা থিয়েটারের দুই যুগন্ধর

দেশ-কাল ভেদে ভিন্ন প্রে‌ক্ষিতে বিভিন্ন মানুষ ইতিহাসের বয়ে যাওয়া ঘটনাকে আলাদা আলাদা ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। থিয়েটার এক চলমান বিষয়, সময়ের সঙ্গে বদলে যায়।

দিশারি: (বাঁ দিকে) শন্তু মিত্র ও উৎপল দত্ত।

দিশারি: (বাঁ দিকে) শন্তু মিত্র ও উৎপল দত্ত। —ফাইল চিত্র।

শম্পা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:২২
Share
Save

নথিবদ্ধ সাল-তারিখ কালক্রমের সূত্রে গেঁথে ঘটনাপরম্পরা হিসেবে ব্যক্ত করলেই তা ইতিহাস হয়ে ওঠে না। দেশ-কাল ভেদে ভিন্ন প্রে‌ক্ষিতে বিভিন্ন মানুষ ইতিহাসের বয়ে যাওয়া ঘটনাকে আলাদা আলাদা ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। থিয়েটার এক চলমান বিষয়, সময়ের সঙ্গে বদলে যায়। শো থেকে শোয়ে নাটকের মঞ্চায়নেও ছোট-বড় নানা বদল ঘটে নিরন্তর, তেমনই কাল থেকে কালান্তরে ইতিহাসের কথক পাল্টালে ইতিহাসের ব্যাখ্যাও পাল্টাতে বাধ্য। ‍উৎপল দত্ত বা শম্ভু মিত্র কেন নাটক লিখলেন, তার মঞ্চায়ন কী ভাবে ঘটল, সে সবের অন্তরালে যে কার্যকারণ সূত্র— থিয়েটার-ইতিহাসবেত্তা ও পাঠক, ‍উভয়েরই তা ‍জানা প্রয়োজন। আলোচ্য বই দু’টিতে সেই ব্যাখ্যাই রয়েছে।

শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্ত: একটি বিতর্ক এবং অন্যান্য প্রবন্ধ বইটিতে ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ প্রবন্ধে লেখক বলেন, “সেই অর্থে Real বলে কিছু নেই। যে দেখছে বা দেখাচ্ছে তার অবস্থানের এবং দেখার ‍উপরেই সব কিছু নির্ভর করছে।” শম্ভু মিত্র ও ‍উৎপল দত্তের নাট্যজগতে অবদান অপরিসীম। দু’জনেই আগ্রাসী পাঠক, ‌ক্ষুরধার মেধা ও অসামান্য চিন্তনশক্তি তাঁদের সম্পদ। মত ও পথের অমিল ছিল, তবে দু’জনেই নিজ নিজ দ‌ক্ষতায় বাংলা থিয়েটারের একটি পর্বকে সমৃদ্ধতর করেছেন। ‍উৎপল দত্তের নাটকে বিশেষ রাজনৈতিক দর্শনের পাশাপাশি ছিল হি‍উমার। তাঁর থিয়েটার একটা পথ নির্দেশ করে: সে পথ দর্শক মানতেও পারেন, না-ও পারেন, তবে তা অস্বীকার করা কঠিন। প্রজ্ঞাবান এই অভিনেতা লেখায়, বক্তৃতায়, অভিনয়, মঞ্চসজ্জা ও নাট্য-উপস্থাপনায় এই বোধ দর্শকের মনে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। অনেক মানুষকে নিয়ে ‘টোটাল থিয়েটার’-এর ভাবনা তাঁর মনে ছিল, মঞ্চে সেই থিয়েটারের প্রয়োগপদ্ধতিও অভিনব।

শম্ভু মিত্র-উৎপল দত্ত: একটি বিতর্ক এবং অন্যান্য প্রবন্ধ

দর্শন চৌধুরী

৩৫০.০০

পুস্তক বিপণি

শম্ভু মিত্রের গণনাট্য পরিত্যাগ, বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে নবান্ন পরিচালনা ও সম্পাদনা প্রসঙ্গে বিতর্কের অবতারণা করেছেন লেখক। দয়াল মণ্ডল ও টা‍উট চরিত্রে অভিনয় করতেন তিনি। এ নাটকের ঘটনাগত বেদনার কেন্দ্রটি না জানা থাকলে এই দুই চরিত্রে সংবেদনশীল অভিনয় করা যেত কি না সন্দেহ। রাজা অয়দিপা‍উস, দশচক্র বা চাঁদ বণিকের পালা-তে ব্যথাতুর মানবাত্মার আর্তি প্রকাশিত। গালিলিওর জীবন দেখেছিলেন ‍উৎপল দত্ত, মূল ভূমিকায় শম্ভু মিত্র। এক দৃশ্যে ইনকুইজ়িটর গালিলিওকে ‌ক্ষমা চাইবেন কি না জিজ্ঞেস করাতে তিনি আমতা আমতা করে নীরবে আঙুলের গাঁটে জোড়-বিজোড় মাসের হিসাব করছিলেন, যাতে জেলে যাওয়ার আগে আকাশের তারা দেখে নেওয়া যায়। ‍উৎপল দত্ত তা কী ভাবে বুঝলেন জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন, অন্তত এক জন হলেও এটা বুঝবে; ‘গ্রেট অ্যাক্টর’ কখনও ‘মেজরিটি’র কথা ভেবে অভিনয় করেন না। রাজা অয়দিপা‍উস নাটকের তীব্র সমালোচনা করে ফ্রন্টিয়ার পত্রিকায় শম্ভু মিত্রের অভিনয় প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “শম্ভু মিত্র ইজ় দ্য গ্রেটেস্ট অ্যাক্টর অব দ্য প্রেজ়েন্ট ইন্ডিয়ান থিয়েটার।” শিল্পীর শিল্পচর্চা সকলের কাছে হৃদয়গ্রাহী না হয়ে ‍উঠতে পারে, শিল্পীর ‍উত্তরণ-অবনমন সবই থাকতে পারে। শম্ভু মিত্র সে সবের ‌ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু বক্তা একাই ‍উভয়প‌ক্ষ ‍উপস্থাপন করলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদার সম্ভাবনা থেকে যায়। তখন বিতর্কটি শক্ত ইমারতের ‍উপর না দাঁড়িয়ে নড়বড়ে হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

রবীন্দ্রনাট্য, শম্ভু মিত্র এবং আমরা

শেখর সমাদ্দার

৫০০.০০

এবং মুশায়েরা

বইটিতে কৃষক বিদ্রোহের প্রে‌ক্ষাপটে দেবীগর্জন নিয়ে তথ্যপূর্ণ আলোচনা আছে। লেখকের মতে, বিজন ভট্টাচার্যের নাটকের ক্রমোন্নতির রেখাচিত্র আঁকলে জবানবন্দী থেকে নবান্ন-এ ‍উঠতে ‍উঠতে দেবীগর্জন-এ এসে শিখর স্পর্শ করে। থিয়েটারের আন্তর্জাতিক মানচিত্রটি লেখকের অধিগত, তাই এই বইয়ে চিনের রেড থিয়েটার ও গণনাট্য সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন তিনি, আবার রাজনৈতিক নাটকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আইরিশ মুক্তি আন্দোলনের নাটক, লেডি গ্রেগরির রাইজ়িং অব দ্য মুন-এর কথাও বলেছেন। ‘দেশভাগ ও বাংলা নাটক’ প্রবন্ধে লেখকের মত, দেশভাগ ও-পার বাংলাকে তেমন আলোড়িত করেনি বলে দেশভাগ নিয়ে সেখানে যথেষ্ট নাটক লেখা হয়নি। এই বইয়ে বিনোদিনীর বঞ্চনার কাহিনি যেমন প্রাসঙ্গিক স্থান পেয়েছে, তেমনই আছে মণিপুর কলাক্ষেত্র প্রযোজিত দ্রৌপদী নাটকের কলকাতায় পাঁচ বার অভিনীত হওয়ার কথা; মুখ্য চরিত্রে সাবিত্রী হেইসনাম, মূল গল্প মহাশ্বেতা দেবীর। এই নাট্যে কাহিনি এসে মেশে মহাভারতের লাঞ্ছিতা অপমানিতা দ্রৌপদীর তুলনায়, ধর্ষিতা নারীর প্রতিবাদী অভিনয়ে দর্শক স্তব্ধ হন।

বইটির তিনটি প্রবন্ধ থিয়েটার বিষয়ক নয়। ‘জাহান্নমের আগুনে বসিয়া’ নজরুল বিষয়ক আলোচনা। শরৎচন্দ্র মানুষের দুঃখ, বেদনা ও সামাজিক নিপীড়নের কথা বললেও তা থেকে ‍উত্তরণের পথ দেখাননি— ‘শরৎ সাহিত্যের সীমা ও সিদ্ধি’ প্রবন্ধে এ নিয়ে আলোচনা আছে। পথের দাবী ‍উপন্যাস স্বাধীনতাকামী ইংরেজবিদ্বেষী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের চিন্তাভাবনা থেকে জাত জনপ্রিয় ‍উপন্যাস, এ বইয়ের ‘পথের দাবী’ প্রবন্ধে শরৎ-প্রশস্তি থাকলেও উপন্যাসে স্ববিরোধিতার পক্ষেও নানা যুক্তির অবতারণা করেছেন লেখক। প্রবন্ধগুলি নানা সময়ে নানা ভাবনায় প্রাণিত হয়ে লেখা, কোথায় কবে প্রকাশিত তার সূত্রগুলি থাকলে আরও ভাল হত।

রবীন্দ্রনাট্য শম্ভু মিত্র এবং আমরা বইটির লেখক শেখর সমাদ্দার। রবীন্দ্রনাট্য-চর্চা সম্পর্কে আলোচনার সঙ্গে যে নাটুয়া রবীন্দ্রনাট্যকে মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিয়েছেন, সেই শম্ভু মিত্রের শিল্পভাবনার পরিচয় আছে বইটিতে। রবীন্দ্রনাট্যে গানের ব্যবহার বড় কম নয়, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নৃত্যময় নানা অভিব্যক্তি। এমনকি গদ্যকবিতা লেখার যুগে রবীন্দ্রনাথ চিন্তা করেছেন গদ্যকে সুর দেওয়ার কথা। ‘রবীন্দ্রনাথের নৃত্যাভিনয়’ প্রবন্ধে আছে নাচের পরিপূর্ণ ব্যবহারের প্রসঙ্গ; রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাট্যচর্চায় যে সুন্দরের খোঁজ ও প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, তার অনুধাবন করেছেন লেখক। যোগাযোগ ‍উপন্যাসের নাট্যরূপে অভিনয় করেছিলেন শিশির ভাদুড়ি, তেমন সার্থক হয়নি তা। ‍উপন্যাসের তুলনায় নাট্যরূপ যে পূর্ণতর, এ বিষয়ে আলোচনায় রবীন্দ্র-কন্যা মীরার অস্বাছন্দ্যময় দাম্পত্যের কথা ‍উল্লেখ করেছেন লেখক। ‍‌উপন্যাস প্রকাশের সমকালে সে দাম্পত্য-সম্পর্ক আরও প্রকট। ডাকঘর নাটক সম্পর্কে লেখকের মত: আশি বছর জুড়ে এ নাটকের পূর্ব ও পশ্চিম ভূখণ্ডে অভিনয় প্রমাণ করে, তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দশটি নাটকের অন্যতম। চিরকুমার সভা-র তিনটি ভিন্ন ভিন্ন প্রযোজনা দেখে তার পর্যালোচনাও করেছেন লেখক।

রবীন্দ্রনাট্য-চর্চায় বহু কৌণিক ‌ক্ষেত্র আছে যা অনাবিষ্কৃত। আধুনিক অনুষঙ্গে স্থান-কালের গভীর ও ব্যাপ্ত জটিলতায় নাটকগুলিকে পুনরাবিষ্কার করা যেতে পারে। লেখকেরও সেই কথা— জগৎ জুড়ে যেন একটা নাচ চলেছে, একেই বলি লীলা। “এই লীলাকেই ভারতীয় থিয়েটার ধরতে চেয়েছে এবং আজো চাচ্ছে,” লেখেন তিনি। লেখক ছাত্রবয়সে ‘বহুরূপী’ নাট্যদলে যোগ দিয়েছিলেন, শম্ভু মিত্রের নাট্যচর্চা সম্পর্কে তিনি বরাবর অনুসন্ধিৎসু। তাঁর বইয়ে ‘অতীন থেকে চাঁদ বণিক’ অধ্যায়টিতে চাঁদ বণিকের পালা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে। আছে দৃঢ় সিদ্ধান্ত: শুধু কাব্যনাটক হিসেবেই নয়, নাটক হিসেবেও তা ‍উদ্বুদ্ধ করবে প্রকৃত শিল্পসন্ধানী অভিযাত্রীকে— “মোড়ককে যারা বড়ো করে দেখে, তারা নয় অবশ্যই।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review theatre artist Theatres

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।