Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

ঢাকাই মসলিনের খোঁজে

সাইফুলের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান দৃক-এর কেন্দ্র লন্ডনে, তাই তিনি ছুটলেন সেখানকার সুবিখ্যাত সংগ্রহালয়— ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে। তারপর লর্ড ক্লাইভের বাসস্থান পাওইস কাসল-এ।

অঙ্গাঙ্গি: মসলিনের পোশাক পরিহিত মহিলা, ঢাকা। শিল্পী: ফ্রানসেস্কো রেনাল্ডি, ১৭৮৯। ইয়েল সেন্টার ফর ব্রিটিশ আর্ট, পল মেলন সংগ্রহে রক্ষিত

অঙ্গাঙ্গি: মসলিনের পোশাক পরিহিত মহিলা, ঢাকা। শিল্পী: ফ্রানসেস্কো রেনাল্ডি, ১৭৮৯। ইয়েল সেন্টার ফর ব্রিটিশ আর্ট, পল মেলন সংগ্রহে রক্ষিত

শ্যামলী দাস
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৩৪
Share: Save:

মসলিন/ আওয়ার স্টোরি

লেখক: সাইফুল ইসলাম

মূল্য অনুল্লেখিত

দৃক পিকচার লাইব্রেরি (ঢাকা, বাংলাদেশ)

মসলিন শব্দটা আমাদের যেন একটা মায়াবী জগতে নিয়ে যায়। ভোরবেলার শিশিরভেজা ঘাসের উপর অস্বচ্ছ চাদরের মতো তার রূপ। কিংবা, মাকড়সার জালের মতো, হেমন্তের রাতের জ্যোৎস্নার মতো হালকা পাতলা কাপড়— যা নাকি একটা মাঝারি মাপের আংটির মধ্যে দিয়ে গলে যায়, দু’তিন পরত কাপড় পরাবার পরেও যা দেহের লজ্জা ঢাকতে পারে না। মসলিন নিয়ে কত ইতিহাস কত গল্প। অথচ, আটশো বা তারও বেশি কাউন্টের এই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্রের আর কিছুই বেঁচে নেই। দেশের বা বিদেশের কোনও সংগ্রহ বা সংগ্রহালয়েও দেখা যায় না। যা দেখা যায় তার সিংহভাগই বিদেশি সংগ্রহে নকশা-তোলা মলমল অথবা জামদানি, ইউরোপের অভিজাত সমাজে যা দিয়ে পোশাক তৈরি হত বা স্কার্ফ হিসাবে ব্যবহৃত হত। আর দেখা যায় সুলতানি বা মুঘল দরবারে আঁকা ছবিতে।

কিছু দিন আগে লন্ডনে একটি প্রদর্শনী দেখার পর বাংলাদেশের নামকরা প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞাপন জগতের পুরোধা সাইফুল ইসলামের মনে প্রশ্ন জাগে, মসলিন কোথায় বোনা হত, কারা বুনতেন এই মায়াবী জাদুর মতো কাপড়, কোথায় কী ধরনের কার্পাস গাছের তুলো থেকে কারা এই সূক্ষ্ম সুতো তৈরি করতেন, কী ভাবে এর খ্যাতি সাত সমুদ্র পারে পৌঁছে গিয়েছিল, আবার কেনই বা চিরতরে মুছে গেল এই কিংবদন্তিতে রূপায়িত বস্ত্রশিল্প? তাঁর অনুসন্ধিৎসার শেষ নেই। পূর্ণ উদ্যমে সমমনস্ক সহকারী ও পেশাদার চিত্রগ্রাহকদের সঙ্গে নিয়ে শুরু হল তাঁর অভিযান।

প্রথমে গেলেন লন্ডনের কিউ গার্ডেনে। তারপর গেলেন শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে— উনিশ শতকের প্রবাদপ্রতিম উদ্ভিদবিজ্ঞানী উইলিয়াম রক্সবরা ও জর্জ ওয়াটের গবেষণালব্ধ নমুনা ও ছবির সংগ্রহ দেখতে। জানতে পারলেন বাংলাদেশে ঢাকা অঞ্চলে ও আশেপাশে নদীর দু’ধারে ‘ফুটি কার্পাস’ গাছের কথা, যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘গসিপিয়াম আরবোরিয়াম’। সাইফুল লোকজন নিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে বার করলেন এই শ্রেণির কিছু কার্পাস গাছ। খুঁজে বার করলেন এমন একজন গুণী তাঁতশিল্পীকে যিনি এখনও উঁচু কাউন্টের সুতো পেলে ওই রকম সূক্ষ্ম মোলায়েম কাপড় বোনার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে মসলিনের দুর্দিন শুরু হয়। অল্প কিছু দিনের মধ্যে মসলিনের চাহিদা ও উৎপাদন কমে যায়। চাহিদা এতই কমতে থাকে যে দু’তিন দশকের মধ্যে ফুটি কার্পাসের গাছও অবলুপ্ত হয়ে যায়।

সাইফুলের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান দৃক-এর কেন্দ্র লন্ডনে, তাই তিনি ছুটলেন সেখানকার সুবিখ্যাত সংগ্রহালয়— ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে। তারপর লর্ড ক্লাইভের বাসস্থান পাওইস কাসল-এ। আরও নানান জায়গায়— লেখিকা জেন অস্টেনের স্মারক মিউজিয়ামে, প্যারিসে নেপোলিয়নের স্ত্রী জোসেফিনের সংগ্রহ ঘুরে বেড়ালেন, যেখানে সতেরো থেকে উনিশ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঢাকা ও হুগলি থেকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও দুষ্প্রাপ্য কার্পাস বস্ত্র আমদানি করত। তারপর অন্যান্য সুন্দর বস্ত্রসম্ভারের সংগ্রহ দেখলেন, কিন্তু আসল জিনিসের কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না।

‘পেরিপ্লাস অব দি এরিথ্রিয়ান সি’-র নাম-না-জানা গ্রিক নাবিক, রোমান লেখক প্লিনি, চিন দেশের পরিব্রাজক শুয়ান সাং (হিউয়েন সাং), মুঘল দরবার বিশেষ করে আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ ও সপ্তদশ শতকের ফরাসি পর্যটক জাঁ বাপতিস্ত তাভের্নিয়ে ঢাকাই মসলিনের উচ্ছ্বসিত বিবরণ দিয়েছেন। মুঘল দরবারে যে সূক্ষ্ম অস্বচ্ছ কাপড়ের ব্যবহার হত তাকে ‘শাহি মলমল’ বলা হত। তাতে কখনও জামদানির মতো হালকা কাজ থাকত। ইউরোপে যে সব ঢাকাই বস্ত্র রফতানি হত তাতেও হালকা কাজ থাকত। সাইফুল তাঁর সঘন অনুসন্ধানেও তাই দেখতে পেলেন। কিন্তু প্রাচীন যুগের বিশ্ববন্দিত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সেই মোলায়েম মসলিনের দেখা পেলেন না।

এর পর তিনি মসলিনের ধারাবাহিক ইতিহাস যতটুকু জানা গিয়েছে ও মসলিনের বয়নপদ্ধতি নিয়ে পরবর্তী দুটি অধ্যায়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। মুঘলদের ক্রমিক পতন ও চাহিদা কমে যাওয়ার পরেও ঢাকাই মসলিন, জামদানির উৎপাদন কমে যায়নি এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা অন্য ইউরোপীয় বণিকরা যে এই পণ্য বিপুল পরিমাণে রফতানি করেছেন সাইফুল তার সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। ব্রিটিশ সমাজে মসলিনের জনপ্রিয়তার কথা তিনি সমসাময়িক লেখা থেকে জেনে উদাহরণ দিয়ে লিখেছেন।

তার পর ঘনিয়ে আসে মসলিনের দুর্দিন— ইউরোপ ও আমেরিকায় শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে নানা ধরনের নকল কাপড়ে বাজার ছেয়ে যায়। কার্পাস ও কার্পাসবস্ত্রের উৎপাদনের মূল অঞ্চলে যন্ত্রে তৈরি সস্তার কাপড়ে বাজার ভরে ওঠায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি হাতে বোনা কাপড়ের দুর্দিন এগিয়ে আসে। শ্বাসরোধকারী আইন ও নিয়মকানুনের বেড়াজালে তাঁতবস্ত্রের নাভিশ্বাস ওঠে।

বইয়ের শেষ ভাগে সাইফুল আশার কথা শুনিয়েছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে যে সব বর্ণময় ও বৈচিত্রময় বস্ত্রের উৎপাদন ও ব্যবহার হয়, তার বিকল্প হয় না। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে এ দেশে ও বিদেশে (অধুনা চিন দেশ থেকে) যে সব কৃত্রিম উপাদানে নকল জিনিস তৈরি হয় ও সস্তায় বিক্রি হয় তাতে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে গেলেও ভাল নকশার সরু সুতোর বা রেশমের জমকালো শাড়ি বা কাপড়ের চাহিদা কম নয়। ঢাকাই জামদানির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তবে আগের মতো বাছাই করা তুলো থেকে সূক্ষ্ম সুতো পাওয়া যায় না। আর ওই রকম সুতোয় বোনার মতো তাঁতশিল্পী পাওয়া কঠিন বলে একশো/ একশো কুড়ি-র বেশি কাউন্টের কাপড়ের উৎপাদন খুবই কম। তবু সাইফুল দেখিয়ে দিয়েছেন যে তার চেয়ে অনেক বেশি কাউন্টের ঢাকাই কাপড় বোনা অসম্ভব নয়।

অনেকগুলি তথ্যসমৃদ্ধ ‘ওয়ান পেজার’, রেখাচিত্র, মানচিত্র, একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নির্ঘণ্ট ও পূর্ণ গ্রন্থপঞ্জি থাকায় সাইফুল কিন্তু একটি ‘কফি-টেবল’ বই নির্মাণ না করে বেশ প্রয়োজনীয় একটি আকরগ্রন্থ উপহার দিয়েছেন। শহিদুল আলমের ছবিগুলি নজরকাড়া, যদিও কিছু ছবি যেন লেখার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি।

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review Muslin Our Story Saiful Islam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy