গীতাঞ্জলি রিবর্ন/ উইলিয়ম রাদিচেজ রাইটিংস অন রবীন্দ্রনাথ টেগোর
সম্পাদক: মার্টিন কেম্পশেন
৮৫০.০০
সোশ্যাল সায়েন্স প্রেস (পরি: ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান)
রবীন্দ্রোত্তরকালে এদেশে তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ যে হয়নি তা নয়। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের শতবার্ষিকীর সময় হুমায়ুন কবির সম্পাদিত ওয়ান হানড্রেড অ্যান্ড ওয়ান/ পোয়েমস বাই রবীন্দ্রনাথ টেগোর বইটির কথা। অনুবাদকরা প্রত্যেকেই আপন আপন ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। ১৯৮৫ সালে তরুণ ব্রিটিশ কবি উইলিয়ম রাদিচে রবীন্দ্রকবিতার অনুবাদ সংকলন প্রকাশ করলেন। রবীন্দ্রনাথ টেগোর/ সিলেক্টেড পোয়েমস (দ্বিতীয় সং ১৯৮৭) সাড়া জাগিয়েছিল কম নয়। তিনি অনুবাদের জন্য কবিতাগুচ্ছ বেছেছিলেন সঞ্চয়িতা থেকে। রাদিচে ইচ্ছে করেই বইটিতে ‘বিশ্ব মাঝারে ছড়িয়ে পড়া’ গীতাঞ্জলি-র কবিতা রাখেননি, রাখেননি গীতবিতান-এর গান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্যের আধুনিক ইংরেজি পাঠকদের কাছে রবীন্দ্রনাথকে পৌঁছে দেওয়া। বইটি বাঙালি পাঠকদেরও এমনই আগ্রহী করেছিল যা অনুবাদকের কাছেও বিস্ময়কর, কেননা তাঁরা তো মূল রবীন্দ্রনাথই পড়তে পারেন। তাঁর দ্বিতীয় অনুবাদ রবীন্দ্রনাথ টেগোর/সিলেক্টেড শর্ট স্টোরিজ (১৯৯১) গ্রন্থের ভূমিকায় রাদিচে একথা বলেছেন।
ইতিমধ্যে রাদিচের কলমে ডাকঘর, তাসের দেশ এবং আরও বেশ কিছু রবীন্দ্রসাহিত্যের অনুবাদ পাঠকের হাতে পৌঁছেছে। ২০১১ সালে প্রকাশিত হল গীতাঞ্জলি-র এক নতুন অনুবাদ আর এক গীতাঞ্জলি।
বইটি তার স্বাদে গন্ধে ভাবনায় পাঠকের সামনে এক নতুন জগতের দরজা খুলে দেয়। রাদিচে ভূমিকায় বলেছিলেন, শতবর্ষ প্রাচীন গীতাঞ্জলি সং অফারিংস-এর এই নবকলেবর প্রকাশ, রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর অর্ঘ্য দান। সম্প্রতি পাওয়া গেল মার্টিন কেম্পশেন সম্পাদিত গীতাঞ্জলি রিবর্ন নামে রাদিচে-র একটি প্রবন্ধ সংকলন। বলা বাহুল্য বিষয় রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর গীতাঞ্জলি সং অফারিংস। একবিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী (২০১১), গীতাঞ্জলি সং অফারিংস প্রকাশ এবং তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির শতবর্ষ যথাক্রমে ২০১২ ও ২০১৩। এই তিন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে বিশ্বময় যে সমারোহ হয়েছিল, কেম্পশেন বলেন, কবির জীবৎকালে যখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে তখনও তাঁকে ঘিরে এতটা উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়নি।
গীতাঞ্জলি সং অফারিংস-এর শতবর্ষ উপলক্ষে রাদিচে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে প্রায় বিশ্ব পরিক্রমা করেছিলেন। কবি ও রবীন্দ্র অনুবাদক রাদিচে বক্তার ভূমিকায় যে শ্রোতাদের মনে একটি বিশেষ ছাপ রাখতে পেরেছিলেন প্রবন্ধগুলি পড়তে পড়তে সে কথা অনুভব না করে পারি না। সংকলনটিতে মোট উনিশটি প্রবন্ধ আছে। প্রবন্ধগুলির মৌলিকতা অনস্বীকার্য।
রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তা যেমন তিনি অনুভব করেছেন, গীতাঞ্জলি সং অফারিংস-এর রবীন্দ্র-পাণ্ডুলিপির সঙ্গে ১৯১২-য় প্রকাশিত ওই বই-এর পার্থক্যগুলির অনুপুঙ্খ বিচারে যে সব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এই বক্তৃতামালায় তার পরিচয় নানা দিক থেকে ধরা পড়েছে। যদিও ডব্লিউ বি ইয়েটস-কৃত গীতাঞ্জলি সং অফারিংস-এর ভূমিকা এবং তাঁর প্রকাশ-পূর্ব পরিমার্জন বহুল প্রচারিত। কিন্তু সে সময়ই সে ভূমিকা ইভলিন আন্ডারহিলের মতো অনেকেরই প্রশংসা পায়নি। রাদিচে তাঁর অনেক বক্তৃতাতেই এই প্রসঙ্গে অনেকগুলি ত্রুটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ইয়েটস গ্রন্থটির পরিমার্জনের ভূমিকায় মোটেই সার্থক হননি বরং রবীন্দ্র-পাণ্ডুলিপি অনেক বেশি মূলানুসারী বলে রাদিচের মনে হয়েছে। তিনি বিশেষ করে নজর টেনেছেন যে, অনাবশ্যক যতিচিহ্ন আরোপে কবিতার প্রাণস্পন্দন ব্যাহত হয়েছে, কোনও উৎকর্ষ ঘটেনি। এ যেন, ‘সুরহীন গান শিখাহীন প্রদীপ’। মূল পাণ্ডুলিপির যে সব শব্দ ইয়েটস পরিবর্তন করেছিলেন, সৌরীন্দ্র মিত্র খ্যাতি অখ্যাতির নেপথ্যে গ্রন্থে সে পরিবর্তনগুলিকে মান্যতা দিতে নারাজ ছিলেন, তা রাদিচের দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনিও ওই লেখকের সঙ্গে একমত।
রাদিচে নিজের করা অনুবাদের বিশেষত্বগুলির প্রসঙ্গে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি সং অফারিংস-এর অনুবাদ থেকে তাঁর অনুবাদ ভিন্ন। ব্যালাড-কে তিনি ব্যালাড-ই রেখেছেন, সনেট-কে সনেট। গানের অনুবাদে গানের আস্থায়ী অন্তরা সঞ্চারী আভোগ অংশতে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলি বজায় রেখেছেন। প্রসঙ্গত রাদিচে গীতাঞ্জলি সং অফারিংস-এর পাণ্ডুলিপি ও অন্যান্য বিষয়ে আরও নানা কথা জানিয়েছেন। তাঁর অনূদিত গীতাঞ্জলি স্বকীয় ভাবনায় ঋদ্ধ। একথা স্বীকারে রাদিচের কোনও রকম দ্বিধা নেই যে, গীতাঞ্জলি সং অফারিংস-এ ইয়েটসের কলম যে রাস্তায় চলেছিল শতাব্দী-নবীন অনুবাদকের সেটি মনোমত হয়নি। তাঁর মতে, ইংরেজি ভাষায় গীতাঞ্জলি–র জন্ম ও জন্মান্তর সাহিত্যের ইতিহাসে এক মূল্যবান দলিল। সম্পাদক মার্টিন কেম্পশেনকে অশেষ ধন্যবাদ। তিনি নিজে গুণী ও গুণজ্ঞ, সকলেই জানেন। কবি অনুবাদক উইলিয়ম রাদিচেকে অভিনন্দন। রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কলি উদ্ধৃত করতে লুব্ধ হচ্ছি: ‘কে আমারে ভরসা করে আনতে আপন বশে?/সে কি অমনি হবে?/ আপনাকে সে করুক-না বশ, মজুক প্রেমের রসে...’
মনে হল, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কবিযুগল প্রেমের রসেই বন্দি। কথাই তো ছিল ‘মিলাবে মিলিবে’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy