Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

যদুর মায়ের শোভন সংস্করণ

বিলেত-ফেরত ডাক্তার, রাগ করে সরকারি চাকরি ছেড়ে এমন প্রাইভেট প্র্যাকটিস হাঁকিয়েছিলেন, যে নেপালের রানি অবধি খাতির করে ফিটন গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

জেন্ডার, মেডিসিন, অ্যান্ড সোসাইটি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া/ উইমেন্‌স হেল্‌থকেয়ার ইন নাইনটিন্থ অ্যান্ড আর্লি টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল

লেখক: সুজাতা মুখোপাধ্যায়

৮৯৫.০০

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

কলকাতা শহরে চিকিৎসায় নামযশ প্রথম করেন কোন মহিলা? কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের নামটাই মনে আসা স্বাভাবিক। বিলেত-ফেরত ডাক্তার, রাগ করে সরকারি চাকরি ছেড়ে এমন প্রাইভেট প্র্যাকটিস হাঁকিয়েছিলেন, যে নেপালের রানি অবধি খাতির করে ফিটন গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। সে সব গল্প একটু-আধটু জানা। কিন্তু যদুর মাকে সবাই ভুলে গিয়েছে। তাঁর নাম যখন লোকের মুখে-মুখে, তখনও জন্মায়নি মেডিক্যাল কলেজ। শ্বশুরমশাই ভবানীচরণ দত্ত ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান। স্বামী কাশীনাথ রোগী দেখতেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী রোগী দেখা শুরু করেন। তাঁর হাতযশের কথা কবিতায় লিখে গিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। আর ছিলেন নাপিত ঘরের রাজুর মা। কাটাছেঁড়ার কাজে সিদ্ধহস্ত, তাতেই সংসার চলত তাঁর। তখনও অ্যান্টিসেপ্টিক, অজ্ঞান করার গ্যাস আসেনি। হয়তো লালমুখো সার্জেনের চাইতে খুব মন্দ হত না তাঁর কাজ।

১৮৩৫ সালে মেডিক্যাল কলেজ খুলতে সব দিশি পদ্ধতি বাতিলের দলে পড়ে গেল। চিকিৎসা মানে দাঁড়াল হাসপাতালের চিকিৎসা। কিন্তু বেড থাকে পড়ে, ভদ্রঘরের মেয়েরা ওমুখো হয় না। অতএব তাদের ‘শিক্ষিত’ করার কাজটা কাঁধে নিলেন ভদ্রলোকেরা। একের পর এক বই লেখা হল মেয়েদের কর্তব্য বোঝাতে। তাদের মূল সুর, অশিক্ষিত, অপরিচ্ছন্ন পিসি-মাসিদের কথা শুনে চলো না, কথা শোনো কলেজ-শিক্ষিত স্বামীর। আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ মাতা হওয়ার নানা শর্তের মধ্যে ঢুকল পরিচ্ছন্নতা, পুষ্টি, আধুনিক চিকিৎসার কদর করার অনুজ্ঞা।

কিন্তু উপদেশ কদাপি এক প্রকার হয় না। ১৮৭৪-এ রাজনারায়ণ বসু লিখছেন, আজকাল ছেলেমেয়েরা এত দুর্বল হচ্ছে, কারণ মায়েরা দিশি ওষুধ ভুলে বিলিতি ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। ‘স্ত্রীর প্রতি স্বামীর উপদেশ’ বইতে লেখা হচ্ছে, টুথ পাউডারের চাইতে নিমের দাঁতন ভাল। বামাবোধিনী পত্রিকা নিয়মিত ‘পাঁচন ও মুষ্টিযোগ’ নামে একটি কলাম বার করত। এই দ্বন্দ্ব শুধু চিকিৎসার নয়। এ হল উপনিবেশের কেন্দ্রের দ্বন্দ্ব। এক দিকে শ্বেতাঙ্গের বশ্যতা স্বীকার করেও তারই শেখানো বিদ্যায় তাকে মাত করার চেষ্টা। অন্য দিকে নিজের দেশ-ধর্ম-সংস্কৃতির উৎকর্ষের ধ্বজা তুলে বিদেশির আধিপত্যে আঘাত।

তবে কলোনির মধ্যেও থাকে কলোনি। ভারতীয় শিক্ষিত পুরুষের উপনিবেশ ছিল তার অন্তঃপুর। সেখানে বিধি-নিয়ম সে-ই তৈরি করবে, আবার মেয়েদের ‘আলোকপ্রাপ্ত’ করার গুরুভার কাজটাও তার। অতএব ভারতীয় মেয়ের শরীর-মন হয়ে উঠল ডবল-কলোনি। দেশের কর্তা আর গৃহকর্তা, দু’পরতে আধিপত্য সেখানে। এই ডবল-অনুশাসনে তৈরি ‘মডেল’ গৃহবধূ হল যদুর মায়ের শোভন সংস্করণ। তার হাতে পরিবারের প্রাথমিক চিকিৎসার দায়িত্ব। সেখানে সে কবিরাজি-হাকিমির ধারক-বাহক। কিন্তু দরকারে বিলিতি ডাক্তার ডাকবে, বিদেশি ওষুধ বেছে নেবে। ইতিহাসবিদ সুজাতা মুখোপাধ্যায় বলছেন, এর লক্ষ্য ছিল মেয়েদের বিদেশি চিকিৎসার শিক্ষিত উপভোক্তা করে তোলা। বাড়ির গিন্নিদের টার্গেট করে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পেটেন্ট ওষুধের বিজ্ঞাপন বেরোতে লাগল। তাদের আঁচলেই যে বাঁধা সংসার-খরচের টাকা, যা থেকে ওষুধও কেনা হয়।

এ খুব কম কথা নয়। মেয়েরা বিদেশি চিকিৎসার আধিপত্য স্বীকার করা মানে ভারতের ঘরে ঘরে বিদেশি ডাক্তারের পসার, যা অন্যথায় প্রায় অসম্ভব ছিল, বলছেন সুজাতা। উপনিবেশে শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল পুরুষদের করণিক তৈরি, মেয়েদের যোগ্য সঙ্গিনী তৈরি, এ কথা বহু চর্চিত। সুজাতার বিশ্লেষণ, মেয়েদের শিক্ষার এক মৌলিক উদ্দেশ্য বিলিতি পণ্য ও পরিষেবার আগ্রহী ক্রেতা তৈরি। এ ভাবে চিন্তা করলে মনে হয়, বাংলায় মেয়েদের ‘এডুকেটেড কনজিউমার’ করে তোলা দিয়ে যার শুরু, তা এক রকম উল্টো উপনিবেশ তৈরিতে কাজে লেগেছে পশ্চিমে। মেয়েদের ডিশওয়াশার, ওয়াশিং মেশিন দিয়ে ঘরবন্দি করা শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। ‘মোনা লিসা স্মাইল’ ছবিটায় দেখানো হয়েছে, মার্কিন কলেজগুলোতে কী ভাবে আদর্শ গৃহিণী তৈরির পাঠ দেওয়া হত। ১৯৬৮ সালে অন্তর্বাস জ্বালিয়ে অমন পণ্যবন্দি করার প্রতিবাদ থেকে শুরু নারী আন্দোলনের। সুজাতা কি এই বিশ্লেষণ মানবেন? জানা নেই, কিন্তু এমন চিন্তা উস্কে দেওয়ার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ।

সুজাতা দেখিয়েছেন, সে যুগের মেয়েরাও কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে জানত। বিলিতি চিকিৎসাবিদ্যার সাহায্যে তারা দিশি নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। ১৮৯১ সালে মেয়েদের যৌনমিলনে সম্মতির বয়স দশ থেকে বারোয় তোলার চেষ্টা হয়। রক্ষণশীল সমাজ শোরগোল তোলে। নারী সংগঠনগুলি যুক্তি সাজায় আধুনিক চিকিৎসা থেকে। পণ্ডিতা রমাবাই প্রতিষ্ঠিত আর্য মহিলা সমাজ ব্রিটিশ মহিলা চিকিৎসকদের বয়ানে তেরোটি বালিকাবধূর ক্ষতের বিবরণ জমা দেয়। বাংলার বহু ডাক্তারের সাক্ষ্য, বিলিতি পাঠ্যবইয়ের অংশ তুলে সওয়াল চালায় মেয়েরা। সে আইন পাশ হল। ফের ১৯২৯ সালে যখন বয়সের সীমা চৌদ্দো বছর করার কথা উঠল, তখন প্রতিরোধ কমে গিয়েছে, মেয়েরাও অনেক সংগঠিত। বলা হয়, সেই প্রথম ভারতে মেয়েরা ‘গোষ্ঠীস্বার্থে’ চাপ তৈরি করল জননীতি নির্মাণে।

সুজাতা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সে যুগে বিয়ের বয়স বা জন্মনিয়ন্ত্রণের আলোচনার উদ্দেশ্য কিন্তু মেয়েদের সক্ষমতা বাড়ানো ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ। মেয়েদের ‘ডিসিপ্লিন’ করার কাজটা ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব, জাতীয়তাবাদ, জিনতত্ত্ব, এমনকী নারীবাদের কাছেও জরুরি ছিল। কোনও তত্ত্বই মেয়েদের দেহে-জীবনে তাদের অধিকার দেওয়ার কথা বলেনি। তা বলে মেয়েরা এই সব উপদেশ-প্রত্যাশা মেনে নিয়েছে, তা নয়। অধিকাংশ মেয়ে সে সব টেরই পায়নি, অনেকে জেনেও পাত্তা দেয়নি, আর কেউ কেউ প্রতিরোধ করেছে। জৌনপুরের দাইদের সম্মান আর দাপটকে প্রতিরোধের দৃষ্টান্ত বলে দেখিয়েছেন সুজাতা।

কিন্তু অনধিকারের উত্তরাধিকার রয়েই গেল। স্বাধীনতার পর কালো সাহেবরা জনসংখ্যা রুখতে মেয়েদের বন্ধ্যত্বকরণের পাইকারি ক্যাম্প বসাল। সুজাতা এখানেই থেমেছেন, কিন্তু তাঁর চিন্তাসূত্র ইঙ্গিত দেয়, আজ কেন মেয়েদের শরীর একাধারে রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের উপনিবেশ। রাষ্ট্র বলছে, শিশুমৃত্যু রুখতে প্রসব হবে হাসপাতালেই। ব্যবসায়ী বলছে, প্রসব হবে সিজার করে। পঞ্চাশেও মা হওয়া যায়, ষাটেও কচি খুকির বুক-নিতম্ব মেলে। অসুখ হওয়ারও অপেক্ষা নেই আর। জিন পরীক্ষা করে স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা কষে ম্যাসটেকটমির ‘প্যাকেজ’ ফিরি করছেন কিছু ডাক্তার। নারী স্বাধীনতা যেন সুপারমার্কেটে ট্রলি-ঠেলা ক্রেতার স্বাধীনতা।

‘চয়েস’-এর আতিশয্যের নীচে বোবা বিষাদময়ীদের ভিড়। মন্বন্তরের পঁচাত্তর বছরে বড় জরুরি কাজ করেছেন সুজাতা। দুর্ভিক্ষ মেয়েদের যে বেশি বিপন্ন করেছিল, তার সাক্ষ্য তুলে এনেছেন নানা সূত্র থেকে। তারা প্রাণ হারিয়েছে বেশি, ভিখিরি হয়েছে, বিক্রি হয়ে গিয়েছে। মেয়েদের ও শিশুদের অপুষ্টি যে বড় বেশি, সে কথা ফেমিন কমিশন রিপোর্টে লিখেছিল। আজও প্রতি বছর গাদা গাদা রিপোর্ট বলে দিচ্ছে, আকালের সন্ধান মিলছে কত মা-শিশুর দেহে।

ইতিহাস যে শুধু পেশাদারি চর্চার বিষয় নয়, প্রতিটি মানুষের জীবনচর্যার সূত্র, সে কথা মনে করিয়ে দিলেন সুজাতা। আক্ষেপ, অ-সাধারণ বইটির প্রচ্ছদের ছবি আর পাঠ বড় মামুলি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy