গোড়ায় একটা জবাবদিহি করে নেওয়া প্রয়োজন— দুটো আপাত-সম্পর্কহীন বইকে এক সঙ্গে জুড়ে নেওয়া কেন? সাংবাদিক কুণাল পুরোহিত সন্ধান করেছেন এক আলো-আঁধারি দুনিয়ার, যেখানে গান আর কবিতা হয়ে উঠছে উগ্র হিন্দুত্ববাদের বাহন। আর, আচরণবাদী অর্থনীতিবিদ ড্যান অ্যারিয়েলি কোভিড-১৯ অতিমারির পটভূমিকায় সন্ধান করেছেন, কী ভাবে মানুষের মনে শিকড় বিস্তার করে ভ্রান্ত বিশ্বাস। কুণালের খোঁজ সাংবাদিকসুলভ তাড়নায়; অ্যারিয়েলি নিজে শিকার হয়েছিলেন ভ্রান্ত বিশ্বাস আর অপপ্রচারের। দুটো বইকে এক সূত্রে বাঁধে এই ফেক নিউজ় আর ভ্রান্ত বিশ্বাস। বস্তুত, এমন ভাবে বাঁধে, যেন মনে হয় যে, দ্বিতীয় বইটা আসলে প্রথম বইটার ‘চিটশিট’— প্রথম বইয়ে যে সব অমীমাংসিত ধাঁধা রয়েছে, দ্বিতীয় বইটিতে যেন তার প্রতিটির উত্তর দেওয়া আছে। বই দু’টি নিশ্চিত ভাবেই আলাদা আলাদাও পড়া সম্ভব, কিন্তু এক সঙ্গে পড়লে খুলে যেতে পারে ভাবনার নতুন দিক।
গত কয়েক মাসে এইচ-পপ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে সংবাদমাধ্যমে— এই বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই। তার পরেও অল্প কথায় মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ইদানীং রামনবমী থেকে প্রজাতন্ত্র দিবস, যে কোনও অনুষ্ঠানেই গৈরিক জমায়েত থেকে লাউডস্পিকারে যে মুসলমান-বিদ্বেষী উগ্র পুরুষালি হিন্দুত্ববাদী গান ভেসে আসে, তারই নাম হিন্দুত্ব-পপ বা এইচ-পপ। ‘অগর ছুঁয়া মন্দির তো তুঝকো দিখা দেঙ্গে/ তুঝে তেরি অওকাত বতা দেঙ্গে’, অথবা ‘কুছ লোগো কি তো সাজিশ হ্যায়/ হম বচ্চা খুব বনায়েঙ্গে/ যব সংখ্যা হুয়ি হমসে জ়াদা/ ফির আপনি বাত মনায়েঙ্গে’— একটু ভাবলেই মনে পড়বে, এই গানগুলো কানে এসেছে কয়েক মাসের মধ্যেই। বঙ্গানুবাদ না করলেও এর অন্তর্নিহিত বিদ্বেষ এবং রাজনীতি বুঝত সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এই গান দু’টি যাঁর, তাঁর নাম কবি সিংহ— কুণালের বইয়ের প্রথম পর্বের প্রধান চরিত্র তিনি। বইয়ের অন্য কুশীলবদের মতোই তিনিও বিজেপির অতি ঘনিষ্ঠ— বিজেপি নেতারা নিজেদের প্রচারের কাজে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উস্কে দিতে ব্যবহার করেন তাঁদের; আবার, কবি সিংহরাও চান বিজেপির টিকিটে ভোটে দাঁড়াতে। বিজেপির বিদ্বেষের বাস্তুতন্ত্রে এঁরা তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্র— উত্তর ভারতের সংস্কৃতিতে কবিগান, কবিতা পাঠের আসরের যে ইতিহাস রয়েছে, তাকে ব্যবহার করে বিজেপির রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের অন্দরমহল অবধি পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন কবি সিংহ, কমল আগ্নেয়র মতো ‘শিল্পী’রা।
এইচ-পপ: দ্য সিক্রেটিভ ওয়ার্ল্ড অব হিন্দুত্ব পপ স্টারসকুণাল পুরোহিত
৪৯৯.০০
হার্পার কলিন্স
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচারযন্ত্র হিসাবে এঁদের গুরুত্ব বোঝা কঠিন নয়— কোনও ভাষণ বা তত্ত্বকথা নয়, নেহাত গান কবিতা দিয়ে মানুষের মনে বিদ্বেষ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন এঁরা। কুণাল লিখেছেন, প্রতি দিনের খবরের কাগজ থেকে তাঁর গানের বিষয় খুঁজে নিতেন কবি সিংহ— যা নিয়ে মানুষ কথা বলছে, যা বিদ্বেষকে গভীরতর করে তুলতে পারে, সেগুলোই তাঁর গানের বিষয়। কমল আগ্নেয় ইতিহাসে আগ্রহী— গৈরিক জাতীয়তাবাদীদের বয়ানকে আবেগে জারিয়ে মানুষের কানে ও মনে পৌঁছে দেন তাঁর কবিতা। উত্তর ভারতের সমাজে এই ঘটনাগুলো কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ, বইটি পড়লে তা স্পষ্ট হয়। কিন্তু, কুণালের বই থেকে গভীরতর দু’টি প্রশ্ন উঠে আসে— এক, কেন কবি বা কমলদের মতো ‘শিল্পী’রা খানিক জেনে, খানিক না-জেনেই জড়িয়ে পড়েন অর্ধসত্য ও ডাহা মিথ্যার এই বিদ্বেষ-বাস্তুতন্ত্রে; এবং দুই, সাধারণ মানুষ কেন বিশ্বাস করেন এই মিথ্যা বয়ানে, এই গানে-কবিতায়, এবং অন্যান্য রাজনৈতিক প্রচারে?
এই প্রশ্ন দুটোর উত্তর রয়েছে ড্যান অ্যারিয়েলির বইয়ে। তাঁর মতে, ভ্রান্ত বিশ্বাস একটা ফানেলের মতো— তার ঢোকার মুখটা চওড়া, এবং তাতে ঢুকে পড়াও সহজ। এক বার সেই ভ্রান্ত বিশ্বাসের বাস্তুতন্ত্রে ঢুকে পড়লে ফানেল ক্রমে সরু হয়ে আসতে থাকে— প্রথম ভ্রান্ত বিশ্বাস তার পরবর্তী ভ্রান্ত বিশ্বাসকে আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে, এবং সাধারণ ভাবে যাঁরা র্যাশনাল বা যুক্তিবাদী মানুষ, তাঁরাও বিশ্বাস করতে থাকেন ইর্যাশনাল বা অযৌক্তিক তত্ত্বে। অ্যারিয়েলি লিখেছেন কোভিড-১৯ অতিমারিকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া প্রবল ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং হরেক ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের কথা। কিন্তু, ভারতের গৈরিক মিথ্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতেও পড়া যায় তাঁর বইকে।
অ্যারিয়েলি লিখেছেন, প্রবল চাপ মানুষের যুক্তিবোধে বিঘ্ন ঘটায়। সেই চাপ সামাজিক পরিস্থিতির কারণেও হতে পারে, আবার ব্যক্তিগত পরিস্থিতির কারণেও হতে পারে। অতিমারি, লকডাউন ইত্যাদির চাপ তো বটেই, ভারতে গত দশ বছর মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও চাপের অভাব রাখেনি। আর্থিক অসাম্য কী ভাবে বেড়েছে এবং কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তোমা পিকেটি-র সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র তার প্রমাণ। নোট বাতিল থেকে জিএসটি, বিভিন্ন সামাজিক খাতে ক্রমাগত ব্যয়সঙ্কোচ, লকডাউনের বিভীষিকা, সবই সাধারণ মানুষকে বিপর্যস্ত করেছে। তাঁরা দেখেছেন, প্রতি দিন তাঁরা গত কালের চেয়ে খারাপ আছেন। দোষ কার, তাঁরা সেই উত্তর খুঁজেছেন— ঠিক এই সন্ধানের জায়গাতেই তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, দোষ মুসলমানদের, দোষ গান্ধী-নেহরুর, দোষ উদারবাদীদের, দোষ জেএনইউ-এর। সেই দোষ বহুমাত্রিক, কিন্তু তার জবাব একটাই, আরও বেশি ‘দেশপ্রেমী’ হয়ে ওঠা, সনাতনী হয়ে ওঠা। মিসবিলিফ: হোয়াট মেকস র্যাশনাল পিপল বিলিভ ইর্যাশনাল থিংসড্যান অ্যারিয়েলি
৪৯৯.০০
হেলিগো বুকস
সেই ভ্রান্ত বিশ্বাসকে পোক্ত করে তোলার জন্য হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় জোগান দিয়েছে একের পর এক তত্ত্বের, তাতে কখনও ব্যবহার করেছে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদের তত্ত্বের খণ্ডিত ও বিকৃত অংশ, কখনও গড়ে তুলেছে কোনও হিন্দুত্ববাদী মহামণ্ডিতকে। পাশাপাশি, লাগাতার প্রশ্ন করে গিয়েছে উদারবাদী পণ্ডিতদের, নাগরিক সমাজকে— তাঁদের উপরে আরোপ করেছে হরেক কিসিমের দোষ। কবি সিংহ বা কমল আগ্নেয়র গান-কবিতা ঠিক এই কাজটাই করে গিয়েছে, তাই তাঁরা হিন্দুত্ববাদী বাস্তুতন্ত্রের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ। এই দোষারোপের ধরনটিও উল্লেখযোগ্য— হিন্দুত্ববাদী বয়ানে জেএনইউ ক্যাম্পাসে শুধুই মদের বোতল, গাঁজার কল্কে আর ব্যবহৃত কন্ডোম পড়ে থাকে; নেহরু কেবলই মহিলাঘটিত গোলমালে জড়িয়ে থাকেন; অমর্ত্য সেন বা রোমিলা থাপরের মতো পণ্ডিতরা হয় চরিত্রহীন, নয় মূর্খ, টুকে পাশ। অ্যারিয়েলি বলেছেন, শত্রু চিহ্নিত করাই যথেষ্ট নয়, তাকে নৈতিক ভাবে ঘৃণ্য দেখানো হল মিথ্যার বেসাতির অপরিহার্য অঙ্গ।
কবি সিংহ বা কমল আগ্নেয়রা তাঁদের শিল্পের রাজনৈতিক উপযোগিতা বোঝেন, বিলক্ষণ। তাঁরা প্রয়োজন মতো সুর চড়াতে ও নামাতেও জানেন। কিন্তু, সবটাই ব্যবসা নয়, যে কথা তাঁরা প্রচার করছেন, তাতে তাঁরা বিশ্বাসীও বটে। তাঁরা দু’জন দুই ভিন রাজ্যের বাসিন্দা, পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন। কিন্তু, তাঁদের মধ্যে মিল আছে। ছোট শহরের চৌহদ্দিতে বেড়ে ওঠা, সীমিত প্রথাগত শিক্ষা, নিজের বিশ্বাসকে প্রশ্ন করতে পারার অক্ষমতা— সব মিলিয়ে তাঁরা যে চারিত্রিক ছকটির প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁদের ‘ফ্যান’দের মধ্যেও সেই বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকট। তাঁরা জটিলতা এড়াতে চান, সহজবোধ্য ন্যারেটিভ খোঁজেন। ঘৃণার চেয়ে সহজবোধ্য, আদিম বয়ান আর কিছু হয় কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy