‘‘সম্প্রতি শান্তিনিকেতন এবং তার কাছেই একটা সাঁওতাল গ্রামে সাতদিন শুটিং সেরে ফিরলাম।’’— ১৯৯১-এর ৩০ জানুয়ারি দেবযানী রায়কে চিঠিতে লিখেছিলেন সত্যজিৎ, শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ তৈরির সময়।
‘আগন্তুক’-এর মনোমোহনকে মনে আছে নিশ্চয়ই, তিনি দেশ ছেড়েছিলেন ১৯৫৫-য় (সে-বছরই মুক্তি পেয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’), ঘর ছাড়ার পর দেশ ছাড়ার আগে কর্মজীবনের গোড়াতে ওই শান্তিনিকেতনেই কিছুদিন অজ্ঞাতবাসে কাটিয়ে গিয়েছিলেন মনোমোহন, স্বদেশি আদিবাসীদের সঙ্গে।
বহু কাল পর দেশে ফিরে, কলকাতায় তাঁর ভাগ্নি অনিলার বাড়িতে কিছু দিন কাটিয়ে হঠাৎ সেখান থেকে বেরিয়ে আবার সেই শান্তিনিকেতনেই চলে আসেন মনোমোহন। ফের দেশ ছাড়ার আগে, উইলের উত্তরাধিকার বুঝে নেওয়ার অছিলায় যেন-বা শিকড় ছুঁয়ে যাওয়ার জন্যেই।
তাঁকে ফিরিয়ে আনতে অনিলা আর তার স্বামী সুধীন্দ্রকে শান্তিনিকেতনে পৌঁছে সেখানকার সাঁওতালদের গ্রামে যেতে হয়। তাদের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে মনোমোহনের চোখদুটো জ্বলতে থাকে আমাদের দেশের জনজাতির ঐতিহ্যের গর্বে, তাদের ব্রিটিশ-বিরোধী ঐতিহ্যের গর্বে।
মানিকদার চিঠি দেবযানীকে
সঙ্কলক: দেবযানী রায়
৫৫০.০০
কারিগর
ছাত্রীজীবন থেকেই দেবযানী সত্যজিতের লেখালিখি ড্রয়িং আর চলচ্চিত্রের ঘোর অনুরাগিণী, তাঁকে লেখা সত্যজিতের এই চিঠিপত্রাদি (সময়কাল: ১৯৭৫-’৯১) আমাদের পৌঁছে দেয় সত্যজিতের ছবির প্রস্তুতিপর্ব থেকে নির্মাণপ্রক্রিয়া পর্যন্ত, সর্বোপরি তাঁর শিল্প-অভিপ্রায়েও।
১৯৯০-এর ১৬ অক্টোবরের চিঠিতেও ‘আগন্তুক’-এর প্রসঙ্গ, লিখছেন: ‘‘হঠাৎ একান্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আগামী ২২ নভেম্বর থেকে নতুন ছবি আগন্তুক-এর শুটিং আরম্ভ করছি!... একটি চমৎকার বিষয়বস্তু/ কাহিনী মাথায় এসে গেল— দশ দিনের মধ্যে চিত্রনাট্য, casting সব শেষ।’’
শঙ্খ ঘোষ তাঁর একটি গদ্যে আমাদের খেয়াল করিয়ে দেন ‘‘ও-ছবির শেষ দিকে সাঁওতালি নাচটার কথা ভাবুন। মনোমোহনের পাশে দাঁড়িয়ে সুধীন্দ্র আর অনিলা দেখছে সেই নাচ, মুগ্ধ ট্যুরিস্টরা যেভাবে দেখে। কিন্তু দেখতে দেখতে, অনিলার শরীরে অল্প অল্প দোলা লাগে, বোঝা যায় তার ভিতরে আসছে নাচ। সুধীন্দ্র তাকে ইশারা করছে সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দেবার জন্য। উদ্ভাসিত অনিলা জিজ্ঞেস করছে ‘যাই?’ আর চলেও যাচ্ছে খুশি মনে, দলের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে তৈরি হচ্ছে চমৎকার তার নাচ, তাদের নাচ। সুধীন্দ্রকে ডেকে কানে কানে মনোমোহন বলছেন: এতক্ষণে বিশ্বাস হচ্ছে ও আমার ভাগ্নি।’’ (ইশারা অবিরত)। শুধু ‘আগন্তুক’-ই নয়, নাচের অনুষঙ্গে ঋত্বিকেরও শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-কে তুলনায় এনে কবি বলেন: ‘‘আদিসমাজের নাচের মধ্যে নিজেকে জুড়ে নেবার ছবি এইভাবে এল আমাদের দুই প্রধান পরিচালকের ছবিতে।’’ পাশাপাশি সত্যজিৎ সম্পর্কে আর-একটি জরুরি কথাও মনে করিয়ে দেন: ‘‘যুক্তিবাদী সভ্যতার বাইরে গিয়ে দাঁড়াবার একটা আগ্রহ খুব স্পষ্ট তাঁর একেবারে শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এর মধ্যে।’’
পৃথ্বীশকে মনে পড়ে? সে মনোমোহনকে প্রশ্ন করেছিল ‘‘ক্যানিবালিজম-কে আপনি সভ্যতার কোন স্তরে ফেলবেন?’’ তির্যকতা ছিল মনোমোহনের উত্তরে: ‘‘সভ্য কে জানেন?... সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ যে আঙুলের একটা চাপে একটা বোতাম টিপে একটা ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে একটা গোটা শহরকে সমস্ত অধিবাসীসমেত ধ্বংস করে দিতে পারে।’’ আর যারা মারণাস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের আরও ভয়ঙ্কর মনে করেন মনোমোহন। ছবির শেষে অনুতপ্ত অনিলা আর সুধীন্দ্রকে যখন তিনি প্রাপ্ত পৈতৃক সম্পত্তির পুরোটাই দিয়ে বিদায় নেন, তখন ইংরেজি অভিধানের সবচেয়ে বেশি অক্ষরের সবচেয়ে বড় শব্দটা উচ্চারণ করে তার অর্থটাও পরিষ্কার করে দেন: ‘সেটিং লিটল অর নো ভ্যালু’। তার পর হেসে সুধীন্দ্রকে যে কথাগুলো বলে চলে যান তার অর্থটা অনেকটা এই রকম: এই সারহীনতাটুকু বোঝাতে এত জাঁকজমক, এতখানি কথা, এই না হলে সভ্যতা!
‘আগন্তুক’-এর আগের ছবি দু’টি— ‘শাখাপ্রশাখা’ ও ‘গণশত্রু’ নিয়েও দেবযানীর চিঠিতে প্রায় একই ভাবে সরব সত্যজিৎ। ১৫ জুন, ১৯৯০-এ লিখছেন ‘‘শাখাপ্রশাখা— এ ছবিতে আমার ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা (ছবি করার এবং মানুষ চেনার) সবটুকু ঢেলে দিয়েছি।’’ পরের চিঠিটিতে (২৯ অগস্ট, ১৯৯০) ‘শাখাপ্রশাখা’-র প্রাইভেট শো-এর কথা উল্লেখ করে জানাচ্ছেন, সকলেই বলছে এ-ছবিটি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি। আরও আগে ১৯৯০-এর ৩ মার্চের চিঠিতেও দেবযানীকে লিখেছেন: ‘‘শাখা-প্রশাখা তোমার ভালো লাগবে বলে আমার বিশ্বাস। এ ছবিতে আমি আমার সব কিছু ঢেলে দিয়েছি।’’ ওই চিঠিরই প্রথম দিকে আছে: ‘‘তোমার গণশত্রু ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। সমালোচকের বোকামি এ-ছবির আলোচনায় যেমন ভাবে প্রকাশ পেয়েছে তেমন আর কোনো ছবির বেলায় পায়নি। অথচ আমি নিজে ছবিটা করে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।’’
আসলে সমস্যা তৈরি হয় তখনই, যখন ইবসেনের ‘এনিমি অব দ্য পিপল’ থেকে সত্যজিৎ ‘গণশত্রু’ তৈরি করেন, সেখানে ছবির ভালমন্দ নিয়ে কথা হয় প্রচুর, কিন্তু ফিল্ম আর থিয়েটার এই দুই আর্টফর্মের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে কোনও আলোচনা হয় না। ইবসেনের থিয়েটারের রিয়ালিজ়ম-কে সত্যজিৎ তাঁর ফিল্মের রিয়ালিজ়ম-এ এনে ফেলতে কোন ধরনের ভাঙচুর, নমনীয়তা বা মিশ্রণকে প্রয়োজনীয় করে তোলেন— এ সবের কোনও কিছুই অগভীর আলোচনায় উঠে আসে না। ফলে সত্যজিৎ ছবিটি করে যতটাই আনন্দ পান ততটাই ব্যথিত হন ‘সমালোচকের বোকামি’ দেখে।
এই শেষ তিনটি ছবিকে সত্যজিতের স্টাইলের ভিন্ন একটি পর্ব মনে করেন কেউ-কেউ। সেই ‘ঘরে বাইরে’ থেকে আমৃত্যু দীর্ঘ অসুস্থতা তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছে নতুন-এক স্টাইলের দিকে, আর ‘গণশত্রু’ ও ‘শাখাপ্রশাখা’ পেরিয়ে সে-স্টাইল পরিণত রূপ পেয়েছে ‘আগন্তুক’-এ। এই মতাবলম্বীদের খুব কাছাকাছি শ্যাম বেনেগালের মত: ‘‘রে’জ় লাস্ট থ্রি ফিল্মস ওয়্যার দ্য ক্রিয়েশনস অব আ ম্যান ফিজ়িক্যালি রেস্ট্রিক্টেড বাই ইলনেস... ‘আগন্তুক’ ওয়াজ় আ ভেরি ফাইন ফিল্ম অল দ্য সেম, ইভন দো আই কান্ট সে দ্য সেম অব ‘শাখাপ্রশাখা’ অ্যান্ড ‘গণশত্রু’।’’ এ নিয়ে তর্ক আছে, তর্ক থাকবেও, তবু এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে তাঁর আগেকার শিল্পগত অবস্থান থেকে সরে আসছিলেন সত্যজিৎ শেষ পর্বের ছবিগুলিতে। ‘শাখাপ্রশাখা’ তো বটেই, আরও বেশি করে ‘আগন্তুক’-এ তিনি গল্পের প্রথানুগ বাস্তব বা ঘটনাকে কেবল বহিরবয়ব করে রাখতে চান, আদতে জোর দিতে চান অন্তর্বাস্তবতার উপরেই, নিজের বিশ্বাস বা দর্শনকেই প্রকাশ করতে চান মুখ্য চরিত্রের মাধ্যমে। সংলাপ ক্রমশই হয়ে উঠতে থাকে লক্ষণাত্মক। ‘আগন্তুক’-এ তো মনোমোহন অধিকাংশ সময়েই কথা বলে যান প্লেফুল মুড-এ। মৃণাল সেন ‘আগন্তুক’-এর সংলাপ নিয়ে নির্দিষ্ট ভাবে মন্তব্যই করেছিলেন ‘‘দ্য ওয়ার্কিং আউট অব দ্য ওয়ার্ডস অ্যান্ড লাইনস মে বি লাইকেন্ড টু আ মাস্টার পেন্টার প্লেইং উইথ ব্রাশ অ্যান্ড কালার।’’
এ ভাবেই জন-অরণ্য, শতরঞ্জ কে খিলাড়ী, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরকরাজার দেশে, পিকু ও সদ্গতি... নিজের বিভিন্ন ছবির প্রসঙ্গ এসে পড়ে সত্যজিতের পত্রালাপে, যা থেকে তাঁর শিল্পকে ফিরে-পড়া বা নতুন করে বোঝার দরজা খুলে যায় অনায়াসে। এমনকি সত্যজিৎ নিজেও কখনও বোঝাতে থাকেন ফেলুদা নিয়ে তাঁর তৈরি ফিল্ম দু’টির তফাত: ‘‘ছবি হিসাবে সোনার কেল্লা আর জয় বাবা-র তুলনা বোধহয় ঠিক হবে না কারণ দুটোর মেজাজ বেশ আলাদা। সোনার কেল্লায় মনটা দূরে চলে যাবার যে ব্যাপারটা ছিল, সেটা অবশ্যই ফেলুনাথ-এ নেই। তাছাড়া মুকুলের ঘটনাটায় একটা কাব্যের ছোঁয়া ছিল। ফেলুনাথ অনেক বেশি টাইট, শহুরে, সেয়ানা।’’
ছবি ছাড়াও ফেলুদা বা শঙ্কু-কে নিয়ে লেখালিখির কথা প্রায় প্রতিটি চিঠিতেই বলেছেন: ‘‘ক্রমে শঙ্কু আর ফেলুদা এমনই কাছের লোক হয়ে গেছে যে তাদের নিয়ে গল্প লিখতে সত্যিই খুব মজা লাগে। তবে প্লটের ভাণ্ডার ত অফুরন্ত নয়— সেখানেই ভয়।’’ এই সঙ্গে ছবি-আঁকা, ‘সন্দেশ’-সম্পাদনা, গানবাজনা-শোনা... সবই যে তাঁর প্রতি দিনের বেঁচে থাকা, সে হদিশও মিলবে চিঠিগুলিতে।
হাতে-লেখা-চিঠির রোমাঞ্চ যে আজ আমাদের জীবনে নস্টালজিয়া, ভূমিকা-য় সে-কথা লিখেছেনও দেবযানী: ‘‘আজ পেছন ফিরে তাকালে মানিকদার সঙ্গে এই পত্রবন্ধুত্বের সম্পর্কটাই অবাস্তব ও আশ্চর্য বলে মনে হয়।’’
এখন সবই অলীক!
ছবি সৌজন্য: সন্দীপ রায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy