Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
প্রকৃতির আদিম সৌন্দর্য ধরা পড়েছে এক মহাকাব্যিক বিস্তারে
Review

চরিত্রগুলো যেন গ্রিক নাটক থেকে উঠে আসা

মূল মালয়ালম উপন্যাস সুফি পরঞ্জ কথা। বাংলা অনুবাদে সুফির কথা। লেখক কে পি রামানুন্নি। অনুবাদক কৃষ্ণেন্দু ঘোষ।

তৃষ্ণা বসাক
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ ০২:৩৭
Share: Save:

কত দিন পরে আবার আমার অক্ষরের উপর সন্ধে নেমে এল। কত দিন পরে একটা উপন্যাস পড়ে ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। কত দিন পরে একটা আখ্যান সীমায়িত স্পেস থেকে উত্তীর্ণ করল মহাজাগতিক অসীমে।

মূল মালয়ালম উপন্যাস সুফি পরঞ্জ কথা। বাংলা অনুবাদে সুফির কথা। লেখক কে পি রামানুন্নি। অনুবাদক কৃষ্ণেন্দু ঘোষ।

ভারত ভূখণ্ডের মানুষজন তীর্থযাত্রায় কত দূরদূরান্তে যান। কেউ বৈষ্ণোদেবী, তো কেউ অজমের শরিফ। যাঁরা অত কষ্ট স্বীকার করতে চান না, তাঁদের ভারত দর্শনের জন্যে আছে সাহিত্যের তীর্থযাত্রা। অনুবাদকেরা অজানা ভাষার রত্নরাজি খুঁজে এনে আমাদের হাতে তুলে না দিলে ভারত দর্শন অসম্ভব ছিল। আমরা জানতেই পারতাম না, ঘরের কাছে যে আরশিনগর, তার পড়শিদের সুখদুঃখ, রীতি-রেওয়াজ, উৎসব, সর্বোপরি চিন্তাবিশ্বের খবর। অনুবাদ-সাহিত্য আসলে সিন্ধুদর্শনের বিন্দু।

কিন্তু অনুবাদক যদি মন্দিরের পান্ডা হন, তবে দেবতার কাছে তিনি যে ভক্তকে খুব সহজেই পৌঁছে দেবেন, তা কিন্তু নয়। গর্ভগৃহে পৌঁছোনোর রাস্তাটি জটিল ও গহন। সোর্স ল্যাঙ্গোয়েজ থেকে টার্গেট ল্যাঙ্গোয়েজে পৌঁছোনোর এই যাত্রাটাকেই তো রাধার অভিসার বলেছেন প্রখ্যাত মালয়ালম কবি কে সচ্চিদানন্দন।

মনে আছে, সাহিত্য অকাদেমিতে কর্মসূত্রে তাঁকে এক বার নিয়ে যেতে হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবাদচর্চা বিভাগে। বাইরে তখন ঘোর বৃষ্টি পড়ছে। আর সচ্চিদানন্দন বোঝাচ্ছেন, নীল শাড়ি পরে রাধা চলেছেন কৃষ্ণের কাছে, পিছল পথ, ঘনঘোর বৃষ্টি, আকাশ চিরে চিরে যাচ্ছে বিদ্যুৎরেখা। সেই আলোয় পথ বুঝে বুঝে যাওয়া। রাধা কৃষ্ণের কাছে আদৌ পৌঁছতে পারবেন কি না জানা নেই, কিন্তু তাঁর অভিসার অন্তহীন। এই হচ্ছে অনু-বাদ।

শিকড়: মোপলা কুলদেবী চিরাক্কাল ভগবতীর মন্দির, ত্রিশূর, কেরল।

অন্য ভারতীয় ভাষাগুলির মতোই মহাকাব্য, শৃঙ্গার ও ভক্তি পেরিয়ে মালয়ালম ভাষা উনিশ শতকে এসে খুঁজে পেল তার আধুনিক স্বর, যার পত্তন বিখ্যাত ত্রয়ীর হাতে: কুমারন আসান, উল্লুর এস পরমেশ্বর আয়ার ও বল্লথোল নারায়ণ মেনন। এই আদিযুগ থেকে আধুনিক যুগ, পরে উত্তর-আধুনিকতায় মালয়ালম গদ্য-সাহিত্যের যে বিবর্তন, তার স্থপতি অনেকেই। তবে সর্বাধিক পরিচিত মুখগুলি অবশ্যই বৈকম মহম্মদ বশির, তাকাশি শিবশঙ্কর পিল্লাই, এম মুকুন্দন, কমলা দাস (বা সুরাইয়া) প্রমুখ। এঁদের সৃষ্টির জগৎটি অতি বিচিত্র। তাকাশি শিবশঙ্কর পিল্লাইয়ের চেম্মিন (চিংড়ি)-এর প্রান্তিক মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এম মুকুন্দনের মায়াঝি নদীর ধারে-র ফরাসি উপনিবেশের মানুষ জনের আশমান-জমিন তফাত। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের সহাবস্থানের জটিল মেট্রিক্স, দীর্ঘ কমিউনিস্ট শাসন, বিদেশি উপনিবেশ— এমন অগণন উপাদান মালয়ালম সাহিত্যকে এক অসামান্য উচ্চতা দিয়েছে।

এই ধারারই সুযোগ্য উত্তরসূরি কে পি রামানুন্নি। ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক কে পি রামানুন্নির জন্ম ১৯৫৫ সালে, কেরলের পোন্নানি জেলায়। চাকরি ছেড়েছেন সাহিত্যের টানে। সুফি পরঞ্জ কথা-র জন্যে কেরলের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন ১৯৯৫ সালে। তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাস পেয়েছে বায়লার পুরস্কার।

সুফির কথা
কে পি রামানুন্নি
(ইংরেজি থেকে বাংলা: কৃষ্ণেন্দু ঘোষ; মালয়ালম থেকে ইংরেজি: এন গোপাল কৃষ্ণন ও আর ই এশার)
প্যাক্স পাবলিশার্স, ২০১৪

এ এক আশ্চর্য উপন্যাস। শিবরাম চক্রবর্তীর ‘দেবতার জন্ম’ গল্পে একটি পাথর কেমন ভাবে দেবতার মান্যতা পেল, দেখানো হয়েছে। ভঙ্গিটা ছিল স্যাটায়ারের। কিন্তু সুফির কথা-র বিস্তৃতি মহাকাব্যিক বললে অত্যুক্তি হবে না। গ্রিক নাটকের মতো চরিত্রেরা যে শুধু নিয়তিতাড়িত তা নয়, তাদের জীবন প্রকৃতির আদিম শক্তি ওযৌনতা নিয়ন্ত্রিত। প্রকৃতি ও যৌনতার ক্ষমতা, শ্বাসরোধকারী সৌন্দর্য আর তার সঙ্গে জাদুবাস্তবতা উঠে এসেছে পাতায় পাতায়।

মেলিপুল্লারথ পরিবারে নবজাতিকা দেবতুল্যা কার্তির জন্ম কোনও সাধারণ ঘটনা নয়— তার জন্ম-মুহূর্তেই যেন জেনে যান মামা শঙ্কু মেনন। এই পরিবারটির আদিপুরুষ তো ব্রাহ্মণ ও অন্ত্যজ কন্যার অতর্কিত মিলনে জন্ম নেওয়া বালক। সেই রক্তের আদিম টানেই মালাবার অঞ্চলের মোপলা, অর্থাৎ মুসলমান বণিক মামুট্টির সঙ্গে ঘর ছাড়ে কার্তি, সে ইসলাম ধর্ম নেয়, কিন্তু কার্তির রক্তে কখন যে জেগে ওঠে তাদের কুলদেবী চিরাক্কাল ভগবতী। যেমন মোপলা সম্প্রদায়ের ধর্মনেতা আভারুমুসালিয়ার ঘুমের মধ্যে হয়ে যান কাফের।

কার্তির ইচ্ছায় নিজেদের বাড়ির উঠোনে দেবীর মন্দির করে দেয় মামুট্টি। আর সে ক্রমে হয়ে পড়ে নিজের সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন। কার্তিকে সে আর ভালবাসতে পারে না। এ দিকে একা কার্তি সেই সম্প্রদায়ের মেয়েদের কাছে হয়ে ওঠে পরিত্রাতা, এক জন দেবী। এই দেবী হওয়ার ভয়েই সে ঘর ছেড়েছিল, এখানে তার নিয়তি সেই দিকেই ঠেলে তাকে। মামুট্টি যন্ত্রণা এড়াতে একটি তরুণের শরীরে আকৃষ্ট হয়। কার্তি সেই তরুণকে প্রলুব্ধ করে জলে ডুবিয়ে দেয়, তার পর সে সমুদ্রে তলিয়ে যায়। গভীর রাতে মাছ ধরে ফেরা মুসলমান জেলেদের প্রাণ বাঁচিয়ে দেয় এক দেবী, তারা তীরে এসে দেখে এক নগ্ন নারীর দেহ, যে তাদের নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছে। তারা পরম শ্রদ্ধায় তাকে সমাধিস্থ করার পর দেখল, ভূমি ক্রমে উঁচু হচ্ছে।

তারা সারা রাত পাহারা দিল তাদের ত্রাণকর্ত্রী সেই ‘বিভী’কে, আর সমুদ্রকে গালি দিয়ে গাইল— “ওরে সাগর ওরে মা/ যত পারিস ময়লা খা/ তুই খানকী মায়ের নোংরা মেয়ে/ জীবন কাটাস নেচে গেয়ে”। এই ‘বিভী’ই ডুবিয়ে মারল মৌলবাদী নেতা সৈদুমল্লাকা ও তাঁর সঙ্গীদের। তারা দেখল, গভীর সমুদ্রে এক নগ্ন নারী মূর্তি। “ভয়ঙ্কর এক ত্রাস মিশ্রিত বিস্ময়ের সঙ্গে তারা দেখল সেই একই মুখ, সেই একই নগ্ন দেহ— বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন দিকে, বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে। তার বক্ষের ও কাঁধের সৌন্দর্যের ঝলকানি তাদের চোখে মনে হল যেন এক বিদ্যুতের ঝলক।”

কৃষ্ণেন্দুকে ধন্যবাদ, এই অসাধারণ উপন্যাসটি বাঙালি পাঠককে উপহার দেওয়ার জন্য, যা ভারতের মতো দেশের ধর্মজিজ্ঞাসার মূলে আমাদের নিয়ে যায়, আর হয়ে ওঠে সব বিভেদের ঊর্ধ্বে চিরায়ত মানবের এক মহান আলেখ্য।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy