Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Book Review

অনেক চিন্তা ও শ্রমের ফসল

বিজন ঘোষাল সঙ্কলিত ও সম্পাদিত রবীন্দ্রসৃষ্টির সাতমহল, প্রথম খণ্ড (অ-ণ), ব‌ইটি সাহিত্যের ঐতিহাসিকের পথ অনুসরণ করে লেখা।

রামকুমার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৪ ০৬:৩৩
Share: Save:

১৯৩৯-এর মাঝামাঝি রবীন্দ্র রচনাবলী-র প্রথম খণ্ড প্রকাশের কাজকর্ম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করা হল ব‌ইটির একটি ভূমিকা লেখার জন্য। তিনি ৩০ জুন শ্রীনিকেতনে বসে সে ভূমিকা লিখলেন। সেখানে বললেন যে, তাঁর গদ্য পদ্য ইত্যাদি সঙ্কলনের দায়িত্ব থেকে তিনি মুক্তি নিয়েছেন কারণ এটিকে সব শ্রেণির সাহিত্যবিচারকদের মনের মতো করে তোলা তাঁর ক্ষমতার বাইরে। পরের অনুচ্ছেদে আর‌ও নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করলেন যে, সাহিত্যিক আর সাহিত্যের ঐতিহাসিকের সম্বল ও সম্পত্তি এক জাতের নয়। ইতিহাস সব কিছু মনে রাখতে চায় আর সাহিত্য অনেক কিছুই ভোলে।‌ উদাহরণ দিতে গিয়ে মহাকাশকে ব্যবহার করলেন। বললেন, রাতের আকাশে যে উজ্জ্বল গ্রহতারাগুলি দেখা যায়, ওগুলিকেই সাহিত্যের শেষ বিচারে স্রষ্টা মান্যতা দিতে চায়। অন্য দিকে ‘সাহিত্যের ঐতিহাসিক’ হল জ্যোতির্বিজ্ঞানী, যে আকাশের বাষ্প, নক্ষত্র, ফাঁক, কোনওটাকেই বাদ দিতে চায় না।

বিজন ঘোষাল সঙ্কলিত ও সম্পাদিত রবীন্দ্রসৃষ্টির সাতমহল, প্রথম খণ্ড (অ-ণ), ব‌ইটি সাহিত্যের ঐতিহাসিকের পথ অনুসরণ করে লেখা। রবীন্দ্রনাথ নিজে যে তাঁর লেখা শ্রেণিবদ্ধ করার কাজে হাত দেননি, তা নয়। গীতবিতান-এর প্রথম প্রকাশের বিন্যাস রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয়নি আর তাই ‘ভাবের অনুষঙ্গ রক্ষা করে’ তিনি নতুন করে সাজালেন। তবে এই ভাবের বাইরে আর‌ও অনেক ভাবনা থেকে যায়, যা সাহিত্যের সঙ্কলক ও সম্পাদকেরা পালন করেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তা আর‌ও বেশি জরুরি তাঁর বৈচিত্র ও ব্যাপ্তির কারণে। তিনি নিজের যে সৃষ্টিকে তাঁর স্বভাবসুলভ কৌতুকে ‘এতো পরিক্ষিপ্ত ও অতি পরিমাণ’ বলে উল্লেখ করেছেন, সেই সুবিশাল সৃষ্টিকে এক নতুন বিন্যাসে বিজন তাঁর ব‌ইটিতে ধরতে চেয়েছেন। ‘সাতমহল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথের ব্যাপকতা ও গভীরতা বোঝাতে। কবিতা, নাটক ইত্যাদির পাশাপাশি তিনি চিঠিপত্র, ছবি, গান, কথোপকথন ইত্যাদিকেও যুক্ত করেছেন।

অভিধানের মতো বর্ণানুক্রমিক ভাবে শিরোনামভিত্তিক ব‌ইটিকে বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রতিটি অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে মিলেছে বেশ কিছু জরুরি তথ্য। যেমন, অন্তর্ভুক্ত বিষয়টি কবিতা, প্রবন্ধ, গান, চিঠি, ছবি না কি অন্য কিছু। ‘শিরোনাম’ বিষয়টি অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে কিছুটা জটিল। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, নাম ব্যাপারটা লাউয়ের বোঁটার মতো ধরার সুবিধার জন্যে দেওয়া। বেশ কিছু ক্ষেত্রে তিনি সে বোঁটাটি রাখেননি। কখন‌ও পত্রিকার সম্পাদককে নাম ঠিক করার দায়িত্ব দিয়েছেন। যেমন শিশু কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির কথা বলা যায়। ছবির ক্ষেত্রেও এ‌ই নামহীনতা বারে বারেই দেখা গিয়েছে। আবার পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার নাম ব‌ই করার সময়ে বদলে দিয়েছেন। আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে এক‌ই নামে একাধিক কবিতা, প্রবন্ধ, গান, ভাষণ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে। যেমন ‘আহ্বান’, ‘উদ্বোধন’, ‘প্রশ্ন’ ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথের নামে বেশ কয়েকটি ব‌ই প্রকাশিত হয়েছে, যদিও সে সব ব‌ই তিনি লেখেননি। তাঁর মৃত্যুর পর অন্যের উদ্যোগে বিষয়ভিত্তিক লেখাগুলি সঙ্কলিত হয়ে একটি নাম পেয়েছে। আবার রবীন্দ্রনাথের সময়ে কিছু ব‌ইয়ের পরিকল্পনা করা যদিও পরে সব ক’টি প্রকাশিত হয়নি। যেমন আশ্রমের আয় বাড়াতে বিয়েতে উপহারের উপযোগী ‘বরণডালা’ নামের একটি সঙ্কলনের পরামর্শ রবীন্দ্রনাথকে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি প্রকাশিত হয়নি। বিজন ঘোষাল এই রকম ব‌ইয়ের কোনটি প্রকাশিত হয়েছে আর কোনটি হয়নি, সে তথ্য‌ও দিয়েছেন।

তিনি দ্বিতীয় যে জরুরি কাজটি করেছেন সেটি হল, এক‌ই শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত রচনার এক বা একাধিক পাণ্ডুলিপির উল্লেখ এবং তার সঙ্গে মুদ্রিত লেখার পাঠভেদের বিষয়টি তুলে ধরা। এক‌ই সঙ্গে পত্রিকায় মুদ্রিত লেখাটি ব‌ই হিসাবে প্রকাশের সময় রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত যোগ ও বিয়োগ ঘটিয়েছেন, তার‌ও ইঙ্গিত দিয়েছেন। যেমন ১৩১৮ সালের আশ্বিনে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত অচলায়তন নাটকটি সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, পাণ্ডুলিপিতে গানের সংখ্যা ২৩টি থাকলেও ব‌ই হিসাবে প্রকাশের সময় তিনটি গান বর্জন এবং একটি গান সংযোজন করা হয়েছে। নাটকটি বিষয়ে আর্য্যাবর্ত্ত পত্রিকায় ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অক্ষয়চন্দ্র সরকারের বিরূপ মতামতের‌ও প্রসঙ্গ টেনেছেন। তবে পাঠকেরা যদি জানতে চান সে দিন সমালোচকেরা নাট্যকারের জন্য কতখানি ‘অশীতলভোগ’ বরাদ্দ করেছিলেন, তা হলে বিশ্বভারতী প্রকাশিত অচলায়তন নাটকের গ্রন্থপরিচয় পড়তে হবে।

কোন‌ও কোনও লেখার ক্ষেত্রে কার অনুরোধ বা কিসের উপর ভিত্তি করে লেখাটি তৈরি হল, তার উল্লেখ রয়েছে। যেমন ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ লেখেন অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীর অনুরোধে এবং তাঁর‌ই পাঠানো একটি লেখা পড়ে। তেমন‌ই ‘কন্যাবিদায়’ কবিতাটি যে নন্দলাল বসু অঙ্কিত ছবি অবলম্বনে লেখা, সে তথ্য উল্লেখ করেছেন। খাপছাড়া-র ২০ সংখ্যক কবিতার অলঙ্করণে ব্যবহৃত ‘কবি আধুনিক’ ছবিটি বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত সে ছবির পরিগ্রহণ সংখ্যার উল্লেখ করেছেন এবং সহজলভ্য ইংরেজি রবীন্দ্র চিত্রাবলি-র কোন খণ্ডে এবং কত সংখ্যক প্লেটে ছবিটি দেখা যাবে, সে তথ্য‌ও দিয়েছেন।

ব‌ইটিতে গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য ও গীতালি ব‌ই তিনটির গানগুলি নিয়ে আলাদা ভাবে তথ্য রয়েছে। কোন গান কোন পর্যায়ের, স্বরবিতান-এর কোন খণ্ডে পাওয়া যাবে, প্রথম কোথায় এবং কত সালে প্রকাশিত হয়, স্বরলিপি কার করা ইত্যাদি নানা বিষয় জানানো হয়েছে। যে সব গান কোন‌ও নাটক বা গীতিনাট্যে ব্যবহৃত হয়েছে, তার‌ও উল্লেখ রয়েছে। অনেক গানের ক্ষেত্রে রাগ ও তালের কথাও আছে। আর আছে যে সব গান রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি অনুবাদে নানা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তার‌ও তারিখ-সহ অন্যান্য তথ্য। যেখানে অনুবাদের অংশ বিশেষ কোনও লেখায় ব্যবহার করা হয়েছে, তা-ও জানিয়েছেন ব‌ইটির সঙ্কলক ও সম্পাদক। বিশেষ কোনও কবিতা বা গানকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি কিছু সমালোচকের মতামতও উদ্ধৃতি-সহ দেওয়া হয়েছে। বিগত দু’দশকে প্রকাশিত একাধিক ব‌ইয়ের কিছু ভুল তথ্য তুলে ধরেছেন লেখক। জ্ঞানচর্চার অন্যতম কাজ‌ই হল ভুল তথ্যের সংশোধন এবং নতুন তথ্যের সংযোজন।

ব‌ইটি ৫৬৮ পৃষ্ঠার আর আকারে রাজসংস্করণ। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে আলোচনা ও গবেষণার কাজ চলছে উনিশ শতক থেকেই। কিছু মানুষ প্রায় সারা জীবন‌ই রবীন্দ্রচর্চায় ব্যয় করেছেন। রবীন্দ্রচর্চার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল তথ্য। বিষয়টিতে সাহিত্যের তেমন রস মেলে না বলে অনেক সে কাজে উৎসাহ পান না। তবুও কিছু মানুষ নানা উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্পাদনার কাজ করেছেন। এই কাজকে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছিলেন ‘দুঃখসাধ্য’ বলে। তেমন‌ই চার জন বিশিষ্ট গবেষক ও তথ্যভান্ডারিকে— পুলিনবিহারী সেন, কানাই সামন্ত, চিত্তরঞ্জন দেব এবং বাসুদেব মাইতি— বিজন ঘোষাল তাঁর ব‌ইটি উৎসর্গ করেছেন। প্রথম দু’জনের নাম পাঠকমহলে বিশেষ পরিচিত হলেও শেষ দু’জন তেমন নন। কিন্তু বর্তমান ব‌ইটির ক্ষেত্রে শেষ দু’জনের কথা স্মরণ করা বিশেষ জরুরি ছিল, কারণ ১৯৬২ সালে বিশ্বভারতী গবেষণা গ্রন্থমালায় এঁরাই প্রকাশ করেছিলেন রবীন্দ্র-রচনা-কোষ। সে ব‌ইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত আর একটি ব‌ইয়ের কথাও মনে পড়ে। সেটি হল সোমেন্দ্রনাথ বসুর লেখা রবীন্দ্র অভিধান। এক বছরের সামান্য এ দিক-ও দিক ব‌ই দু’টির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাপত্র নিয়ে বিজন ঘোষাল দীর্ঘ সময় কাজ করছেন।রবীন্দ্রসৃষ্টির সাতমহল পড়লেও বোঝা যায় যে এটি কোন‌ও তাৎক্ষণিক কাজ নয়। এর পিছনে অনেকখানি চিন্তা ও শ্রম আছে। ব‌ইটি পাঠক ও গবেষকদের বিশেষ কাজে লাগবে বলেই মনে করি। দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হলে কাজটি সম্পূর্ণতা পাবে।

রবীন্দ্রসৃষ্টির সাতমহল, প্রথম খণ্ড

বিজন ঘোষাল

৯০০.০০

লালমাটি

অন্য বিষয়গুলি:

Rabindranath Tagore Author
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy