বিজয়ী: পলাশির যুদ্ধ-শেষে রবার্ট ক্লাইভ ও মিরজাফর, শিল্পীর চোখে। উইকিমিডিয়া কমনস
ভারতবর্ষ হোক বা বাংলা, আঠারো শতক তো এক গোলকধাঁধাই। দুটো দল। এক দলের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলার ভিতরকার আর্থ-রাজনৈতিক সঙ্কটই অনিবার্য ভাবে ব্রিটিশকে এখানে নিয়ে এল। ষড়যন্ত্রের সূচনা ও পরিণতিতে নাকি ক্লাইভ দলের কোনও ভূমিকাই ছিল না। যে কারণে রজত কান্ত রায় বলেছিলেন, পলাশির যুদ্ধের পিছনে ছিল মুর্শিদাবাদের রাজপুরুষদের ষড়যন্ত্র। ১৭৫৬-তে কলকাতা থেকে ব্রিটিশ বণিকরা বিতাড়িত হলে দেশীয় বণিকরা অস্থির হয়ে ওঠেন, যার পরিণতি পলাশি। ক্রিস্টোফার বেলি বা পিটার মার্শালদের বক্তব্যও ছিল এই রকমই।
সম্পূর্ণ ভিন্ন বক্তব্য অন্য গোষ্ঠীর— প্রয়াত ইতিহাসবিদ সুশীল চৌধুরী যে বর্গের ছিলেন। আঠারো শতকের সূচনায় বাংলার নবাবরা ছিলেন স্বাধীন। এখানে তুলনামূলক ভাবে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ছিল, বাণিজ্যের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এশিয়া ও ইউরোপ থেকেও বণিকরা এসেছিলেন। নবাবের নেতৃত্বে ব্যাঙ্কার, বণিক বা জমিদাররা এক সহযোগিতামূলক অংশীদারি গড়ে তুলেছিলেন। আর এই সমৃদ্ধিই হয়ে দাঁড়ায় তার কাল। এর আকর্ষণেই ইউরোপীয়রা তাঁদের লেখাপত্রে বাংলা জয়ের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন বহু আগেই।
সুশীলবাবুর বক্তব্য, ব্রিটিশের বাংলা জয় মোটেই আকস্মিক নয়। এই সমৃদ্ধির টানেই তারা রীতিমতো ছক কষে মাঠে নামে।
সমৃদ্ধি থেকে অবক্ষয়: অষ্টাদশ শতকে বাংলা
সুশীল চৌধুরী, অনু: সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায়
আনন্দ
প্রাক্-পলাশি বঙ্গীয় অর্থনীতির এমন বিস্তারিত ও সমৃদ্ধ আলোচনা আগে বড় একটা পাওয়া যায়নি। এটাই এ বইয়ের প্রধান আকর্ষণ, অধ্যাপক চৌধুরীর মূল গ্রন্থ থেকে আটাশ বছর পর যা অনূদিত হল। তিনি মনে করেন না যে, মধ্য-অষ্টাদশ শতকেও বাংলায় অর্থনৈতিক সঙ্কট ছিল। বণিকরাও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েননি। আর ইংরেজ বণিকরাই যে পণ্য কিনতে রুপোর মুদ্রা নিয়ে এসেছিলেন এমনও নয়। আরও লিখেছেন, মরাঠা আক্রমণের কারণে বাংলার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের তত্ত্বও অতিরঞ্জিত। অন্য দিকে, সতেরো শতকের শেষ থেকে আঠারো শতকের প্রথমার্ধের নথিতে বাংলায় তাঁতিদের দারিদ্রও তাঁর মতে ‘তথাকথিত’: বস্ত্রের বিপুল চাহিদা ও তাঁতিদের দরাদরির সঙ্গে তা মেলানো যায় না। তাই তাঁর প্রশ্ন, এই দারিদ্র কি শুধুই ‘ছল’? বাস্তব নয়? দীর্ঘ দিন ধরে যে বাংলা ছিল ‘জিন্নত উল বিলাদ’— সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশ, আঠারো শতকের প্রথমার্ধেও যা অটুট ছিল— সেই সোনার বাংলাই পলাশি-উত্তর পর্বে হল চরম আর্থিক অবক্ষয় আর বিপর্যয়ের শিকার।
এর পাল্টা বক্তব্যও এসেছে। শতকের শেষে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতার কারণে স্থানীয় স্তরে কোথাও কোথাও অবক্ষয়ের উল্লেখ করেও তিলোত্তমা মুখোপাধ্যায়ের মতো গবেষকরা বলছেন, দেশীয় বণিকদের অনেকেই শুধু যে টিকে রইলেন তা নয়, রীতিমতো ফুলেফেঁপেও ওঠেন নতুন পরিস্থিতির উপযুক্ত ব্যবহার করেই। আর ওই তাঁত শিল্পের অবক্ষয়জনিত আর্থিক সমস্যা ১৮২০-র আগেও হয়নি বলে তাঁদের মত। ১৭৫৮-তেই তো আর হঠাৎ করে অবক্ষয় আসেনি। ১৭৭০-এ লেখা তীর্থ-মঙ্গল-এও তো বিজয়রাম সেন ভগবানগোলা হাটে ‘চারি ক্রোশ গোলাহাট’-এর কথা লিখে গিয়েছিলেন, যেখানে ‘সাখারি কাঁসারি তাঁতি আছয়ে বিস্তর’। লিখেছেন ‘চারি ক্রোশ’ জুড়ে সমৃদ্ধ শহর কাশিমবাজারের কথা, ‘কতেক বাজারে’ ভরা কাটোয়ার কথা— ‘অপূর্ব্ব সহরখান’। পরে কী দশা হয় সেটাই আসল, আর সেটাই তো সুশীল চৌধুরীর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল।
রাজেন্দ্রলাল মিত্র
অলোক রায়
৫০০.০০
অক্ষর প্রকাশনী
পরের ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে শোষণ আছে, দুর্ভিক্ষ, অর্থসঙ্কট আছে আবার আন্দোলন আর বিদ্রোহও আছে। পশ্চিমি ভাবাদর্শে প্রাণিত হয়েই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প আছে। রাজা প্রজা-তে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করে লিখেওছিলেন সে কথা: “ইংরাজের সহিত সংঘর্ষ আমাদের অন্তরে যে একটি উত্তাপ সঞ্চার করিয়া দিয়াছে তদ্দ্বারা আমাদের মুমূর্ষু জীবনীশক্তি পুনরায় সচেতন হইয়া উঠিতেছে।” সাদা চামড়ার শাসকের সামনে নিজের সমৃদ্ধ অতীত তুলে ধরাটা যে তখন জরুরি হয়ে পড়েছিল। তাঁর কথায়, ‘ধিক্কারের প্রতিঘাত’। এ কারণেই অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-র ঐতিহাসিক চিত্র পত্রিকা রবীন্দ্রনাথের কাছে মনে হয়েছিল ‘স্বদেশী কারখানা’। প্রাচীন ভারতবর্ষকে আবিষ্কারের নেশা যাঁদের গ্রাস করেছিল, রাজেন্দ্রলাল মিত্রর অবস্থান তাঁদের প্রথম সারিতেই। ভারতীয় স্থাপত্য-ভাস্কর্যের ইতিহাস চর্চায় তাঁর ভূমিকা ঐতিহাসিক বলেই স্মরণ করিয়েছেন অভ্র ঘোষ, চুয়ান্ন বছর পর অলোক রায়ের গবেষণাগ্রন্থ রাজেন্দ্রলাল মিত্র-র প্রথম পুনর্মুদ্রণটির ‘সূচনা-কথা’য়।
জীবনস্মৃতি-তে রবীন্দ্রনাথ যাঁকে সব্যসাচী বলে উল্লেখ করেছিলেন, সেই রাজেন্দ্রলালের জন্ম ১৮২২-এ। ১৮৪৬-এ এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারিক ও সহ-সম্পাদক থেকে এক সময় সভাপতি পদেও পৌঁছন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি হন। সম্পাদনা করেছেন বিবিধার্থ সংগ্রহ ও রহস্য সন্দর্ভ পত্রিকা। ছিলেন হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার অছিও। ইতিহাসচর্চা, বলা ভাল ভারতবিদ্যাচর্চা, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় রাজেন্দ্রলালের অবদান ও তাঁর জীবনকথার দীর্ঘ আলোচনাসমৃদ্ধ এ বইয়ের ‘পূর্বাভাষ’-এই অলোক রায় তাঁকে নবজাগরণের উৎকৃষ্ট ফসল হিসাবে তুলে ধরেছেন। রাজেন্দ্র-বান্ধব থিয়োডোর ডুকা-র এক মূল্যবান প্রবন্ধও সংযোজিত করেছেন। অলোকবাবুর আক্ষেপ, রাজেন্দ্রলালকে বাঙালি মনে রাখেনি। আসল কথাটা তো রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর কিছু কালের মধ্যেই বিদ্যাসাগরের প্রয়াণই তার মূলে। আর একটা কারণ বাংলা ভাষায় তাঁর ‘কীর্ত্তি অধিক ছিল না’।
নবজাগরণের উৎকৃষ্ট ফসল রাজেন্দ্রলাল বিধবাবিবাহের বিরোধিতা করেন। বহুবিবাহের বিপক্ষে প্রথমটা গেলেও পরে সরে আসেন। তবে এ স্ববিরোধিতা তো উনিশ শতকে অনেকেরই ছিল। স্বদেশীয় ভারতবিদ্যা সাধক রাজেন্দ্রলালের ‘প্রদেশবোধ’ও কম ছিল না— ১৮৬৮-তে কটকে গিয়ে বলে এসেছিলেন, ওড়িয়া ভাষা তুলে না দিলে ওড়িশার কোনও উন্নতি হবে না। পরিণতি অনুমেয়। তবে, ওড়িয়া আত্ম-অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় তাঁর দু’খণ্ডে লেখা দ্য অ্যান্টিকুইটিজ় অব ওড়িশা বইটির মূল্য অনেক।
তবে, রাজেন্দ্রলালের আগে এখানে ভারতীয়রা ইতিহাসচর্চা শুরু করেননি— এটি ঠিক তথ্য নয়। বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক ইতিহাসই তো লেখা হয়ে গিয়েছিল, কালীকমল সার্বভৌমের সেতিহাস বগুড়ার বৃত্তান্ত বা শ্যামধন মুখোপাধ্যায়ের মুর্শিদাবাদের ইতিহাস-এর মতো। তবে, তাঁর “একক প্রয়াস প্রচেষ্টা পরবর্তীকালের ভারতবর্ষে ঐতিহাসিক গবেষণার পথ প্রস্তুত করে দেয়”— এ তথ্যে কোনও ভুল নেই। পুনর্মুদ্রণটির গরিমা আরও বৃদ্ধি করেছে অভ্র ঘোষের ‘সূচনা-কথা’টি। এ-যাবৎ রাজেন্দ্রলালকে নিয়ে যা যা লেখাপত্র প্রকাশিত হয়েছে তার উল্লেখও মূল্যবান। সেখানে তাঁর ‘ফটোগ্রাফি চর্চা’র প্রসঙ্গও আছে, গবেষকদের যা সহায়ক হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy