ভয়ঙ্কর: উনিশ শতকে আঁকা সতীদাহের ছবি। উইকিমিডিয়া কমনস
রামমোহন রায় চর্চা করেননি, এমন বিষয় খুঁজে পাওয়া কঠিন। ইতিহাস, অর্থনীতি, জাতীয়তাবোধ, আন্তর্জাতিকতা, রাষ্ট্রনীতি, সমাজ, দর্শন, ধর্ম, বাংলা ভাষা, ভূমি রাজস্ব, শ্রমিক সমস্যা ও কৃষি, সাংবাদিকতা, আইন, এমনকি সঙ্গীতও— তাঁর আগ্রহ এবং অধিকারের তালিকা অতি দীর্ঘ। আলোচ্য গ্রন্থটি তাঁর এই সর্বব্যাপী পদচারণাকে ধরতে বহু দূর সক্ষম হয়েছে। বইটি তিনটি বিভাগে বিভক্ত— রামমোহন রায়ের লেখা, তাঁর বিষয়ে বিভিন্ন লেখার পুনর্মুদ্রণ এবং বর্তমান কালের লেখা। এই আলোচনা মূলত সীমাবদ্ধ রাখব তৃতীয় বিভাগটিতেই, কারণ অন্য রচনাগুলির অধিকাংশই বহুপঠিত এবং বহু-আলোচিত। বর্তমান কালের লেখাগুলিতে রামমোহনের যে দিকগুলি আলোচনায় এসেছে, তা হল— রামমোহনের সমাজ সংস্কার, ধর্ম বিষয়ক আলোচনা, আইন, বাংলা ভাষা, রামমোহনের অনুবাদকর্ম, সঙ্গীত, নারীচিন্তা, সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, এবং তাঁর বিজ্ঞানভাবনা।
রামমোহনের আমৃত্যু প্রয়াস ছিল অচলায়তন থেকে এই সমাজকে মুক্ত করার, যার বিভিন্ন দিক প্রবন্ধকারদের লেখায় ফুটে উঠেছে। স্বাতী গুহ রামমোহনের সংস্কার-প্রয়াস বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, বর্তমান কালের নারী নির্যাতন প্রমাণ করে যে, আমরা তাঁর প্রচেষ্টার মূল্য আজও দিতে পারিনি। অনিতা অগ্নিহোত্রী লিখেছেন, ভারতকে বিশ্ববিপ্লবের অঙ্গ হিসেবে দেখতেন রামমোহন, এবং সেই কারণেই তিনি খুঁজেছিলেন বিশ্বের নানা দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের চেষ্টার অন্বয়। আধুনিক সংসদীয় ব্যবস্থা যদি সমাজ সংস্কারের প্রক্রিয়ার অঙ্গ হয়, তবে শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। যখন আইনসভার সদস্যদের আচরণে আমরা বিরক্ত, বীতশ্রদ্ধ, তখন মনে হয় যে, রামমোহন রাজনীতিকদের ভাষার শালীনতা, যুক্তি ও তথ্যের প্রতি নিষ্ঠা এবং তাঁদের দায়িত্বশীল হওয়ার অপরিহার্যতা বিষয়ে যা বলেছেন, তা আজও প্রবল ভাবেই প্রযোজ্য। ‘ব্যক্তির পরিচয় নয়, প্রতিনিধিত্বের পরিচয়’, এই কথাটি আজও মনে রাখা জরুরি।
সুপ্রতিম দাসের বিশ্লেষণ অংশত ঠিক, কিন্তু তিনি যুগচেতনার প্রশ্নটিকে সম্পূর্ণ অবহেলা করেছেন। একবিংশ শতক, এমনকি বিংশ শতকে দাঁড়িয়ে সমসাময়িক চেতনার ভিত্তিতে রামমোহনের সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা যায় না। ইতিহাস রচনায় যুগচেতনার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতেই হবে। রামমোহন বিষয়ে যাঁর অধিকার সর্বজনস্বীকৃত, সেই দিলীপকুমার বিশ্বাস লিখেছিলেন, “এক রামমোহন যদি ভারতের সবদিকের প্রতিভূ হন, অর্থাৎ যদি প্রশ্ন ওঠে যে তিনি এটা ও ওটা কেন লেখেননি বা আলোচনা করেননি, তবে প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঠতে পারে তিনি ফুটবল বা রাগবি বা হাডুডু নিয়ে লেখেননি কেন?”
রামমোহন ২৫০ স্মারকগ্রন্থ
সম্পা: সন্দীপন সেন
১২০০.০০
রামমোহন লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রি রিডিং রুম
পবিত্রকুমার সরকার রামমোহনের গদ্য রচনার মাধুর্যহীনতার কারণ বিশ্লেষণ করেছেন, এবং ঔপনিবেশিক আমলে তার অনিবার্যতার কারণটি নির্দেশ করেছেন। যে-হেতু ভাষার প্রয়োজন শাসনযন্ত্র বজায় রাখার জন্য, তাই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যবই রচিত হয়েছিল সিভিল সার্ভেন্ট তৈরির উদ্দেশ্যে। প্রবন্ধকার লিখেছেন যে, রামমোহনই প্রথম, যিনি বিদেশি শাসনযন্ত্রের অচলায়তন থেকে বাংলা ভাষাকে বার করে দেশবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ করালেন, এবং সেই যোগাযোগ হল লিখিত বাংলাতেই। একই সঙ্গে তিনি দেখালেন দার্শনিক তত্ত্বের বাংলাতে ব্যবহারে তাঁর অনন্যতা। পবিত্রবাবু ঠিকই লিখেছেন যে, তাঁর গদ্য রচনা সাহিত্য সৌন্দর্যের জন্য নয়, নিশ্চিত ভাবে একটি উদ্দেশ্য সাধন।
রামমোহনের বিজ্ঞানভাবনায় খাদ্য হিসাবে মাংস ও সুরাপানের প্রয়োজনীয়তা তাঁর গৃহত্যাগের অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন প্রাবন্ধিক শংকরকুমার নাথ। এই লেখায় তাঁর বিজ্ঞানবিষয়ক তিনটি বই— জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূগোল বইয়ের উল্লেখ থাকলে ভাল হত। প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন, ফ্রেনোলজি বা খুলিবিদ্যায় রামমোহনের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। স্মর্তব্য যে, লর্ড আমহার্স্টকে লেখা তাঁর চিঠিটিতে— যাকে বাংলার নবজাগরণের শঙ্খধ্বনি বলা হয়— তাঁর বিজ্ঞানচেতনার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।
সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেন যে, রামমোহনই পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি, যিনি সব ধর্মের তুলনামূলক অনুসন্ধান শুরু করেন। কোনও বিশেষ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় সৃষ্টি তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন সব ধর্মের মূল সত্যগুলির সমন্বয়সাধন। তাঁকে বুঝতে হলে তাঁর সত্তার উপাদান, গঠন ও প্রকৃতি সম্বন্ধে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। ঈশ্বরকে মাটিতে না এনে তাঁর সশ্রদ্ধ নিরাকার রূপায়ণে রামমোহনের কৃতিত্ব ছিল তাঁর সঙ্গীতরচনায়, যা সুধীর চক্রবর্তীর ভাষায় ‘বাংলা গানের নবজাগরণ’। কবিগান ও খেউড়ের পরবর্তী কালে রামপ্রসাদি বাঙালির মনে যে ভক্তির প্রবাহ এনেছিল, সেই তুলনায় তাঁর গানের প্রসার হয়নি মূলত রাগের সূক্ষ্মতা ও বিষয়ের গাম্ভীর্যের কারণে। তবে, রামমোহনের গানে যে মরমিয়া দিক আছে, তা এই প্রবন্ধটিতে অনুল্লিখিত। জীবনের কোনও নিঃসঙ্গে মুহূর্তে মন যখন কাউকে বা কোনও অজানাকে খোঁজে, তখন সেই সাধক মরমিয়াই, তা তিনি যত নিরীশ্বরবাদীই হোন।
সমাজ ও জাতীয়তাবোধের উন্মেষে অনুবাদ সাহিত্যের এক বিশাল ভূমিকা রয়েছে। ষোড়শ শতকে ইউরোপে ‘রিফর্মেশন’ আন্দোলনের সময় হিব্রু ও গ্রিক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ আনুকূল্য পেয়েছে। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখায় অনুবাদক হিসাবে রামমোহনের ভূমিকার কথা এসেছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, রামমোহনের উপনিষদ ভাষান্তরের একটি কারণ ছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের মনে শাসিতদের প্রতি সমীহের ভাব তৈরি করা, যা তিনি কঠোপনিষদের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। প্রাবন্ধিক যথার্থই লিখেছেন যে, তাঁর অনুবাদগুলি ছিল মিশনারিদের সঙ্গে রাজনৈতিক মতদ্বৈধ। তাঁর স্বধর্মীয় বাঙালি, যাঁরা মূর্তিপূজা আঁকড়ে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও সংলাপ তৈরি হয়েছিল এই অনুবাদের মাধ্যমে।
নতুন ও পুরনো লেখা একত্রে সঙ্কলন করে সম্পাদকমণ্ডলী পাঠকের সামনে রামমোহনের জীবন ও ভাবনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরার জরুরি কাজটি করেছেন। তাঁরা নিঃসন্দেহে ধন্যবাদার্হ। দু’একটি ক্ষেত্রে লেখার শ্রেণিবিভাজনে অসঙ্গতি রয়েছে, যেমন নতুন রচনা হিসাবে এমন লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা আগেই প্রকাশিত। দিলীপকুমার বিশ্বাসের মতো বিশেষজ্ঞের লেখা সঙ্কলিত না হওয়াও বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এ ছাড়া, কিছু মুদ্রণপ্রমাদ বাদ দিলে এই সঙ্কলনটি রামমোহনকে জানার পক্ষে অতি মূল্যবান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy