সমাবেশ: প্রয়াণশতবর্ষে কার্ল মার্ক্সকে স্মরণ। কলকাতা, ১৯৮৩
এ-বইয়ের শিরোনামটি দেখে, একটু বেহিসেবি চালেই, মৃণাল সেনের ছবিতে উচ্চারিত সেই অবিস্মরণীয় উক্তিটি মনে পড়ে গেল: “আকাল তো আমাদিগের সব্বাঙ্গে!” ২০১১ থেকে ২০২১— এই এক দশকে যে ‘দিশাহীন, বিবর্ণ, অস্থির, বিপদসঙ্কুল’ সময় আমাদের ঘিরে ধরল, তার অভিঘাত অনেককেই অবসাদগ্রস্ত করেছে, আমরা অনেকেই বলে চলেছি: এই অন্ধকারই তবে আমাদের নিয়তি। শোভনলাল দত্তগুপ্ত এই অভিঘাতকে নিরন্তর উপলব্ধি করেছেন, ক্রমাগত সেই উপলব্ধির কথা লিখেছেন এবং বলেছেন, কেবল মত প্রকাশের তাগিদে নয়, এই আকালের সঙ্গে লড়াই করার তাড়নায়। দুনিয়া, দেশ এবং রাজ্যের ভয়াবহ গতি ও প্রকৃতি দেখে তিনি উদ্বিগ্ন, ক্রুদ্ধ, বিমর্ষও, কিন্তু অবসন্ন নন। পাঁচটি পর্বে বিন্যস্ত চল্লিশের বেশি প্রবন্ধে এবং ষষ্ঠ পর্বে সংযোজিত চারটি সাক্ষাৎকারে এই প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর প্রজ্ঞা, যুক্তিবোধ, স্বচ্ছ ও নির্মোহ চিন্তার যে পরিচয় মেলে, তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় নতুন নয়। কিন্তু সঙ্কলনটি থেকে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল এক দুর্মর প্রত্যয়। সর্বগ্রাসী আকালের মধ্যে দাঁড়িয়ে তাকে নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণের প্রত্যয়, সেই বিশ্লেষণের জমিতে পা রেখে তার সঙ্গে লড়াই করার প্রত্যয়। এ-বই কেবল চিন্তার রসদ নয়, সেই লড়াইয়ের হাতিয়ার।
‘সমাজ ও সংস্কৃতি’, ‘মার্কসবাদ প্রসঙ্গে’ এবং ‘ইতিহাস পুনর্দর্শন’— এই তিনটি পর্বের লেখাগুলির কেন্দ্রে আছেন কার্ল মার্ক্স ও তাঁর চিন্তা। মার্ক্সীয় তত্ত্ব এবং দুনিয়া জুড়ে তার অনুশীলন ও প্রয়োগ বিষয়ে সুদীর্ঘকাল গভীর ভাবে চর্চা করে চলেছেন লেখক। দশ বছরের অবকাশে লেখা এই প্রবন্ধগুলি থেকে মার্ক্স-চর্চার ভুবনে যে নতুন জোয়ার এসেছে, তার অনেকখানি পরিচয় মেলে। ‘ভিন্নগোত্রীয়’ নামাঙ্কিত পর্বে আছে দুই প্রয়াত শিক্ষক এবং চিন্তক, রমেশচন্দ্র ঘোষ এবং অশোক সেনকে নিয়ে দু’টি মরমি লেখা। পড়তে পড়তে মনে হয়, এই আকালে এমন মানুষদের স্মৃতিচর্যার সুযোগটুকু হয়তো লেখকের মনে তাতল সৈকতে বারিবিন্দুসম স্বস্তির স্বাদ দিয়েছে। গোটা বইয়ের সবচেয়ে ভিন্নগোত্রীয় লেখাটি অবশ্য আছে প্রথম পর্বেই। ‘মার্গসঙ্গীতের সান্নিধ্যে: একটি মার্কসীয় অনুসন্ধান’ নামের এই অসামান্য প্রবন্ধটি শোভনলালবাবু ‘অনেক সাহস সঞ্চয় করে, অনধিকারচর্চার এক প্রবল ঝুঁকি নিয়ে’ লিখেছেন। এমন আরও অনেক সাহস দেখানোর এবং ঝুঁকি নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে বড় রকমের দাবি পেশ করা রইল।
আকালের ভাবনা: লেখালিখি, সাক্ষাৎকার ২০১১-২০২১
শোভনলাল দত্তগুপ্ত
৪৯৫.০০
সেরিবান
সঙ্কলনের দীর্ঘতম পর্ব ‘রাজনীতি ভাবনা’-র সতেরোটি প্রবন্ধের সিংহভাগ জুড়ে আছে ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণ, বিশেষত ফ্যাসিবাদ ও দক্ষিণপন্থার আগ্রাসী অভিযানের কালে বামপন্থী দল ও রাজনীতির সঙ্কট নিয়ে নির্মোহ বিচার। সাক্ষাৎকারগুলিতেও এই বিশ্লেষণই কিছুটা অন্য চেহারায় ফিরে আসে। পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ বামপন্থী শাসনের বিশ্লেষণে লেখকের মার্ক্সীয় চিন্তার প্রয়োগ দেখতে পাই, আবার এই মুহূর্তে বাম রাজনীতির কর্তব্য সম্পর্কেও সেই চিন্তা থেকে মূল্যবান পরামর্শ মেলে। সেই বিষয়ে দু’-একটি কথা বলা যেতে পারে।
২০১৪ সালে লেখা ‘আকালের ভাবনা’ প্রবন্ধটি কেবল এই সঙ্কলনের শিরোনাম সরবরাহ করেনি, বামপন্থার তত্ত্ব ও প্রয়োগ সম্পর্কে লেখকের ভাবনার একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্রকে পেশ করেছে। একেবারে শুরুতেই তিনি জানিয়েছেন, “বামপন্থীদের পক্ষে সত্যিই এ এক গভীর আকাল।” প্রশ্ন হল, কেন এমন দ্রুতগতিতে তাঁদের এত বড় বিপর্যয় ঘটে গেল? নানা দিক থেকে প্রশ্নটি নিয়ে বড় করে বিশ্লেষণ আছে এই প্রবন্ধে। তার একটি অংশের প্রতি এখানে বিশেষ ভাবে নজর দিতে চাই। পেশ করা যাক একটু বিস্তৃত একটি উদ্ধৃতি: “যখন এ কথা বলা হয় যে, অতীতের বাম কর্মীরা ছিলেন একনিষ্ঠভাবে পার্টির প্রতি দায়বদ্ধ এবং এক অর্থে তাঁদের সীমাহীন আত্মত্যাগ, অননুকরণীয় জীবনযাত্রা এ সবই ছিল পার্টি-নিবেদিত প্রাণেরই অভিব্যক্তি, তার মধ্যে অনুচ্চারিত থেকে যায় একটি গভীর প্রশ্ন। পার্টির আদর্শের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেবার এই যে আর্তি, তা কি এও দাবি করে না যে নিজের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি ও যুক্তিকেও পার্টির যূপকাষ্ঠে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতে হবে? বস্তুত সেটাই ঘটেছিল এবং সেই কারণে এই নমস্য মানুষদের দৃষ্টান্তমূলক আত্মত্যাগের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা ছিল পার্টির প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য এবং তার ফলে আখেরে ক্ষতি হয়েছে পার্টিরই। একনিষ্ঠ পার্টিকর্মী হিসেবে পার্টির ভুলত্রুটি, অন্যায়, অবিচার, হঠকারী অনেক সিদ্ধান্ত,— এ সব নিয়ে তাঁদের মনে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি, কারণ কমিউনিস্ট পার্টির একরৈখিক শৃঙ্খলা ও শাসন ভিন্নতার ভাবনাকে পার্টি বিরোধিতারই সমার্থক মনে করে।”
কেবল আনুগত্য নয়, প্রশ্নাতীত আনুগত্য— এই একটি বস্তু বারংবার বহু প্রতিষ্ঠানকে, বহু ব্যবস্থাকে, বহু কাঠামোকে ভিতর থেকে ধ্বংস করেছে, এই মুহূর্তেও করে চলেছে। কিন্তু ক্ষমতা ধরে রাখার আকর্ষণ বড় ভয়ানক, তাই সেই চলমান ইতিহাসের সাক্ষী থাকার পরেও, এমনকি চোখের সামনে সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং তার সর্বশক্তিমান পার্টির অকল্পনীয় পরিণতি দেখার পরেও পশ্চিমবঙ্গের শাসক বামপন্থী নেতৃত্ব ঘরে এবং বাইরে কোনও ধরনের মৌলিক ও কঠিন প্রশ্নকে স্বাগত না জানিয়ে তাকে দমন করতে তৎপর থেকেছেন। পার্টির অভ্যন্তরে বহাল থেকেছে ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র আদর্শ— অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান আদর্শ— অনুসরণের নামে কেন্দ্রিকতা দিয়ে গণতন্ত্রকে দমন করবার সর্বাত্মক তৎপরতা, যাতে কর্তাদের (কর্ত্রী প্রায় ষোলো আনা বিরল, সে দিনও, আজও) কর্তৃত্ব অটুট থাকে। আবার সমাজের সঙ্গে দলের সংযোগের ক্ষেত্রে এই কর্তৃত্বই শাসনের প্রধান আদর্শগত প্রকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। শোভনলাল দত্তগুপ্ত তাঁর একাধিক লেখায়, বিশেষত ২০১৫ সালের গোড়ায় লেখা ‘পশ্চিমবঙ্গ ২০১৪: রাজনীতির দাপট থেকে দাপটের রাজনীতি’ নামাঙ্কিত প্রবন্ধটিতে বাম-শাসিত পশ্চিমবঙ্গের আলোচনায় আন্তোনিয়ো গ্রামশির ‘হেজিমনি’ বা আধিপত্যের ধারণাটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। কিছুটা অতিসরলীকরণের ঝুঁকি নিয়েই বলা যেতে পারে, তাঁর একটি বক্তব্য হল: শ্রমজীবী তথা ‘নির্বিত্ত’ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এবং তাঁদের ক্ষমতায়নের জন্য সংগ্রাম করে বামপন্থীরা চেতনার আধিপত্য অনেকখানি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন, তার জোরেই তাঁদের রাজনৈতিক এবং নির্বাচনী সাফল্য এসেছিল। কিন্তু ক্রমশ তাঁরা ‘হেজিমনি’ থেকে ‘ডমিনেশন’ অর্থাৎ কর্তৃত্বের প্রকরণকেই ক্ষমতায় থাকার রাস্তা হিসাবে বেছে নিলেন। সেই পথে বিপদ ঘটবার কথাই ছিল, ঘটল। তাঁদেরও, পশ্চিমবঙ্গেরও।
এই কঠোর সমালোচনা থেকেই উঠে আসে ঘুরে দাঁড়ানোর সুপরামর্শ। এই পর্বের, এবং গোটা সঙ্কলনেরও, সাম্প্রতিকতম (প্রথম প্রকাশ: অক্টোবর ২০২১) লেখাটির শিরোনাম ‘পশ্চিমবঙ্গ ২০২১: বামপন্থার প্রত্যাবর্তন নিয়ে কিছু প্রশ্ন, কিছু ভাবনা’। বামপন্থী রাজনীতি ও তার অনুসারীদের জন্য স্বভাবসিদ্ধ সুশৃঙ্খলায় নিজের ভাবনাগুলি এই লেখার শেষ অংশে সাজিয়ে দিয়েছেন লেখক। তার শেষ কথাগুলি গণতান্ত্রিকতা নিয়ে, যে গণতান্ত্রিকতার অভাবে ‘বিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্র’ স্বখাতসলিলে ডুবেছে, পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী রাজনীতিও তথা এব চ। প্রত্যাবর্তন এবং পুনরুজ্জীবনের পথ ওই গণতান্ত্রিক চেতনার মধ্যেই খুঁজতে হবে। প্রবন্ধের শেষ বাক্য: “এই বিকল্প চেতনা, বিকল্প ভাবনার দিশারী হতে পারেন একমাত্র বামপন্থীরাই।” এটাই এখন তাঁদের কাছে ইতিহাসের দাবি। সেই দাবি মেটাতে চাইলে অবশ্য সর্বাগ্রে তাঁদের কৃতকর্মের জন্য অকপটে ভুল স্বীকার করতে হবে। আর, তার জন্য মন থেকে মানতে হবে যে, ‘ভুল স্বীকার করার মধ্যে কোন অন্যায় বা দোষ নেই’।
কার্ল মার্ক্স তাতে আপত্তি করবেন না। ‘স্বীকারোক্তি’ নামক খেলা খেলতে বসে ‘তোমার জীবনের আদর্শ কী’— এই প্রশ্নের উত্তরে মার্ক্স যখন বলেন ‘সব বিষয়ে সংশয়ী হওয়া’, তখন সেই সংশয় এবং প্রশ্নের আওতা থেকে নিজের মত এবং ধারণাকেও তিনি কোনও ছাড় দেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy