Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Book Review

অন্তরঙ্গ অনুবাদে ফুটে ওঠে এক ‘অপরিচিত’ কবির কবিতা-যাপন

বাংলায় অবশ্য ছিল সতীন্দ্রনাথ মৈত্র ও দিলীপ রায়ের অনুবাদের সঙ্কলন— ইংরেজির হাত-ঘোরা সে অনুবাদগুলি কবিতা হিসাবে ততটা আকর্ষক হতে পারেনি।

সব্যসাচী দেব
সব্যসাচী দেব
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:৫৮
Share: Save:

ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি ফিউচারিস্ট আন্দোলনের পুরোধা কবি, সেখান থেকে হয়ে ওঠেন সোভিয়েট বিপ্লবের চারণ। কবিতা লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন, পোস্টারকে করে তুলেছেন শৈল্পিক। তবুও পাঠক তাঁকে জানেন মূলত কবি বলেই। ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুরাগী লেনিন তাঁর কবিতা পছন্দ করতেন না, কিন্তু পাঠকের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল অসীম। স্তালিন তাঁকে বলেছিলেন ‘সোভিয়েট যুগের শ্রেষ্ঠ কবি’।

তাঁর কবিতার সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় মূলত ইংরেজি অনুবাদের সূত্রেই। বাংলায় অন্য বিদেশি ভাষার কবিদের তুলনায় মায়াকোভস্কি অনূদিত হয়েছেন খুবই কম; বলা যায় রুশ ভাষার কবিদের অনুবাদই পরিমাণে কম। এমনকি সোভিয়েট ইউনিয়নে যখন রুশ ভাষা থেকে নানা ধরনের লেখা বাংলায় অনুবাদের কাজ চলছে, তখনও কবিতা অনুবাদে ততটা নজর দেওয়া হয়নি। এক সময় ইংরেজি অনুবাদ বলতেও সম্বল ছিল কেবল হার্বার্ট মার্শালের অনুবাদ। পরে অবশ্য সোভিয়েট থেকেই মায়াকোভস্কির কবিতার নানা অনুবাদ বেরোতে থাকে, সিলেক্টেড রাইটিংস-ও প্রকাশিত হয়, ব্রিটেন বা আমেরিকা থেকেও প্রকাশিত হতে থাকে মায়াকোভস্কির কবিতা, গদ্য চিঠিপত্রের অনুবাদ।

বাংলায় অবশ্য ছিল সতীন্দ্রনাথ মৈত্র ও দিলীপ রায়ের অনুবাদের সঙ্কলন— ইংরেজির হাত-ঘোরা সে অনুবাদগুলি কবিতা হিসাবে ততটা আকর্ষক হতে পারেনি। পরে আরও কেউ কেউ ছুটকো-ছাটকা অনুবাদ করেছেন, কিন্তু মায়াকোভস্কিকে জানতে গেলে বাংলাভাষী পাঠকের মূল ভরসা ছিল নানা ইংরেজি ভাষান্তরই।

অরুণ সোম রুশ ভাষা জানেন মাতৃভাষার মতোই। এর আগে সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অনূদিত রুশ ধ্রুপদী সাহিত্যের নানা সম্ভার, রুশ সাহিত্যের বৈচিত্র ও সমৃদ্ধির সঙ্গে পাঠকের পরিচয়ের একটি বড় সূত্রই ছিল তাঁর অনুবাদ। দেশে ফিরেও তাঁর অনুবাদকর্মে ঘাটতি পড়েনি কোনও। অনুবাদক হিসাবে অরুণ সোমের একটা বড় যোগ্যতা হল, দীর্ঘ দিন সোভিয়েট ইউনিয়ন ও সোভিয়েট-উত্তর রাশিয়ায় থাকার ফলে রুশ ভাষাভাষী সমাজের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ পরিচয় ও নৈকট্য। যে কোনও সাহিত্যই নিজস্ব পরিবেশ ও সম্পর্ক থেকে গড়ে ওঠে। যদিও মায়াকোভস্কির সময় থেকে বর্তমানের রুশ সমাজ অনেকটাই বদলেছে, তবুও সেই সমাজকে অরুণ সোম খুব কাছ থেকে দেখেছেন, কেবল পুঁথি-পড়া জ্ঞান তাঁর সম্বল নয়। ফলে মায়াকোভস্কির কবিতার একান্ত রুশ অনুষঙ্গ তাঁকে কেবল অভিধান দেখে বুঝতে হয়নি, তাদের তিনি অনেকটাই চেনেন। তাঁর অনুবাদ অন্যদের চেয়ে আলাদা হবেই।

ভ্লাদিমির মায়াকোভ্স্কি: লেনিনের সাথে আমার সংলাপ ও অন্যান্য কবিতা

অনুবাদ ও অনুষঙ্গ: অরুণ সোম

৪৮০.০০

প্রতিক্ষণ

অরুণ সোম অনূদিত এই বইটির শিরোনাম বেশ দীর্ঘ— ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি: লেনিনের সঙ্গে আমার সংলাপ ও অন্যান্য কবিতা। একটি ছোট্ট ভূমিকা ছাড়া বইটির তিনটি অংশ: প্রাক্‌কথা, আমি ও অন্যান্য কবিতা, তিনটি দীর্ঘ কবিতা ও উত্তরকথা। প্রাক্‌কথাটি খুবই ছোট, সেই স্বল্প পরিসরেই মায়াকোভস্কির কবিতার ভাবনা ও বৈচিত্রের সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন অরুণ সোম, জানিয়ে দিয়েছেন ছন্দ নিয়ে মায়াকোভস্কির ভাবনার কথাও। এই প্রাথমিক পরিচয়টুকু মায়াকোভস্কির নতুন পাঠকের জন্য প্রয়োজন ছিল, কেননা অ-রুশ পাঠকের কাছে তাঁর কবিতার রীতি ও আঙ্গিক কঠিনই মনে হতে পারে। অন্য দিকে, ‘উত্তরকথা’টি একটু বড়ই, এই অংশে যে লেখাটি আছে তার নাম ‘একটি অস্থির কবিজীবনের অসংলগ্ন সমাপ্তি’। এই শিরোনামটিই মায়াকোভস্কির জীবনকে বোঝার একটি সূত্র। এ লেখাটি হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনভাষ্যও। সে জীবন খুব সরলরেখা ধরে এগোয়নি, তাঁর প্রবল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ সোভিয়েট আমলাতন্ত্রের পছন্দ হয়নি, তাঁর প্রতিভা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল সোভিয়েট লেখক সঙ্ঘের প্রতিভাহীন অলেখক কর্মকর্তাদের কাছে। লেখকজীবনের এই প্রতিকূলতার পাশাপাশি ছিল তাঁর অস্থির প্রেম, একের পর এক নারীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছিলেন তিনি। অরুণ সোম-কৃত ‘উত্তরকথা’য় তাঁর জীবনের এই সব ঘাত-প্রতিঘাতই ধরা পড়েছে। মায়াকোভস্কির কবিতাকে বুঝতে হলে তাঁর এই যাপনকেও বোঝা দরকার, কেননা বিপ্লব ও প্রেম, এই দুই-ই হল তাঁর কবিতার মূল প্রেরণা। আর এই জীবনকথাতে ধরা পড়ে সেই সময়ের সোভিয়েট শিল্প-সাহিত্য জগতের অভ্যন্তরীণ নানা টানাপড়েনও, সেই ইতিহাসটুকুও পাঠকের পক্ষে জরুরি।

এই বইয়ের যেটা মূল অংশ, তা হল কবিতা। রুশ কবিতার দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য থেকে সচেতন ভাবেই নিজেকে বিযুক্ত করে নিয়েছিলেন মায়াকোভস্কি, তাঁর কণ্ঠস্বর একেবারেই স্বতন্ত্র। যে ক’টি কবিতা এখানে অনূদিত হয়েছে, তা থেকেই তাঁর কবিতার ভাবনা ও ধরন বুঝে নেওয়া যায়, বোঝা যায় তাঁর লেখার বিবর্তনকেও। লেনিন তাঁর কবিতার অনুরাগী না হলেও মায়াকোভস্কি লেনিনের অনুরাগী ছিলেন, তাঁর কবিতায় বার বার এসেছেন লেনিন। এই সঙ্কলনে পাঠক সেই অনুরাগের পরিচয়ও পাবেন। কেবল মায়াকোভস্কির কবিতার অনুবাদ নয়, প্রতিটি লেখার সঙ্গে অনুবাদক জুড়ে দিয়েছেন টীকা। ফলে কবিতা রচনার পরিপ্রেক্ষিতটি পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মায়াকোভস্কির কবিতায় অনেক সময়ই বিশেষ ব্যক্তি বা ঘটনার উল্লেখ থাকে, কোনও বিমূর্ত জল্পনাকে প্রশ্রয় দিতে চাননি তিনি। কিন্তু ভিনদেশি পাঠকের পক্ষে তা বোঝা দুষ্কর, অরুণ সোমের টীকা পাঠকের পক্ষে খুবই সহায়ক। তাঁর অনুবাদও সাবলীল, অনুমান করা যায় তিনি মূলের প্রতি যথেষ্টই অনুগত। যদিও অনুবাদমাত্রই বিশ্বাসঘাতক, বিশেষত কবিতার অনুবাদ— তা বিশ্বস্ত হলে সুন্দর হয় না, সুন্দর হতে গেলে সে আর বিশ্বস্ত থাকে না। তবুও বিশ্বাস ও সৌন্দর্যকে পরস্পরবিরোধী মনে করেননি অরুণ সোম, অনুবাদকেও কবিতা করে তুলতে চেয়েছেন, বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজতে গিয়ে প্রশ্রয় দেননি কোনও ছুতমার্গকে।

কোনও বই মূল্যবান হয়ে ওঠে তার বিষয়ের সুবাদেই, কিন্তু বই-নির্মাণও এক শিল্প। এই বইটির প্রকাশক সে-কথা বিশ্বাস করেন। বইয়ের পুস্তানিতে ব্যবহৃত হয়েছে মায়াকোভস্কিরই চিত্র-প্রদর্শনীর পোস্টারের প্রতিলিপি, ভিতরেও আছে তাঁর নানা বইয়ের প্রচ্ছদ বা কবিতার অলঙ্করণের প্রতিলিপি, বইটির রুশ বাতাবরণ তৈরি করায় যা প্রভূত সাহায্য করেছে। ফোটোগ্রাফ-অনুসারী প্রচ্ছদচিত্র চোখ টানে তার ঋজু ও বলিষ্ঠ সহজতায়। বিপ্লবী ও কবি এবং বিপ্লবী কবি মায়াকোভস্কিকে এই বই থেকে চিনে নেওয়া যায় তাঁর কবিতা ও যাপনের দ্বন্দ্ব ও সহাবস্থান থেকেই, এই দুই মিলেই তো তাঁর জীবন।

সব্যসাচী দেব

অন্য বিষয়গুলি:

Poetry Vladimir Lenin
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy