—প্রতীকী চিত্র।
সাহিত্যপাঠে অণুবীক্ষণ বা দূরবীক্ষণ, জরুরি দুই-ই। পাঠকের কাছাকাছি সময় আর অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী সময়ের সাহিত্যপাঠে তারতম্য থাকাটাই তো স্বাভাবিক। উনিশ শতকের উনিশ-শতকীয় পাঠ বিশ শতকে এসে বদলায়। একই ভাবে বিশের প্রথমার্ধের বাংলা সাহিত্যের পাঠ একুশের এই অর্ধে যতটা স্পষ্ট, তুলনায় শেষের অর্ধের পাঠ সমকালীন পর্যালোচনাতেই এক অর্থে স্থগিত হয়ে রয়েছে। এর মধ্যে দীক্ষিত পাঠগুলি অনেকটা বিদ্যায়তনিক পাঠতন্ত্র বা গবেষণার ছকে ঘরানাবদ্ধ। তুলনায় অদীক্ষিত পাঠ অনেকটা স্বাধীন; হিসাব মেলানোর পরোয়া নেই তার। সে ক্ষেত্রে এ দুইয়ের একটা মধ্যপন্থা তৈরি করাই মুনশিয়ানার কাজ। এক দিকে থাকবে গবেষণা; মৌলিক কিছু জিজ্ঞাসা, প্রেক্ষণ বা ক্ষেত্রবিশেষে আবিষ্কারও। আবার অন্য দিকে আকর্ষণক্ষম এক পাঠযোগ্যতা।
১৯৯৩-তে বিভূতিভূষণ: দ্বন্দ্বের বিন্যাস বইটি বেরোনোর পর দেখা গিয়েছিল, সে ইস্তক বিভূতিসাহিত্য পাঠের পুনঃপাঠ বা ক্রমপাঠের একটি না হয়ে বইটি স্বতন্ত্রপাঠ হয়ে ওঠে। আর পাঠের মধ্যেই প্রশ্ন জাগিয়ে এবং তার সম্ভাব্য উত্তর দিতে দিতে পাঠককেও সঙ্গী করে নেন অনায়াস দক্ষতায় বইটির গ্রন্থকার রুশতী সেন। সেই পাঠ ও আবিষ্কার চলতেই থাকে আরও কয়েকটি প্রবন্ধে এবং শেষে বিভূতিভূষণের একটি নতুন জীবনী যখন লিখলেন, তত দিনে তিনি অন্যতম বিভূতি-বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত। প্রথম সেই বইটি প্রকাশের ঠিক তিন দশক পরে রুশতী সেনের প্রবন্ধসংগ্রহ-র প্রথম খণ্ডে কিন্তু সেই বইয়ের প্রবন্ধগুলি সঙ্কলিত হয়নি। বরং এই তিন দশকে তাঁর অন্য তিনটি বই থেকে নির্বাচিত কিছু লেখা রয়েছে, আর সিংহভাগটাই জুড়ে আছে অগ্রন্থিত প্রবন্ধ। প্রথম বইয়ের গোড়ায় জানিয়েছিলেন, “কোনো সাহিত্যেরই কোনো একটি বিশেষ পাঠ সেই রচনার সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে পারে না,” তাই তার নতুন পাঠ জরুরি। আর এই বইটির ক্ষেত্রে প্রবন্ধগুলি যে সূত্রে দুই মলাটবন্দি তার মূল কথা হল, “যে সাহিত্য আমার বোধবুদ্ধি মতে গুরুত্বপূর্ণ, অথচ তার বিন্যাস-বিশ্লেষণ তুলনায় কম চোখে পড়েছে আমার, সেই সব সৃজনের কথা নিজেকে আর পাঠককে মনে করানো, যাতে তৈরি হয় আরও বিকল্প পাঠ।” বিকল্প পাঠও একটি বিশেষ পাঠ তো বটেই। কাছাকাছি সময়ের পাঠগুলির সাফল্য বা ব্যর্থতাই তো আগামী দিনের নতুন কোনও পাঠের প্ররোচনা হয়ে উঠবে।
প্রবন্ধসংগ্রহ
রুশতী সেন
৫৫০.০০
এবং মুশায়েরা
এই বইটিতে আলোচিত সাহিত্যিকদের মধ্যে তাই আশাপূর্ণা দেবী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল কর, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সুখলতা রাও, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অমলেন্দু চক্রবর্তী, লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায়, গৌরী ধর্মপাল— এমন কয়েকজন অপেক্ষাকৃত দূরের সমকালীন। আর আফসার আহমেদ, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, অমর মিত্র, সৈকত রক্ষিত, সেলিনা হোসেন, নবারুণ ভট্টাচার্য, কবিতা সিংহ, সুনন্দা শিকদার, আলপনা ঘোষ, শাহীন আখতার, তৃপ্তি সান্ত্রা, শেফালি মৈত্রদের গ্রন্থপ্রকাশকাল অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত কাছের সমকালীন বলা চলে। সাম্প্রতিক বলেই সম্ভবত এই লেখাগুলির বেশ কয়েকটি হল গ্রন্থ-সমালোচনা সূত্রে একটি বা কয়েকটি নির্দিষ্ট বইয়ের পাঠ। সঙ্গে রয়েছে আলোচনাচক্রে প্রদত্ত ভাষণের প্রবন্ধরূপ কয়েকটি। একটি প্রবন্ধে জড়িয়ে আছে সাম্প্রতিক উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়িত রূপ বা নাট্যরূপের পাঠ। ফলত এই লেখাগুলি এক রকম প্রবন্ধের সীমানায় থাকছে, আবার বেরিয়েও যাচ্ছে এমনটাই।
তবে লেখাগুলির উপজীব্য প্রধানত বাংলা কথাসাহিত্য। তিন ভাগে সাজানো লেখাগুলির প্রথম আর দ্বিতীয় ভাগ তো তা-ই। তৃতীয় ভাগেও শিশুকিশোর সাহিত্যের আলোচনায় অবলম্বন সেই কথাসাহিত্যই বটে। লেখক বা বই-নির্দিষ্ট এই পাঠগুলির মধ্যে কয়েকটি ভিন্ন গোত্রের লেখা রয়েছে। এর একটি ‘আবাদ-অনাবাদের বাংলাসাহিত্য’ আর তার পরেরটি— ‘সাহিত্য থেকে রাষ্ট্রে: একটি অসম্পূর্ণ পাঠ’ প্রবন্ধ দু’টি। গৌরকিশোর ঘোষ, দেবেশ রায়, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিৎ সেন, অনিল ঘড়াই বা আরও অনেকেরই কথাসাহিত্যের কম-বেশি উল্লেখে সমাজবিজ্ঞান বা অর্থশাস্ত্রের প্রেক্ষণীর নির্ভরে সাহিত্য পাঠের প্রয়াস এ দু’টি লেখা। তাই ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ বিকেন্দ্রীকরণ রাষ্ট্র কৃষি অর্থনীতির পালাবদলের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা আখ্যানে পড়া তার প্রতিবিম্ব বা প্রতিক্রিয়া কেমন, তাঁর মতো করে সেগুলির পরস্পরছেদী আন্তঃসম্পর্ককে নির্দেশ করেন প্রাবন্ধিক। আসলে “রাষ্ট্রসমস্যা যেখানে প্রত্যক্ষেও নেই, পরোক্ষেও নেই, এমন সাহিত্য খুঁজে পাওয়া ভার”— এটা কেবল এই দু’টি লেখা পাঠের ভিত নয়, এই সঙ্কলনের সবগুলি লেখাই হয়তো এই সূত্রটি দিয়ে তলে তলে গাঁথা। লেখক বা গ্রন্থনির্দিষ্ট পাঠের মধ্যেও মাঝে মাঝেই এমন দেখার ইশারা রয়েছে।
আর এমন কিছু পরস্পরসম্পৃক্ত সূত্রে বাঁধা আছে শিশুকিশোর সাহিত্য নিয়ে লেখাগুলি। এই লেখাগুলির ক্ষেত্রে কখনও যেন কলমটিও বদলে যায় কোথাও কোথাও। বাঙালি শিশুর ছেলেবেলা যে সাহিত্যের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে লালিত হবে সেখানে প্রশ্ন হল, “সকলের জানার গড়ন কি হয়ে গেল আগমার্কা?” ফলে সেই সব লেখার আর গুরুত্ব কোথায়, যা শিশুটিকে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার প্ররোচনা দেয়! স্বপ্নের আর সংসারের সে কাল আর এ কাল বদলে গেলেও এক অসহায় পরিবেশবিদের মতোই যেন লেখাগুলি বার বার সওয়াল করে শিশুদের উপলক্ষ করে হয়তো তাদের অভিভাবকদের কাছেই! নষ্ট শৈশব আর ভ্রষ্ট বাস্তুতন্ত্রে তাই হয়তো মাকু, ইয়াসিন, হাওয়াগাড়ি, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরী ধর্মপাল, বই-রাগী হাবু অনেক উদ্ভিদ বা কীটপতঙ্গের মতোই বিপন্ন! আর বিপন্নতারই অন্য দিকে রয়েছে নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্টের মতো উপন্যাসের ভাষ্য— “আমাদের সাম্প্রতিকে তো আজ হারিয়ে যাওয়া অতীতেরই হাহাকার!”
আফসার আমেদের কিসসায় ঘটা আর না-ঘটার মধ্যে নির্মমতর কোনও বাস্তবের থেকেই রেহাই খোঁজার উপায় অনুসন্ধান তারই অন্যরূপ। উপনিবেশ-পূর্ব জীবনচর্যার অনুপুঙ্খে কী ভাবে ডুব দিয়ে আখ্যান গড়েন রামকুমার মুখোপাধ্যায়। সৈকত রক্ষিতের লেখায় তেমনই অচেনা ভূগোল বা ইতিহাসের অবস্থান খোঁজার পাঠগুলিকে একে একে জুড়লে আমরা নানান ‘অপর’দের আখ্যানগুলির অন্দরমহলে প্রবেশ করতে পারব। যেমন ভাবে কবিতা সিংহর কথাসাহিত্য আলোচনায় উঠে আসে প্রশ্ন, “কোথাও কি আসুবিধে হয় মানতে যে, এমন গল্প আসছে নারীর কলম থেকে?” আবার, নির্মেদ নির্মোহ গদ্যে জগদীশ গুপ্তের লেখায় মানবমনের অন্ধকারকে তুলে ধরার দক্ষতার প্রসঙ্গ টেনে এনে বোঝাতে হয় কবিতা সিংহর উপন্যাসের সামর্থ্যকে। মানবীবিদ্যার নিরিখ বাংলা সাহিত্যের বিশ্লেষণে কেমন হবে তার পথ বা মত গড়ে তোলার প্রয়াস কয়েকটি লেখাকে জরুরি করে তুলেছে।
সাবেক বাস্তববাদের ঘেরে আর ঘোরে যখন বাংলা উপন্যাস বা ছোটগল্প এগোনোর রাস্তা পাচ্ছিল না, তখন যাঁরা উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন তাঁদের সময়ের ইতিহাস লেখার দায়িত্ব যখন সাহিত্যের ইতিহাস-রচয়িতাকে নিতে হবে, তখন তাঁর এক দিকে থাকবে তথ্য বা সময়ের হদিস। অন্য দিকে থাকবে সেই সব পাঠ যেগুলি অনবরত আপাত-অচেনা এ সব আখ্যানের যুক্তি থেকে প্রযুক্তি সবই বোঝাতে সক্রিয় হয়েছে আম থেকে খাস সব ধরনের পাঠককে। সাহিত্যের এককালিক পাঠ আর বহুকালিক পাঠের আন্তঃসম্পর্কেই গড়ে ওঠা সম্ভব সাহিত্যের ইতিহাসের পাঠ। সে ক্ষেত্রে বিশ একুশ শতকের বাংলা কথাসাহিত্যের প্রতি এক দায়বদ্ধতা থেকে যে লেখাগুলি তৈরি হয়েছে, তার একটা কারণ নিশ্চয়ই প্রাবন্ধিকের সঙ্গে একটি সাহিত্যপত্রের নিবিড় যোগ। আরও যাঁরা এই পর্বের কথাসাহিত্যিকদের লেখা নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে এই লেখাগুলির একটা মূল প্রভেদ হয়তো এখানেও। যেমন এক নিবিড় সম্পৃক্ত লিখনভঙ্গিতে অনেকগুলো লেখাই নির্মিত, সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক প্রথাসিদ্ধ বিশিষ্ট বয়ানের মতো আবেগ বা আসক্তিকে কাটছাঁট করে নির্মোহ পালিশ দেওয়ার চেষ্টাই করা হয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy