সম্প্রতি উদ্ধোধন হওয়া নতুন পার্লামেন্ট ভবন।
নতুন সংসদ ভবন ঝড়ের গতিতে তৈরি হয়ে গেছে, প্রধানমন্ত্রী সাধু-পরিবেষ্টিত হয়ে সেখানে স্বর্ণদণ্ড পর্যন্ত স্থাপন করেছেন— এমন সুবর্ণ ভবিষ্যতের মুখে পুরনো সংসদ ভবনটি নিয়ে বিশেষ কারও মাথাব্যথা নেই, ওটি বোধ হয় ভারতের গণতন্ত্রের অন্য অনেক ধারার মতো, বাতিল হল। তাই রণজয় সেনের বইটির প্রচ্ছদ খানিক অমঙ্গলসূচক: কম করে এক ডজন বইয়ের মলাটে সংসদ ভবনের ছবি দেখেছি, কিন্তু এই মলাট স্বতন্ত্র, কালো মেঘে ঢাকা অন্ধকার ভবনের মাথায় একটা কালো পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। এখান থেকেই ইঙ্গিত মেলে যে, এই ইতিহাস ষাটের দশকে লেখা গ্রানভিল অস্টিন-এর মতো ভারতীয় গণতন্ত্রের নিছক প্রশংসাপূর্ণ জয়গাথা নয়। লেখক সংসদের ইতিহাসের মূল্যায়ন করছেন এক কঠিন বাস্তবে দাঁড়িয়ে, যখন বিশ্বের বহু দেশের মতো ভারতেও গণতন্ত্র আক্রান্ত, যখন ভোটের হার ক্রমাগত বাড়লেও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপর শাসক ও শাসিত দুইয়েরই আস্থা কমছে।
লেখক সংসদের কাহিনি বলা শুরু করেছেন ইতিহাসবিদের দৃষ্টি থেকে: প্রথম দু’টি অধ্যায়ে দেখি ব্রিটিশ যুগের আইন থেকে সংবিধান-সভা সৃষ্টি, সেখান থেকে ওয়েস্টমিনস্টারের আদলে সংসদীয় প্রথা, তার পর ক্রমে স্বাধীনতার পরে আস্তে আস্তে তার অভিজাত চরিত্র বদলে সমাজের বহুস্তর থেকে সাংসদদের আগমন। এই কাহিনি একেবারে অজানা নয়, কিন্তু গড়পড়তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুলনায় এই বইটির ইতিহাসচেতনা চোখে পড়ার মতো, যেমন লক্ষণীয় ঐতিহাসিক নথিভিত্তিক গবেষণার ছাপ। খবরের কাগজের মহাফেজখানা এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে উদ্ধার করে আনা, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের দুর্লভ ছবিগুলি বইটির বিশেষ সম্পদ। পরের তিনটি অধ্যায় বিষয়ভিত্তিক: সংসদের কাজ বানচাল করার ইতিহাস, যা লেখকের মতে ক্রমশই বেড়েছে; সংসদীয় কমিটির কাজের ধারার এক অজানা এবং আশ্চর্য বিবরণ; এবং, শেষে, সাংসদদের দুর্নীতি এবং আইন-বিরোধী কাজের ইতিহাস, মুন্দ্রা-মামলা, বফর্স থেকে অণ্ণা হজারে পর্যন্ত। বইটি শেষ হয়েছে খানিকটা শুভ-অশুভের কিনারায়: সেন্ট্রাল ভিস্তার কথা উল্লেখ করে লেখক বলেছেন কী ভাবে সংসদ ভবনটিকে ‘ইতিহাসের আঁস্তাকুড়’-এ ফেলা হচ্ছে, তবুও শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের শক্তিতে একেবারে আশা হারিয়ে ফেলেননি।
হাউস অব দ্য পিপল: পার্লামেন্ট অ্যান্ড দ্য মেকিং অব ইন্ডিয়ান ডেমোক্র্যাসি
রণজয় সেন
১২৯৫.০০
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস
লেখক একাধারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষক ও অভিজ্ঞ সাংবাদিক, তাই গাণিতিক সমীক্ষা, ঐতিহাসিক দৃষ্টি, এবং সহজ স্পষ্ট লেখনীর চমৎকার মিশেল হয়েছে বইটিতে। সংসদের কাজ ব্যাহত হওয়ার প্রসঙ্গে যেমন গ্রাফের সাহায্যে দেখানো হয়েছে কী ভাবে সাম্প্রতিক কালে সাংসদরা গোলমাল করে বেশি সময় নষ্ট করেছেন; আবার সেখানেই লেখক নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এনেছেন এই কাজ বানচালের সঙ্গে গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহের সম্বন্ধ, যেমন সংসদের বাইরের গান্ধীমূর্তির পাদদেশ ধর্নার পরিচিত জায়গা। একই ভাবে পরিসংখ্যান দিয়ে কমিটির মূল্যায়ন করার পাশেই জায়গা পেয়েছে টু-জি দুর্নীতি কাণ্ডের সময় কমিটির ভূমিকা কাছ থেকে দেখা এবং সাক্ষাৎকার নেওয়ার অভিজ্ঞতা। সংখ্যাত্মক বিশ্লেষণ, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং ইতিহাসবোধের বিরল মিলন বইটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, দলাদলির ঊর্ধ্বে গিয়ে ভাল-মন্দ মিশিয়ে ভারতীয় সংসদের তথ্যনিষ্ঠ সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস লেখার মতো দুরূহ কাজে বইটি বহুমাত্রায় সফল।
সংসদের যে কাহিনি আমরা এই বইয়ে পাই, তা মোটের উপর এক ট্র্যাজিক উপাখ্যান— সংবিধান-রচয়িতারা তাঁদের সাধ্যমতো ওয়েস্টমিনস্টার-এর আদলে এই দেশে গণতন্ত্রের একটি মন্দির স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন, কালে কালে তা রাজনীতি ও দুর্নীতির সাঁড়াশিতে জীর্ণ হয়ে পড়েছে, তবুও হাজার গলদ সত্ত্বেও, টিমটিম করে হলেও, টিকে আছে। বইটির ইতিহাস-বিশ্লেষণ এই চেনা প্লটকেই সমর্থন করে: আম্বেডকর, সংবিধান-সভা, এবং বহুলাংশে নেহরু এখানে সমালোচনার ঊর্ধ্বে, তাঁরা যেন তাঁদের ইংল্যান্ডের শিক্ষার ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট গড়তে চেয়েছিলেন, সমস্যার শুরু হয় ষাট এবং সত্তরের দশক থেকে। এখানেই কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। সংবিধান রচনার সময় থেকে ওয়েস্টমিনস্টার-এর কথা এবং তুলনা অনেকের মুখে অনেক বার উঠলেও, আসলে ভারতের সংসদ লন্ডনের পার্লামেন্টের ভারতীয় সংস্করণ নয়, তা ঔপনিবেশিক ভারতের আইনসভার প্রাতিষ্ঠানিক উত্তরসূরি। দুইয়ে পার্থক্য বিস্তর, সবচেয়ে বড় পার্থক্য: চাইলেই ভারতের ক্ষমতাবান সরকার নানা রকম ইমার্জেন্সি ক্ষমতা ব্যবহার করে সংসদকে নস্যাৎ করে কাজ চালিয়ে যেতে পারে, অন্তত পরবর্তী নির্বাচন অবধি, বিলেতে যা ভাবাও যায় না। এই সমস্ত ক্ষমতা ১৯১৯ এবং ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনে ইংরেজ নিজের হাতে রেখেছিল, যাতে ভারতে নির্বাচন হলেও প্রকৃত ক্ষমতা না দেওয়া হয়, আম্বেডকর-নেহরু-পটেল তা স্বাধীন ভারতের সংবিধানে সরিয়ে আনেন। এর বলেই সংসদে লোকবল থাকলে কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় যা খুশি করতে পারে, হয় ইন্দিরা গান্ধীর মতো সোজাসুজি জরুরি অবস্থা জারি করে, বা নরেন্দ্র মোদীর মতো অর্ডিন্যান্স জারি করে, আলোচনা ছাড়া বিল পাশ করিয়ে। সংসদের যে ট্র্যাজেডি রণজয় বর্ণনা করেছেন, তার শিকড়, অন্তত আমার বিচারে, একেবারে গোড়ায়। ভারতের সংসদের গড়নই বহুলাংশে বড় বেশি শাসকের ধার ঘেঁষে, বিরোধীর সেখানে খুব বেশি কিছু করার ক্ষমতা নেই।
ঠিক এই অসহায়তার পরিপ্রেক্ষিত থেকেই সংসদে বিরোধিতার ইতিহাসও পুনর্বিবেচনা করা উচিত। লেখক যে-হেতু ধরে নিয়েছেন যে, সংসদের সাংবিধানিক ভিত্তিতে কোনও গলদ ছিল না, তাঁর চোখে অত্যধিক বিরোধিতা নিয়ম-লঙ্ঘনের শামিল। বইয়ে বিরোধিতার বিশ্লেষণ তাই হয়েছে খানিকটা শাসক-নিয়োজিত স্পিকারের ভাষ্যে, কতটা ‘সময় নষ্ট’ হয়েছে তার খতিয়ান দিয়ে, বা কী ভাবে ‘মেঠো’ রাজনীতির সংস্কৃতি সংসদে উঠে এসেছে তা নিয়ে খানিক উষ্মা প্রকাশ করে। এই যুক্তিগুলি সত্য, কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য হল: সংসদের এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাঠামোয় বিরোধিতার পরিসর কেবলই কাগুজে, যদি না বিরোধীরা একজোট হয়ে সরকার ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করতে পারে। সংসদ ভবনে গোলমাল করার প্রবণতা আসে মূলত এই ব্যর্থতা থেকে। একই ভাবে সংসদ ক্রিমিনালে ভরে গেছে বলে গেল-গেল রব ওঠার পক্ষে যেমন যুক্তি আছে, তেমনই আইনেই নানা প্যাঁচ ব্যবহার বিরোধীদের অপরাধী বলে দাগানো ক্ষমতাসীন সরকারের কাছে জলভাত— বইটি প্রকাশিত হওয়ার কয়েকমাস পরেই একটা আইনি ছুতোয় রাহুল গান্ধীকে অপরাধী বলে তাঁর সাংসদ পদ যে ভাবে বাতিল হয়েছে।
নতুন সংসদ ভবনে দেশের গণতন্ত্রের কোন স্বর্ণযুগ যে আসছে তা ঈশ্বরই জানেন, কিন্তু যে ক্ষমতার কাঠামো কেন্দ্রীয় সরকার আর সংসদকে বেঁধে রেখেছে তা অপরিবর্তিত থাকলে সংসদে শাসক ও বিরোধীর সম্পর্ক পাল্টাবে না। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ লোকবল থাকলে সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা আছে, সেখানে এক-তৃতীয়াংশ বিরোধীর স্বর মূল্যহীন। সরকারের থেকে আলাদা করে সংসদকে ক্ষমতার ভাগ এবং বিরোধিতার শক্ত সাংবিধানিক ভিত্তি না থাকায় সংসদ বার বার বাহুবলী শাসকের স্বেচ্ছাচারের অনুমোদনকারী হয়ে দাঁড়িয়েছে।পুরনো সংসদের জন্য পরিতাপের পাশাপাশি তাই ক্ষমতার অন্য রকম বিন্যাসের খোঁজ করা সমান জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy