Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
book review

বিষাদগাথার সযত্ন সন্ধান

দাসদাসীর ব্যাখ্যায় কখনও তাঁদের তনুমনকে একত্রে ভাবা হয়েছে, কখনও মনের চেয়ে তনু গুরুত্ব পেয়েছে, কখনও উল্টোটাও।

অনাদৃত: একলব্য, নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি। উইকিমিডিয়া কমনস

অনাদৃত: একলব্য, নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি। উইকিমিডিয়া কমনস Sourced by the ABP

অলখ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৩ ০৭:১০
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসে বিনয় ও সুচরিতার বাক্যালাপে জাতিভেদ বা বর্ণভেদের প্রসঙ্গে সিঁড়ির কথা ওঠে। বিনয় সিঁড়ির ধাপগুলোকে এক-একটি বিভাগ মনে করেন, কোনওটা উপরে, কোনওটা নীচে। সুচরিতা বলেন, “সমান জায়গায় সিঁড়িকে না মানলেও চলে।” বিনয়ের জবাব, “আমরা... সংসারকর্মকে ধর্ম বলে স্থির করেছি... এক দিকে সংসার-কাজ, অন্য দিকে সংসার-কাজের পরিণাম, উভয় দিকে তাকিয়ে আমাদের সমাজ বর্ণভেদ অর্থাৎ বৃত্তিভেদ স্থাপন করেছেন।” সুচরিতা প্রশ্ন করেন, “যে উদ্দেশ্যে সমাজে বর্ণভেদ প্রচলিত হয়েছে আপনি বলছেন সে উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে দেখতে পাচ্ছেন?” বিনয় উত্তরে নানা কথার পরে বলেন, “ভারতবর্ষ যে জাতিভেদ বলে সামাজিক সমস্যার একটা বড় উত্তর দিয়েছিলেন, সে উত্তরটা এখনো মরে নি... ভারতবর্ষের সহজ প্রতিভা হতে এই-যে একটা প্রকাণ্ড মীমাংসা উদ্ভূত হয়েছে পৃথিবীর মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত এর কাজ না হবে ততক্ষণ এ স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে।”

সকলেই জানেন, এটি উপন্যাসটির একটি ধাপ মাত্র। কাহিনির শেষে আনন্দময়ীর পায়ের তলায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিপ্রেত উত্তরে পৌঁছন, গোরা বলে, “তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই— শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা। তুমিই আমার ভারতবর্ষ।” কিন্তু গত শতকের প্রথম দশকের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথ ধর্ম, দেশ, ভারত ও বর্ণভেদ নিয়ে এই আলোচনা তুলেছিলেন কেন? স্মর্তব্য, উপন্যাসটি আমরা এখন যে ভাবে পড়ি, প্রথম পাঠকেরা সে ভাবে পড়েননি। ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত উপন্যাসে এক-একটি মত ও তার ব্যাখ্যা পড়ে পরের ধাপে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে করে চলতে হয়েছে। গ্রন্থাকারে একটি আংশিক প্রকাশ মাঝখানে ঘটলেও, সেটি আংশিকই ছিল। পরে, শেষ অংশটাও প্রবাসী-তে প্রকাশের পূর্বে পাঠক পড়ে ফেলার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগে অনেকগুলি মাস ধরে উপন্যাসের উপজীব্য তর্কটা জিইয়ে থেকেছে, পাঠককে প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ে ভাবার সময় দিতে দিতে এগিয়েছে। এই পরিকল্পনার কারণ তাঁর এই উপন্যাস রচনার সময়কাল নিশ্চয় হতে পারে, আর তখনই মনে পড়ে যায়, শতাধিক বছর পেরিয়ে আসার পরেও এই আলোচনার সঙ্গে আমাদের সমাজের নিত্য সম্পর্ক রয়েছে। অনেকেই এখনও মনে করেন, ‘প্রকাণ্ড মীমাংসা’টি ‘স্থির দাঁড়িয়ে’ রয়েছে। বিনয় কথিত ‘ভারতবর্ষ (-এর)...উত্তর’ প্রসঙ্গটি তাই এখনও প্রাসঙ্গিক। কী সেই উত্তর? দেবীদাস আচার্য মহাভারতে নিম্নবর্গ বইটিতে যেন তারই খোঁজ করেছেন বহু জনের কাছে ভারতাত্মা বা এই ভূখণ্ডের সর্বশাস্ত্রসার বলে বিবেচিত এই মহাকাব্যটিতে। আর সে কারণেই, শুধু মহাভারতপ্রিয় পাঠকই নন, যে কোনও পাঠকের কাছেই এমন বই আদরণীয় হতে পারে।

মহাভারতে নিম্নবর্গ

দেবীদাস আচার্য

৪৫০.০০

সিগনেট প্রেস

লেখক বর্ণ-পীড়নের উদাহরণ হিসাবে আলোচনা করেছেন কর্ণ, একলব্য ও ঘটোৎকচকে নিয়ে। তবে শুরু দ্রৌপদীকে ধরে। মহাভারত জুড়েই বিধির বিধানের সঙ্গে চরিত্রের লড়াইয়ের এক আশ্চর্য ইতিবৃত্তের সন্ধান মেলে। কেননা, এই লড়াইয়ের একটি জ্ঞাত কাহিনির উপরে বহু কবির সুখদুঃখ ভাবনার প্রলেপ পড়েছে বার বার। দ্রৌপদী তার উজ্জ্বল উদাহরণ। বিবাহের পর পর রাতে ঘুমোনোর সময় এই বৈদুর্যমণিসন্নিভার স্থান কোথায় ছিল, সে প্রসঙ্গে মহাভারতকারেরা ‘পাদোপধানীব’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। শব্দটির অর্থ নিয়ে তর্ক রয়েছে। তবে পঞ্চস্বামীর পা যে অনবদ্যাঙ্গীর অঙ্গস্পর্শ করত, তা ধরে নিলে এবং এই বিবরণে তাঁর শারীরিক অসম্মানের চেয়ে মানসিক ঔদার্যই বেশি প্রতিফলিত হয়েছে, তা-ও ধরে নিলে, তাঁর লাঞ্ছনার সেই শুরু কি না, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু মহাভারত কখনও আশ্চর্য হতে নিরাশ করে না। এই দ্রৌপদীই কর্ণ সম্পর্কে তার কিছু ক্ষণ আগেই ভরা সভায় বলেছিলেন, নাহং বরয়ামি সূত, সূতের গলায় তিনি মালা দেবেন না।

অজ্ঞাতবাসের পর্বে সৈরিন্ধ্রীর কাজ কী, লেখক তার খোঁজ করছেন সযত্নে। কোন কালে রচিত কোন রচনায় সৈরিন্ধ্রীর কী ব্যাখ্যা দেওয়া রয়েছে, তা সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। মহাভারতের ব্যাখ্যাকারদের মত তো সেখানে থাকারই কথা, যেমন থাকার কথা রামায়ণেরও, দেবীদাস সেই সঙ্গে বৈদিক সাহিত্য, অর্থশাস্ত্র, মনুসংহিতা ও অন্য স্মৃতি ও শাস্ত্র থেকে অর্থ চয়ন করে করে নিজের মত বুনেছেন। এমনকি, উনিশ শতকে গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের লেখাও উদ্ধৃত করে তার সঙ্গে দ্রৌপদীর রোজনামচার মিল দেখিয়েছেন।

কেমন ভাবে কালে কালে নিম্নবর্গের অধঃপতন ঘটেছে তার এবং তার ব্যাখ্যার একটি ধারাবাহিক বর্ণনাই লেখক বিস্তারিত সরবরাহ করছেন, যেখানে সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নবর্গের বিভিন্ন সমার্থকের ওঠাপড়াও নজরে পড়ে। ঋগ্বেদ সংহিতার অষ্টম মণ্ডলেই দাসদাসীর কথা রয়েছে, পরে দাসদাসীর ব্যাখ্যা বার বার বদলেছে। স্বাভাবিক ভাবেই, সমাজে নারীর স্থানের কথাও বিবৃত হয়েছে। এখানেই একটি কথা ওঠে। দাসদাসীর ব্যাখ্যায় কখনও তাঁদের তনুমনকে একত্রে ভাবা হয়েছে, কখনও মনের চেয়ে তনু গুরুত্ব পেয়েছে, কখনও উল্টোটাও। শাসিতের মনকে বশে রাখার রাষ্ট্রীয় প্রতাপের সেই মরিয়া প্রয়াসের ইতিহাসও এ বই থেকে উদ্ধার করা যায়। যেমন, লেখক মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দাসীকে ধর্ষণের জন্য অর্থশাস্ত্র-এ জরিমানার নিদান ছিল। শূদ্র দাসীর গর্ভে সন্তান জন্মালেও মা ও সন্তান দু’জনেই দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতেন। লেখকের চিন্তার প্রাখর্য ফুটে ওঠে যখন তিনি শাস্ত্র উদ্ধৃত করে বলেন, শূদ্র দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলেও বাকি তিন বর্ণের দাসত্ব করেই তাঁকে চলতে হত। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। উচ্চবর্ণের মধ্যে যে একটি প্রচণ্ড ভয় ছিল, সে কথাও লেখক জানাচ্ছেন। নারদ যুধিষ্ঠিরকে সতর্ক করে বলেছেন, রাজা দণ্ড না দিলে বৈশ্য তার কাজ করবে না এবং শূদ্র ‘সব্বাইকে ছাপিয়ে যাবে’। অর্থাৎ, যুগ যুগ ধরে জন্মের আগে থেকে যাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে, সেই শূদ্রের সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য যে রয়েছে, তা মহাভারতকারেরাই স্বীকার করেছেন।

শূদ্রকের চারুদত্তের সঙ্গে লেখক মিল পান উদ্যোগপর্বের যুধিষ্ঠিরের। যুধিষ্ঠির মনে করছেন, ধনহীনতা মৃত্যুর মতো। সেই যুধিষ্ঠিরের শাসনাধীন রাজ্যেই সম্পদের অসম বণ্টন ছিল বলে লেখকের মত। এ কথাটিকে মাঝখানে রেখে আলোচিত হয়েছে প্রাচীন ভারতের একাধিক বৃত্তি, সেগুলির যন্ত্রণা ও সমস্যার কথা। বৃত্তি বর্ণাশ্রম ধারণার উৎসমুখ, এমন ভাবনার উল্লেখ একটি অধ্যায়ে আলোচিত। সেখানে ব্রাহ্মণদ্বেষী এক শূদ্র ব্যাসের কথা শুনে এক-একটি জন্মের সিঁড়ি বেয়ে শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেছে।

এই জন্মপরিচয় কর্ণকে আজীবন তাড়া করেছে। তাঁর কথা বলতে গিয়েই মহাভারত চিন্তার উজ্জ্বলতার সীমা যেন বার বার অতিক্রম করেছে। কুরুক্ষেত্রের আগে সূর্য ও ইন্দ্র দু’জনেই ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে বারংবার প্রতারিত কর্ণের কাছে আসেন। দু’ক্ষেত্রেই কর্ণ বিধির মুখোমুখি হন নিজ চরিত্রবলে। পিতার স্নেহসিক্ত পরামর্শ, নিজের মৃত্যুভয়ও তাঁর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারেনি। মহাভারতকারেরা কর্ণের মৃত্যু ধাপে ধাপে অলঙ্ঘ্য করেছেন, কিন্তু তাঁর চরিত্র কেড়ে নেননি। প্রশ্ন জাগে, কর্ণের বর্ণ নিয়ে যে টানাপড়েন রয়েছে, তাতেই কি তিনি এই ছাড় পান, না কি, এটাই আসলে নিম্নবর্গের প্রতি মহাভারতের দান?

একলব্যও মহাভারতের পাঠকদের কাছ থেকে এই বিষাদের আদর পেয়েছেন। লেখক সত্যকামের প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, গৌতম ব্যতিক্রমী হতে পেরেছিলেন, বর্ণ-পীড়নের আর এক উদাহরণ দ্রোণ পারেননি। পারেননি পঞ্চপাণ্ডবও। বার বার বিপদের সময় তাঁরা ঘটোৎকচকে ডেকেছেন, তাঁকে প্রাণও দিতে হয়েছে; লেখক মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সুখের দিনে এই রাক্ষসতনয় অবাঞ্ছিত ছিলেন।

পরিশ্রমী গবেষণার ফসল এই গ্রন্থটি পড়ার পরে মন ভারী হয়। গবেষকদের খুবই সুবিধা হবে এ বই থেকে। তবে ইরাবতী কার্ভের একটি কথা মনে পড়ে যায়, “করুণাঘন দেবতা, ভক্তি, একেশ্বরবাদ, বাস্তব পরাঙ্মুখতা, এ সব ভাবনা মহাভারতে খুঁজে পাওয়া যাবে না, এ সব পরে এসেছে।” মনে পড়ে যায়, মহাভারতকারেরা নানা সময়ের কবি হলেও এক হাতে সুধা, আর এক হাতে ন্যায়দণ্ড ধরা বিধির মতোই বিরাজ করেন। শবরের তিরেই মৃত্যু কৃষ্ণের।

অন্য বিষয়গুলি:

book review Mahabharata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy