Advertisement
২০ জানুয়ারি ২০২৫
India

ইন্ডিয়ায় চাপা পড়ে যাওয়া হিন্দুস্থান

ভারতভূমির হাজার বছরের পুরনো ফারসি নাম ‘হিন্দুস্থান’ আজ হিন্দি-হিন্দু শব্দবন্ধের শেষ পদ মাত্র।

প্রতিভাস: মামুদ গজনির সোমনাথ জয়কে ইতিহাসকার ফিরিশতা বলেছেন লোভী দস্যুর গোঁয়ার্তুমি।

প্রতিভাস: মামুদ গজনির সোমনাথ জয়কে ইতিহাসকার ফিরিশতা বলেছেন লোভী দস্যুর গোঁয়ার্তুমি।

অনিকেত দে
শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২১ ০৭:৫০
Share: Save:

দ্য লস অব হিন্দুস্থান: দি ইনভেনশন অব ইন্ডিয়া মানান আহমেদ আসিফ

৫৯৯.০০

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

ভারতভূমির হাজার বছরের পুরনো ফারসি নাম ‘হিন্দুস্থান’ আজ হিন্দি-হিন্দু শব্দবন্ধের শেষ পদ মাত্র। গত শতকের প্রথম দিক থেকেই সাভারকর হিন্দুস্থানের এই সংজ্ঞাটির প্রচার শুরু করেন যে, হিন্দুরাষ্ট্রে মুসলমানের একমাত্র পরিচয় সে বহিরাগত, বিজাতীয়। অথচ, হিন্দুস্থান নামটি যে মুসলমান লেখকদেরই সৃষ্টি— চারশো বছর আগেকার বিজাপুরের ইতিহাসবিদ মুহম্মদ কাশিম ফিরিশতা-র তারিখ-ই-ফিরিশতা থেকে ইকবালের ‘সারে জহাঁ সে অচ্ছা’ পর্যন্ত— সে কথা আজ প্রায়-বিস্মৃত। মানান আহমেদ আসিফের নতুন বইটি ভারতের ফারসি ইতিহাসচর্চার বিশাল আকর বিশ্লেষণ করে সেই লুপ্ত হিন্দুস্থান খোঁজারই প্রয়াস।

ফিরিশতাকে অবলম্বন করে এই বইয়ের লক্ষ্য দ্বিমুখী। প্রথমত, ফারসি ইতিহাসচর্চার ধারা পুনর্বিবেচনা করে প্রতিষ্ঠা করা যে, মুসলিম লেখকেরা হিন্দুস্থানকে নিজেদের মাতৃভূমি ও হিন্দুদের নিজেদের পড়শি ভাবতেন। দ্বিতীয়ত, সন্ধান করা যে, কী ভাবে ইংরেজ পণ্ডিতেরা সেই হিন্দুস্থানের জায়গায় ‘ইন্ডিয়া’র ধারণা সৃষ্টি করলেন— যে ‘ইন্ডিয়া’য় হিন্দুদের পাঁচ হাজার বছরের বাস, অথচ মুসলমানরা বহিরাগত। দু’টি প্রশ্নেই বইটির নায়ক ফিরিশতা— মানানের মতে, ফিরিশতাই হিন্দুস্থানের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসকার, যিনি রাজারাজড়ার ঊর্ধ্বে উঠে প্রথম সম্পূর্ণ দেশটার গল্প লিখতে চেয়েছিলেন। আবার, আঠারো শতক থেকে এই ফিরিশতাকেই ব্যবহার করে একের পর এক ইংরেজ ‘বহিরাগত’ মুসলমান শাসকের (অপ)শাসনের চিত্র খাড়া করেন। মানান এই ঔপনিবেশিক পণ্ডিতির ধারাটি খণ্ডন করে ফারসি ইতিহাসে ফিরে হিন্দুস্থানের লুপ্ত সামাজিক ও বৌদ্ধিক ইতিহাস পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছেন।

আলাদা আলাদা ভাবে এই দু’টি লক্ষ্যই দুই যুগের ইতিহাসবিদদের কাছে পরিচিত। মধ্যযুগের ভারত- ইতিহাসে যদুনাথ সরকারের আমল থেকেই ফারসি ইতিহাস-ধারার গুরুত্ব স্বীকৃত, অধুনা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজফ্ফর আলম ও তাঁর ছাত্রমণ্ডলীর নেতৃত্বে তা নতুন করে নজরে এসেছে। আবার, সত্তরের দশক থেকেই আধুনিক ঔপনিবেশিক আমল-চর্চার পথিকৃৎদের— যেমন রণজিৎ গুহ, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত এডওয়ার্ড সাইদ ও গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, বা শিকাগোর বার্নার্ড কোন-এর লেখায় ব্রিটিশ শাসকের ইতিহাস-লেখনীর সমালোচনা হয়েছে। মানানের চিন্তা দু’টি ধারাতেই পুষ্ট। তাঁর প্রধান কৃতিত্ব দু’টি ভিন্ন যুগের ইতিহাসচর্চাকে একত্রিত করে হিন্দুস্থানের ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়নের দাবি করা। মধ্যযুগের ইতিহাসবিদদের তিনি বলেন, ইংরেজের তৈরি গল্প (যেমন, ‘বহিরাগত’ মুসলমানরা ‘বিজয়ী’ ও হিন্দুরা ‘বিজিত’) ত্যাগ করে হিন্দুস্থানি ইতিহাসবিদদের নিজেদের দুনিয়ার প্রেক্ষিতে বুঝতে। আবার, আধুনিক ইতিহাসবিদদের প্রতি তাঁর আবেদন, ইন্ডিয়া-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মতো জাতিরাষ্ট্রের খাঁচায় বন্দি না থেকে, বৃহত্তর হিন্দুস্থানের হাজার বছরের ইতিহাসের দিকে নজর ফেরানোর।

জেমস মিল বা আলেকজ়ান্ডার ডাও-এর মতো ইংরেজ শাসক-পণ্ডিতেরা মনে করতেন, ফারসি ইতিহাসের কোনও মৌলিক চিন্তা বা দর্শন নেই, এক কাঁড়ি গল্পের মধ্যে হয়তো কিছু ঠিক তথ্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। মানান এই দৃষ্টিভঙ্গির ঘোর বিরোধী। মামুদ গজনির সভাসদ আবুল ফজ়ল বৈহাকি লিখেছিলেন যে, ইতিহাসবিদ রাজার বেতনভুক কর্মচারী হতে পারেন, কিন্তু তাঁর লেখা ইতিহাস কেবল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দাস; অর্থাৎ ইতিহাসবিদের হাত-পা বাঁধা থাকলেও ইতিহাস যেন সত্যের পথ থেকে না সরে আসে। বৈহাকির এই নীতিবোধকে মানান হিন্দুস্থানি ইতিহাস ঘরানার মূল সুর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন— যেন ক্ষমতার প্রতি এক উত্তর, এক রকম ‘কন্ট্রাপান্টল’ বা প্রতিভাস। শতকের পর শতক ধরে ইতিহাসকারদের লেখায় ফিরে এসেছে এই মূল্যবোধ— কুফি, জুজযানি, মির খোন্দ, বারানি, আবুল ফজ়ল হয়ে ফিরিশতা পর্যন্ত। এই নীতিবোধের জোরেই ফিরিশতা মামুদ গজনিকেও রেয়াত করেননি— সোমনাথ জয়কে বলেছেন নেহাতই এক নির্বোধ, লোভী দস্যুর গোঁয়ার্তুমি। এই নীতিবোধের জোর সব ইতিহাসকারের মধ্যে সমান কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকবে, কিন্তু নৈতিকতা ও ইতিহাস মিলিয়ে মানান হিন্দুস্থানি ইতিহাসকে তার পুরনো অপবাদ থেকে রক্ষা করেছেন।

ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতার পাশাপাশি ফিরিশতার এই বিশ্বাস ছিল যে, হিন্দুস্থান মুসলমানের রণক্ষেত্র নয়, তার মাতৃভূমি; হিন্দুরা শত্রু নয়, তার প্রতিবেশী। তাই তাঁর হিন্দুস্থানের বর্ণনা কেবলমাত্র দিল্লির সুলতানি বংশপঞ্জি নয়; লাহৌর, দাক্ষিণাত্য, গুজরাত, মালব, খান্দেশ, বাংলা, বিহার, মুলতান, সিন্ধ, কাশ্মীর, মালাবার প্রত্যেকটি অঞ্চলের স্বতন্ত্র বর্ণনা। এই ভৌগোলিক বিস্তারই মানানের চোখে ফিরিশতাকে তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা করে দেয়। প্রতিটি অঞ্চলের মানুষজনের বর্ণনাতেও বৈচিত্র, রাজা থেকে বণিক সমাজ পর্যন্ত। ফিরিশতার সময়েই পর্তুগিজরা ভারতে আসতে শুরু করেছে। ইউরোপের চোখে ভারত অচেনা বর্বর এক দেশ, ফিরিশতার চোখে হিন্দুরা তাঁর নিজের দেশের মানুষ।

তবে ‘দেশ’ বলতে ফিরিশতা ঠিক কী বুঝতেন, তা নিয়ে গভীরতর বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল। বৃহত্তর হিন্দুস্থান নিয়ে আবেগ ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু মনেপ্রাণে ফিরিশতা ছিলেন দাক্ষিণাত্যের মানুষ, বৃষ্টিতেও না-ভেজা বিজাপুরের লাল মাটির সঙ্গেই তাঁর সখ্য, তাঁর হিন্দুস্থানের ইতিহাসের কেন্দ্রেও আদিল শাহের বিজাপুর। মানান সে কথা অস্বীকার করেননি, কিন্তু ফিরিশতার দক্ষিণী পরিচিতির তাৎপর্য নিয়ে তিনি চুপ। এই নীরবতা অবাক করে, কারণ তাঁর আগের বইয়ে কুফির চাচ নামা গ্রন্থের পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য মানান মাঠে-ঘাটে-দরগায় ঘুরে সিন্ধি সংস্কৃতিতে নিমগ্ন হয়েছিলেন। এই বইয়ে ফিরিশতার সেই সৌভাগ্য হয়নি, ‘হিন্দুস্থানি’ পরিচিতি তাঁর দক্ষিণী সত্তাকে খানিক ম্লান করেছে। এর একটা কারণ হয়তো জোনাথন স্কটের মতো আঠারো শতকের ইংরেজ পণ্ডিতেরা, যাঁরা ফিরিশতাকে কেবল দাক্ষিণাত্যের আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ মনে করতেন। মানান সেই অপবাদ সরিয়ে তাঁকে সমগ্র হিন্দুস্থানের ইতিহাসবিদের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করতে চান।

কিন্তু ‘আঞ্চলিক’ হওয়ায় দোষ কী? মানানের বৃহত্তর আখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, হিন্দুস্থানের পরিধি অস্পষ্ট, ফিরিশতার হিন্দুস্থান আর বাবুর শাহের হিন্দুস্থান এক নয়। বলা যায়, প্রত্যেক লেখক নিজের দেশ, নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে হিন্দুস্থানকে নতুন করে দেখতে পেতেন, দিল্লিকেন্দ্রিক ‘ইন্ডিয়া’র সঙ্গে হিন্দুস্থানের এই পার্থক্যটি বোঝা জরুরি। এই পার্থক্যই ফারসি ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈচিত্র আনে, সমসাময়িক আবুল ফজ়ল আর ফিরিশতাকে দুই মেরুতে ঠেলে দেয়। আগরায় আবুল ফজ়ল যখন আকবরের মহিমায় মুগ্ধ, তখনই দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরিশতা গর্জন করেন: ইংরেজ, পর্তুগিজদের আটকাতে আঞ্চলিক রাজারাই যুদ্ধ করেছিলেন, আকবর শাহ হাত গুটিয়ে মজা দেখছিলেন। মোগল সম্রাটের তোয়াক্কা না করে হিন্দুস্থানের স্বার্থে বৃহত্তর সত্যটি বলেছিলেন ‘আঞ্চলিক’ ফিরিশতা, সম্রাটের সভাসদরা যা বলার সাহস করেননি।

আঞ্চলিক বহুমাত্রিকতাই হয়তো হিন্দুস্থানের প্রকৃত লুপ্ত সম্পদ। আঠারো শতকে আলেকজ়ান্ডার ডাও-এর অনুবাদ ফিরিশতার মহাগ্রন্থটি কেটেছেঁটে কেবল দিল্লির ইতিহাসে পর্যবসিত করে; মানানের চোখে সেই মুহূর্তেই হিন্দুস্থানের শেষ এবং ‘ইন্ডিয়ার’ শুরু। কিন্তু সেই হিন্দুস্থানের স্মৃতি ফেরাতে গেলে দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার পাশাপাশি ভারতভূমির বিভিন্ন জাতির সঙ্গে বৃহত্তর হিন্দুস্থানের সম্পর্কটিও বোঝা জরুরি। হাজার হোক, ‘আঞ্চলিক’ চিন্তকদের মধ্যেই কিছু দিন আগেও সেই হিন্দুস্থানের গভীর আবেদন ছিল, হয়তো আজও পুরো হারিয়ে যায়নি। তাই পঞ্জাবের ইকবাল হিন্দুস্থানকে নিয়ে এ কালের শ্রেষ্ঠ কাব্য লিখতে পারেন। বাংলার বিদ্রোহী কবি কল্পনা করেন, যে দিন হবে হিন্দু-মুসলমান ভাইয়ে ভাইয়ে মিলনের সকাল, ‘হাসবে সেদিন গরব ভরে এই হিন্দুস্থান’।

অন্য বিষয়গুলি:

India History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy