অতীত: বাগবাজার স্ট্রিটে বসু বাড়ির ঠাকুরদালান, প্রথম বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার নীলমণি মিত্র নির্মিত
মেময়ার্স অব রোডস/ ক্যালকাটা ফ্রম কলোনিয়াল আর্বানাইজেশন টু গ্লোবাল মডার্নাইজেশন
লেখক: সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
মূল্য: ৬৯৫.০০
প্রকাশক: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
যে কোনো শহরেরই পথ-ঘাটের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে থাকে সে শহরের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র, বিন্যাস। দীর্ঘকাল কলকাতার সদর-অন্দরের চর্চায় রত সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এবার হাত দিলেন সড়কের স্মৃতিকথায় প্রতিবিম্বিত কলকাতা শহরের কাল-আজ-পরশুর আখ্যানে।
কলকাতার রাস্তার ইতিহাস যেন এক একান্নবর্তী পরিবারের ইতিহাস। প্রপিতামহীদের থেকে ডালপালা বিস্তৃত হয়ে প্রজন্মভেদে বসবাসের ধরনধারণ, রীতিরেওয়াজ পাল্টানোর মধ্য দিয়েই শহর পেয়েছে তার বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক স্বাক্ষর। যোগাযোগ ব্যবস্থা সড়ক-কেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার পর থেকে শহরের জীবনকথা অনেকটাই সড়কের জীবনকথা— এ কথা অত্যুক্তি হবে না।
আদি তিনটি পথ— চিৎপুর রোড, সার্কুলার রোড এবং সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ— লম্বালম্বি যুক্ত করেছে শহরের উত্তর ও দক্ষিণকে। তবে এরা সুমন্তবাবুর আখ্যানের মূল চরিত্র নয়। এদের উল্লেখ করে লেখক চলে গিয়েছেন অন্য তিনটি পথের কথায়, যাদের বিস্তার শহরের আড়াআড়ি— ‘দিদিমা’ বাগবাজার স্ট্রিট, ‘ধাই মা’ থিয়েটার রোড এবং ‘বাঙালি মধ্যবিত্ত গেরস্থালি’ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ।
বাবুসংস্কৃতির চর্চার দীর্ঘকালীন অভ্যাসের ফলেই হয়ত লেখকের আলোচনার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে বাগবাজার স্ট্রিট— তার পুরনো থেকে নতুন হয়ে ওঠার বর্ণাঢ্য ইতিহাস। কেউ মনে করেন যে ক্যাপ্টেন চার্লস পেরিনের হুগলির তীরে বসতবাড়ি সংলগ্ন বিশাল বাগান থেকেই নামকরণ বাগবাজার। এ সম্পত্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে গেলে তা হয়ে ওঠে বারুদ তৈরির কারখানা। বাংলার নবাবের কোপদৃষ্টি পড়ায় এ অঞ্চল আর সাহেবদের কাছে নিশ্চিন্তির থাকল না। বাগবাজার অঞ্চলের তালুকদারি শোভাবাজারের দেবদের উপর ন্যস্ত হলে এখানে বসতি বাড়ে। শেঠ বসাকদের মতো ব্যবসায়ীর পরেই আসে বানিয়া দেওয়ানদের দল, আর সব শেষে আসে ফোর্ট উইলিয়াম তৈরির প্রয়োজনে গোবিন্দপুর অঞ্চল থেকে উৎখাত হওয়া বাঙালি ভূস্বামীরা, ক্ষতিপূরণের অর্থ হাতে করে। এঁরা শুধু নিজেদের বাড়িই বানাননি, নিজেদের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য বানিয়েছিলেন নিম্নশ্রেণীর শ্রমজীবী মানুষদের জন্য বস্তিও। গোবিন্দরাম মিত্র বা শিবচন্দ্রের মতো মানুষ যেমন হয়ে উঠেছিলেন উত্তর কলকাতার বাবু কালচারের প্রতিভূ, তেমনই গড়ে উঠেছিল হিন্দু কলেজের প্রভাবান্বিত ইঙ্গবঙ্গ সংস্কৃতির ধারক এক নতুন প্রজন্ম। বানিয়া মুৎসুদ্দিদের পড়তি অবস্থার সুযোগে মধ্যবিত্তরা বিভিন্ন অলিগলিতে তাদের কোঠাবাড়ি বানাতে থাকলে বাগবাজারের শরীরী বিন্যাস যেমন বদলায় তেমনই বদলায় তার চরিত্র। এক দিকে রামকৃষ্ণের বাসস্থানের নৈকট্য ও বিবেকানন্দ, নিবেদিতার উপস্থিতি অঞ্চলটিকে এক নতুন ধর্মীয়, নব্য শিক্ষার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অনুষঙ্গ দেয়, অন্য দিকে বস্তিবাসী মানুষদের জীবনযাপন, পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রভৃতি দেয় এক ভিন্ন রাজনীতির আবহ। কলকাতা শহরের অন্যান্য অঞ্চল যত দ্রুত পালটেছে, বাগবাজার স্ট্রিট তেমন নয়। আজও রয়ে গিয়েছে বেশ কিছু প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত পুরনো বাড়ি-ঘর, শরিকি মামলার কারণে যাদের সংস্কার সম্ভব নয়। এ জন্যই প্রোমোটার বাহিনী তত দ্রুত এ অঞ্চল ছেয়ে যেতে পারেনি। বাগবাজার স্ট্রিট আজও অনেকটাই পুরাকেলে।
পুবে মারাঠা ডিচ এবং পশ্চিমে চৌরঙ্গিকে ছুঁয়ে যে থিয়েটার রোড তা মূলত ইংরেজ অধ্যুষিত ঔপনিবেশিক শহরের ‘হোয়াইট টাউন’ সংস্কৃতির সাক্ষ্য। ১৮১৮-য় তৈরি একটি থিয়েটার কক্ষ থেকে রাস্তার নামকরণ হয় থিয়েটার রোড। পরে ১৯৬৪ সালে শেক্সপিয়রের তিনশোতম জন্মদিন উপলক্ষে নাম বদলে হয় ‘শেক্সপিয়র সরণি’। এই রাস্তার আশপাশে গড়ে ওঠা ছোট রাস্তাগুলো, যেমন উড বা ক্যামাক স্ট্রিট, সাহেবি আধিপত্যেরই স্বাক্ষর। এখানেও বিত্তবান অধিবাসীদের প্রয়োজনেই কলভিনের বস্তির মতোই বেশ কিছু বস্তি তৈরি হয়। ক্রমশ উচ্চ পদস্থ হিন্দু বাঙালি এবং বিত্তবান মুসলমানরাও এ অঞ্চলে জমি কিনতে থাকেন। সময়ের পথ বেয়ে ইংরেজদের সম্পত্তি আজ উত্তর ভারতীয় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের হস্তগত। নতুন ধরনের হাউজিং কমপ্লেক্স থাকলেও ইংরেজ, হিন্দু এবং মুসলমানদের নেমপ্লেট লাগানো কিছু পুরনো আমলের বাড়ি রয়ে গিয়েছে অঞ্চলের আদি কসমোপলিটান চরিত্রের অভিজ্ঞান হিসেবে। মিশ্র সংস্কৃতির ‘কিউরিয়ো শপ’ এ কালের শেক্সপিয়র সরণি। এক দিকে যেমন তৈরি হয়েছে স্পা, বিউটি সালোঁ বা অ্যাস্টরের মতো বড় হোটেল, অন্য দিকে রাস্তার ধারে বিবিধ শস্তা খাবারের দোকান।
বাগবাজার বা শেক্সপিয়র সরণির মতো রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-র সুদীর্ঘ ঐতিহ্য নেই। বিশ শতকের গোড়ার দিকে পৌর সংস্থা বর্জ্যজল-নিকাশীব্যবস্থার জন্য বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে কালীঘাট পর্যন্ত টানা একটি লম্বা জমি বেছে নেয় এবং সিআইটি এই নালার উপর প্রায় ৩০০ গজ লম্বা একটি রাস্তা বানিয়ে গড়িয়াহাটের সঙ্গে যুক্ত করে কালীঘাটকে। নাম হয় ‘মেন সিওয়ার রোড’। নামে নালার অনুষঙ্গ থাকায় যে সব শিক্ষিত বাঙালিরা এখানে বাস করতে আসেন তাঁদের স্বস্তি ছিল না। এঁদের উপর্যুপরি দরবারে ১৯৩১-এ রাস্তার নাম হয় রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। মূল রাস্তার সঙ্গে সংযুক্ত রাস্তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল একডালিয়া, ফার্ন এবং কাঁকুলিয়া রোড। বসবাস বাড়তে থাকলে স্কুল ছাড়াও সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্য চিন্তা থেকে তৈরি হয় লেক, লিলি পুল। বালিগঞ্জ স্টেশনের নৈকট্যের ফলে দক্ষিণের গ্রামীণ অঞ্চলের পসারিদের সঙ্গে সংযোগে জন্ম নেয় গড়িয়াহাট বা লেকমার্কেটের বাজার অঞ্চল। এ ছাড়া লেকমার্কেটের আশপাশে গড়ে ওঠা দক্ষিণ ভারতীয় মানুষের বসবাসের কারণে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি পেয়েছে এক ভিন্ন দক্ষিণী স্বাদ।
একটি বিষয় স্পষ্ট। শহরের ধারণ ক্ষমতা তার শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। আগেই তৈরি হয়েছিল সল্টলেকের বসতি। মধ্যবিত্তদের জন্য তৈরি হলেও হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় আজ তা বিত্তবানদের কবলে। এরপর রাজনীতিক, আমলা, এবং প্রোমোটার চক্রে রাজারহাটে লক্ষাধিক সাধারণ মানুষ হয়েছে গৃহ এবং জীবিকাহীন। এই নতুন সম্প্রসারিত কলকাতা স্পষ্টতই সম্পন্নদের। সাধারণ হাঁটাচলার রাস্তা কমে গিয়ে এখানে তৈরি হয়েছে ফ্লাইওভার, যার উপর দিয়ে একমাত্র গাড়ি করে যাওয়াই সম্ভব। ফ্লাইওভারের দু’পাশের বারোয়ারি জমি নিয়ে তৈরি হয়েছে গলফ কোর্স ও সুইমিংপুল যার উপর কেবল হাউজিং কমপ্লেক্সের মানুষেরই অধিকার। সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা বস্তুত অদৃশ্য। আক্ষেপের সুরেই লেখক বলেন যে এমন করেই তৈরি হবে আরও বাসভূমি যা দেখে আর কারও মনে পড়বে না কলকাতার আন্দোলনের, প্রতিবাদের সংস্কৃতির কথা।
গল্পকথা ও তথ্যের সুঠাম ভারসাম্যে পথের স্মৃতিকথার এই পরিবেশনা যে কোনও পাঠককেই আগ্রহী করে তুলতে পারে কলকাতার অলিগলি ঘুরে লেখকের দেখাকে মিলিয়ে নেওয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy