প্রবহমান: সারনাথের ধ্বংসাবশেষ উৎখনন করে উদ্ধার করা হচ্ছে অশোকস্তম্ভের শীর্ষদেশ। ছবি: ফ্রেডরিক ওর্টেল, ১৯০৫
দ্য কনসেপ্ট অব ভারতবর্ষ অ্যান্ড আদার এসেজ
লেখক: বি ডি চট্টোপাধ্যায়
৭৯৫.০০
পার্মানেন্ট ব্ল্যাক
ইতিহাসের ভাল স্কুল পাঠ্যপুস্তকের প্রভাব অনস্বীকার্য। কৈশোরেই অতীত সম্বন্ধে ধারণাগুলি এমন ভাবে মনে গেঁড়ে দেয়, যে পরে সেগুলি উপড়ে ফেলা বেশ শক্ত। গত শতকের ত্রিশের দশকে কালিদাস নাগ বেশ নামজাদা ইতিহাসবিদ ছিলেন, বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম প্রবক্তা, রাবীন্দ্রিক ভারতীয় চিন্তায় অনুপ্রাণিত এক গবেষক। ম্যাট্রিকুলেশন সিলেবাসের জন্য তাঁর লেখা স্বদেশ ও সভ্যতা বলে ইতিহাস বইটার জনপ্রিয়তা কে পি বসুর বীজগণিত বা যাদবচন্দ্র চক্রবর্তীর পাটিগণিত-এর তুলনায় কম ছিল না। মনে আছে যে ম্যাট্রিকুলেশনের পরে স্কুল ফাইনাল, এমনকী হায়ার সেকেন্ডারির পাঠ্যসূচির আমলেও নাগ মহাশয়ের বইটার কিছু অংশ পড়ার জন্য শিক্ষকরা বলতেন, বিশেষ করে প্রথম অধ্যায়টা পড়তে হত। বিষয় ভারতীয় সংস্কৃতির স্বরূপ, কী ভাবে ভারতবর্ষের ধারণা সেই বৈদিক ও পৌরাণিক কাল থেকে নানা বৈচিত্রের মধ্যে সংহত আকার পেয়েছে, কোন কোন প্রক্রিয়ায় আমাদের স্বদেশচিন্তায় ও সভ্যতার নির্মাণে ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ (‘unity in diversity’) সতত ক্রিয়াশীল। এমনকী প্রাক্বৈদিক সিন্ধুসভ্যতায় পাওয়া ‘নাসাগ্রনিবদ্ধ দৃষ্টি’ বিশিষ্ট যোগীমূর্তি বা নানা পশুবেষ্টিত আসনে উপবিষ্ট শৃঙ্গীমূর্তির মধ্যেও ভারতীয় সাধনার একটানি প্রবহমান ধারার নিদর্শন খুঁজে বার করা হত, ওই সব মুদ্রালাঞ্ছনের ছবিও বইয়ের পাতায় জাঁকালো ভাবে থাকত। আমরাও ভাল করে পড়ে প্রশ্নোত্তর তৈরি করতাম। বার্ষিক পরীক্ষায় অবধারিত দুটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে প্রথমেই থাকত, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস রচনার উপাদান বর্ণনা করো বা ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’-এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
তখন বড় একটা ভাবিনি। পরে ধীরে ধীরে, আর আজকে অনেকটা দায়ে পড়েই ভাবতে হচ্ছে, ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ জিগিরটা অনেকটা জপমন্ত্রের মতো, ভারতীয় ইতিহাসচর্চার এককালীন জাতীয়তাবাদী সূত্র। সূত্র তো ‘বিশ্বতোমুখ’। ফলে ‘বৈচিত্র’ ও ‘ঐক্য’-এর মধ্যে পাল্লাটা কার দিকে ভারী, কোন ঐতিহাসিক গুণটি অগ্রাধিকার পায়? পুরনো সূত্রটা কি আবার হালনাগাদ বদলে নতুন জিগিরে বিন্যস্ত হচ্ছে, ‘ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র’? ঐক্যের স্থিতি কোথায়, আকারই বা কী রকম, আকারে ফেরফার হয় কি? নানা বৈচিত্রের হাজারো দাবি কি ঐক্যের একটানি ছাঁচে ধরা পড়বে, সব ভেদাভেদ খাপ খাবে? মাঝে মাঝেই যৌথ স্বরগ্রামে কি বেখাপ্পা বা বেতালা কণ্ঠ শোনা যাবে না? ইতিহাসে কার্কশ্য বিচারও অপাংক্তেয় নয়। মনুবাদ ও স্বাতন্ত্র্যবাদও ইতিহাসসিদ্ধ, দুটিকেই চেনা, জানা ও বোঝা দরকার।
মোটামুটি ভাবে মৌর্য-উত্তর ভারত থেকে গুপ্ত-উত্তর ভারত তথা আদি মধ্যযুগের ভারতের নানা স্তরের ধারণায় ‘ভারতবর্ষ’-এর ধ্যানমূর্তি কী ভাবে গড়ে উঠছে, শব্দবন্ধটি তাৎকালিক চৈতন্যে কী কী অর্থ বহন করত, নামপ্রবন্ধে সেই প্রশ্নগুলি ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় আলোচনা করেছেন। আলোচ্য কালসীমায় রচিত বিষ্ণুপুরাণ-এর মতো একাধিক পুরাণে, রঘুবংশ-এর মতো কাব্যে ও কাব্য-মীমাংসা-র মতো অলঙ্কারশাস্ত্রে প্রযুক্ত শব্দসত্তাটির অনুপুঙ্খ বিচার করে প্রশ্নগুলির উত্তরও তিনি খুঁজেছেন। বইটি একটি প্রবন্ধসঙ্কলন। সঙ্কলনে নামপ্রবন্ধের অনুকারী একাধিক প্রবন্ধ আছে। বিষয়গুলি প্রকীর্ণ, যেমন অরণ্যক্ষেত্র ও জনপদক্ষেত্রের সম্পর্ক, বনচারী রাম ও অযোধ্যারাজ রামের আচরণে বৈচিত্র বিচার, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক উৎসবকথা বা নরকাসুরের কাহিনি বিচার। সব প্রবন্ধে মূল জিজ্ঞাসা অবশ্য একটি, ভারতীয় কৃষ্টির নানা প্রকাশে বৈচিত্র ও ঐক্যের সম্পর্ক ও স্বরূপ ঠিক কী রকম, কাল ও পাত্রভেদে পরিবর্তন হয় কি না?
সপ্তদ্বীপের অন্যতম জম্বুদ্বীপ আর জম্বুদ্বীপেই স্থিত ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষ— এক সৃষ্টিলোকের কল্পনা, ইসলামি ‘হফথ ইক্লিম’-এর তুল্য সপ্ত কল্পবিশ্বের অন্যতম। ক্ষেত্রবিশেষে দানব, রাক্ষস, মানব ও মাঝে মাঝে দেবযোনিরা স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে, দ্বীপবৈচিত্র স্রষ্টার সৃজন-ইচ্ছার প্রকাশ মাত্র। দেশের ধারণা নিছক প্রাকৃতিক বা লৌকিক নয়। সৃষ্টিলোকের কল্পপরিসর ভরানো হচ্ছে নানা প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষার পরিচিতিতে। কখনও কিছু অংশ পুণ্য দেবস্থান, কখনও বা গ্রাম, নিগম ও নগরে ভরপুর জনক্ষেত্র, দিশের দিশারি। এই দিশ্ বা দিক্ বা জনপদক্ষেত্রগুলি ভারতবর্ষ বলে দেশ ও লোকের নির্ণেয় ভিত্তিভূমি, নির্দিষ্ট কৌম ও গোত্র অধ্যুষিত। ভিত্তিভূমিগুলি নির্দিষ্ট ধর্মিষ্ঠ রীতি-রেওয়াজের পীঠস্থান, এ হেন স্থানগুলির অধিকারী অবশ্যই কোনও কৌম বা বংশের পরাক্রান্ত নেতা। ঐহিক ও পারত্রিক প্রত্যাশা ও পরম্পরার মানচিত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জনপদগুলির বাস্তব চরিত্র ও রীতি-রেওয়াজ ভিন্ন, কালানুক্রমিক তালিকারও হেরফের হয়, বংশানুক্রমিক নেতার বর্ণে ও মর্যাদাতেও বিপর্যাস ঘটে।
ইতিহাসবিদের মতে, বিপর্যাসের প্রক্রিয়াতে, উদ্বৃত্ত সম্পদ বণ্টনের বন্দোবস্তে, শাসনতন্ত্রের পরিশীলনে ও সাংস্কৃতিক প্রত্যাশা অনুযায়ী মৌর্য-উত্তর থেকে গুপ্ত-উত্তর ভারতে একাধিক আঞ্চলিক কেন্দ্র গড়ে ওঠে। নানা অঞ্চলের দৈনন্দিন অভ্যাস অনুযায়ী জীবনচর্যা ও চর্চার নানা রীতি দানা বাঁধে, যেমন, গৌড়ী, বৈদর্ভী, মাগধী ইত্যাদি। কেবল ভাষা বা সাহিত্যরচনায় নয়, নানা দেশাচারে, বিবাহ ও উত্তরাধিকার বিধিতে, এমনকী কামকলার রকমারি প্রকরণে দেশ ও গোষ্ঠীভেদে রীতিগুলি মান্যতা পেত বা বর্জিত হত। নানা আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলির অন্তঃস্থ বিবিধ জনপদ বা নাড়ুগুলির মধ্যে স্বচ্ছন্দ আদানপ্রদান চলত, বৃহত্তর উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথেও যাতায়াত রুদ্ধ ছিল না। ফলে ‘সঙ্কর’ বা মিশ্র বর্ণ, জাতি-আচার ও নানা রীতি দিনকে দিন জাঁকিয়ে বসে। ‘অর্ধমাগধী’র কথা তো আমাদের অজানা নয়, আর মাহিষ্মতী পুরীর নারীরা স্বভাববশতঃ স্বৈরিণী হতেন, কথায় আছে পুণ্য পাবক ওই পুরীকে রক্ষা করত। নানা ধরনের সাঙ্কর্য দেশজ কৃষ্টির নানা থাকে অবস্থান করত, থাক-বিন্যস্ত জনপদগুলির সঙ্কোচন ও প্রসারণই ভারতবর্ষ বলে খ্যাত ধারণাটির বস্তুলোক। অবশ্য ‘ধ্রুবা মধ্যমা দিশ’ বলে আদর্শ স্থান আছে, যজ্ঞাশ্রয়ী বর্ণাভিমানী ব্রাহ্মণ্য নীতিধর্মের আদর্শ ক্ষেত্ররূপ সেটি। তবে সময় বুঝে ক্ষেত্রটির দাবিদার কাশী, কোশল, মগধ বা কান্যকুব্জ যে কোনও জনপদই হতে পারত। একটি ব্রহ্মদেও গ্রামও তো শিষ্ট ভূখণ্ড। রীতির তারতম্যে ক্ষেত্রের মর্যাদার তারতম্য হতে পারে, লোকস্থিতিটি বাতিল হয় না। নানা কেন্দ্রের ব্যতিরেক ও অন্বয়েই গড়ে উঠত ভারতবর্ষ বলে বৃহৎ লোকস্থিতির অবয়বটা।
এই প্রবন্ধসঙ্কলনটির সম্পদ প্রাগজ্যোতিষপুর-কামরূপকে কেন্দ্র করে নরকাসুর সংক্রান্ত কিংবদন্তির আলোচনাটি। এই বিচারে কিংবদন্তিটির তথ্য যাচাই লেখকের অন্বিষ্ট নয়। বরং লোককথা, বংশপঞ্জি ও শিলালিপিতে উল্লিখিত প্রকীর্ণ সূত্রের প্রেক্ষিতে কালিকাপুরাণ-এ বর্ণিত নরকাসুরের কল্পকথার স্তরবিচার ও তাৎপর্যই ইতিহাসবিদ তুলে ধরেছেন। বরাহ অবতার ও ভূদেবীর পুত্র নরক বিষ্ণুপ্রসাদে ‘মানুষভাব’ নিয়ে কিরাতভূমি জয় করেন ও নায়িকা দেবী কামাখ্যার কৃপাধন্য হন। তাঁর শাসনে ধর্মবিহিত সব অনুষ্ঠানই সম্পন্ন হত। পরে অসুরভাবে অধঃপতিত হয়ে এই নরক কালগ্রাসে পড়ে। এ হেন কল্পকথার বিস্তার ও রকমফেরের অক্ষরেখা দিয়ে অসমের মতো প্রত্যন্তভূমিও সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক স্থিতিতে জায়গা পায়, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও রাজার পোষকতায় কিরাতভূমি ভারতের প্রধান শাক্তপীঠের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। দেশজ কথামাহাত্ম্যেই বৃহত্তর পরিসরের ধারণাকে পোক্ত করা হয়।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের সভাপতি রূপে লেখকপ্রদত্ত অভিভাষণটি এই সঙ্কলনের শেষ প্রবন্ধ। নানামুখী আঞ্চলিক কেন্দ্রের পোষকতায় বৈচিত্রের রঙিবিরঙি নকশিকাঁথার পক্ষে লেখকের সমর্থন স্পষ্ট। পূর্বসূরি হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, রমেশচন্দ্র মজুমদার ও রাধাগোবিন্দ বসাক ভারতীয় সংস্কৃতিতে কেন্দ্রাভিমুখী ‘একরাট’ হওয়ার সাধনার কথা বলেছিলেন। সম্প্রতি অসংখ্য শিলালিপি ও সাহিত্যের নিদর্শন বিচার করে প্রাচীন ভারতে রাজনৈতিক হিংসা ও আগ্রাসনের জবরদস্ত বিবৃতি উপীন্দর সিংহ লিখেছেন, দণ্ডপ্রিয় রাজশাসনেই যেন তর্কপ্রিয় সংস্কৃতাভিমানী ভারতীয় পণ্ডিতদের চিত্তস্ফূর্তি হত। ‘শক-যবন-পহ্লব নিসূদন’ একরাটদের কথা ব্রজদুলালের আদৌ অজানা নয়। তবে আজকের গোলকায়নের দিনে ক্রমবর্ধমান একমেটে সংস্কৃতিতে তিনি বিতৃষ্ণ, একরাটের বজ্রদাপটের চরিত্রবিচার তিনি বড় একটা করেননি। তাঁর ঝোঁক বরং ‘ফস্কা গেরো’র চরিত্র বিশ্লেষণে।
বৈচিত্রের ঐক্যসাধনা নানামুখী। যেমন এক পাত্র জলের মধ্যে হিরের আংটি পড়ে, জলের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে, কিন্তু আংটিকে আলাদা করে চেনা যায়, তোলাও যায়। আবার জলে চিনি গোলা হয়, জল মিষ্টি হয়ে ওঠে, চিনিকে আলাদা করা যায় না। ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র ফোটাতে সূর্য-উপাসক পারসি বণিক সম্প্রদায় ও শক বা গ্রিকদের মতো ‘যবন’ সম্প্রদায়ের ভূমিকা একেবারে আলাদা। মিশ্রণের ঘরানাতেও জোড়াতালি লাগে। আড়াআড়ি ভাবে প্রসারিত তামিল ভক্তি আন্দোলন থেকে জাত শুকনো ভাজা মালপোয়া বাংলার বৈষ্ণব মহোৎসবে রসালো মালপোয়ায় পরিণত হয়, দুটিই দেবভোগ্য ও স্বাদু। বিপরীতে ঐক্য-এর বৈচিত্র সাধনা একান্ত ও শুদ্ধবাদী; মেরুদণ্ড শক্তপোক্ত না হলে তো বৈচিত্রের সমবায় ঘনপিনদ্ধ হবে না, অবয়বী ছেতরে যাবে। তাই স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রতীক তো অশোকস্তম্ভ, শীর্ষে দর্পী সিংহের মূর্তি চেপে বসানো আছে। আজকের ভারতবর্ষের মতো ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে পক্ষাপক্ষ বিচার যে কোনও ইতিহাসলেখক ও ইতিহাসপাঠককে নিজের বুদ্ধি ও বোধ অনুযায়ী করতে হবে, সেই বিচার অনুযায়ী ঐতিহ্য ছেনে ঐক্যের ও বৈচিত্রের নিরত দ্বন্দ্বকথা শুনতে, বলতে ও লিখতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy