হোয়াট হ্যাপন্ড টু দ্য ভদ্রলোক
লেখক: পরিমল ঘোষ
১১৯৫.০০
প্রাইমাস বুকস
জন ব্রুমফিল্ড তাঁর বিশ শতকের বাংলায় এলিটদের বিরোধ সম্পর্কিত বইয়ে ভদ্রলোকদের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন সেই শ্রেণি হিসাবে যাঁদের চালচলন, সহবত, পোশাক, কথাবার্তা, বসবাসের ধরন, খাদ্যাভ্যাস, পেশা ও সঙ্গ ইত্যাদির মাধ্যমে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। ভদ্রলোকদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল তাঁদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক শোভনতা। ভদ্রলোকদের বাস্তব ও সংজ্ঞার মধ্যে অবশ্যই ভাল রকম পার্থক্য আছে, কিন্তু লেখক মোটামুটি এই সংজ্ঞা ধরেই এগিয়েছেন। তবে তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু উনিশ শতকের বাঙালি ভদ্রলোক নয় বরং বিশ শতকের পঞ্চাশ দশক থেকে উঠে আসা বাম-লিবারাল বাঙালি ভদ্রলোক। সংজ্ঞা ও বাস্তবের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তার দৃষ্টান্ত রয়েছে বাঙালি ভদ্রলোকদের আত্মসমালোচনায়। সেই আত্মসমালোচনার কথা দিয়ে বইটি শুরু। ভদ্রলোক সমাজ একদম প্রথম থেকেই নিজেদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা, বিদ্রুপ, উপহাস, সমালোচনা করেছে যার নিদর্শন যেমন হুতোম, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় আছে, তেমনই আধুনিক কালে সমর সেনের লেখায়ও আছে। এই ‘অলীক বাবু’রা অন্য স্তরের মানুষদের অনুকরণের পাত্রও হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। লেখক আত্মসমালোচনার দৃষ্টান্ত হিসাবে শিবরাম চক্রবর্তীর রচনাকে বেছে নিয়েছেন যদিও এ বিষয়ে শিবরামের চেয়ে শক্তিশালী লেখা পাওয়া যেত না এমন নয়। লেখক বলেছেন শিবরাম তাঁর ক্রিটিকে মেকি ভদ্রলোক এবং আসল ভদ্রলোকের পার্থক্য করতে চেয়েছেন। মজা হল, ভদ্রলোক কিন্তু সব সময় অর্ধেক মেকি এবং অর্ধেক আসল।
পরবর্তী অধ্যায়ে লেখক বাংলা নাটক বাম-লিবারাল ভদ্রলোকের প্রভাবে কী ভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ল তার বিবরণ দিয়েছেন। লেখকের মত হল, প্রথম যুগে গ্রুপ থিয়েটার যে সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির আদর্শ নিয়ে কাজ শুরু করেছিল সেই থিয়েটার ক্রমশ পার্টির থিয়েটারে পরিণত হল। বস্তুত এই পরিণতি বাম-লিবারাল ভদ্রলোকের বাস্তব চরিত্র চিনিয়ে দেয়, লেখক কিন্তু এ নিয়ে কোনও বিস্তারিত আলোচনায় যাননি। বইয়ে লেখক ‘মুসলমান ভদ্রলোক’ বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয় এবং এই প্রসঙ্গে কিছুটা ইতিহাসও তাঁকে আলোচনা করতে হয়েছে। ভদ্রলোককে হিন্দু বর্গের অন্তর্গত হিসাবেই ভাবা হয়েছে এবং ধর্মই মুসলমানদের ও ভদ্রলোকদের মধ্যে প্রাচীর তুলে দিয়েছে এমনই হল লেখকের মত। লেখক বাঙালির ফুটবল-প্রীতি এবং কী ভাবে ফুটবল এক লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হল সে বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সমস্যা হল ফুটবলের সঙ্গে ভদ্রলোকের তত যোগ নেই— ফুটবল বিশ্বের সব দেশেই শ্রমিকশ্রেণি, সাধারণ, অনভিজাত মানুষদের প্যাশন। খেলার মাঠে বাঙালি ভদ্রলোকদের খুঁজতে গেলে যেতে হবে ক্রিকেটের শুধুমাত্র টেস্ট ম্যাচের যুগে ইডেন গার্ডেনের ক্লাব হাউসে। ভারত তখন সব ম্যাচ মোটামুটি হারত, কিছু ড্র করত, কিন্তু ভদ্রলোকরা স্পোর্টসম্যান হিসাবে পাঁচ দিন খেলা এনজয় করতেন।
পরের দুটি অধ্যায়ে লেখক পর্যায়ক্রমে ডিটেকটিভ সাহিত্য ও তাঁর পাড়া নিয়ে আলোচনা করেছেন, যদিও এই দুটি বিষয়ের সঙ্গে ভদ্রলোকের সমাজতত্ত্ব সে ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। শেষ অধ্যায়ে ভদ্রলোকেরা কোথায় গেলেন এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি সঠিক ভাবেই বলেছেন, ভদ্রলোকশ্রেণি চিহ্নিত হত তাঁদের আচরণ, সহবত, শিষ্টতা, মার্জিত রুচি, ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। বামফ্রন্টের আমল থেকে নতুন যে নিম্নবিত্ত দোকানদার, সেলসম্যান, চাকরিজীবী, হকার ইত্যাদির বিস্ফোরণ ঘটল এবং এঁদের সঙ্গে গ্রামীণ কৃষকদের বিত্তশালী অংশের যোগাযোগের ফলে যে মানুষরা প্রভাবশালী হলেন লেখক তাঁদের ‘নতুন ভদ্রলোক’ আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে এটা হল ভদ্রলোকের লুম্পেনাইজেশন প্রক্রিয়ার ফল। তবে মনে হয় আজকের দিনে ‘ভদ্রলোক’ বর্গটিকে ইলাস্টিকের মতো টেনেহিঁচড়ে ‘নতুন ভদ্রলোক’ সংজ্ঞার কোনও প্রয়োজন নেই, এঁদের বিশ্বায়নের যুগে নতুন উপভোক্তা বললেই হয়।
কিন্তু কেন এমন হল এ বিষয়ে বোধহয় আরও একটু গভীর বিশ্লেষণে যাওয়া প্রয়োজন ছিল। প্রথমে বলতে হয় বাম-লিবারাল ভদ্রলোকেরা বামও ছিলেন না, লিবারালও ছিলেন না। এই সিংহচর্মাবৃত গর্দভদের আবরণ খসে পড়ে বামফ্রন্ট আমলেই যখন দেখা যায় এঁরা পুরনো ট্র্যাডিশন অনুযায়ী তৈরি হয়েছেন দলদাসবৃত্তির জন্য। এঁদের মধ্যে কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, চিত্রপরিচালক, অভিনেতা সকলেই ছিলেন। পরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হতেই এঁরাই আবার অন্য শাসক দলের দলদাসবৃত্তি করতে থাকেন। অন্য দিকে তথাকথিত বাম-লিবারালের অন্য একটি অংশ গ্রামগঞ্জে খুদে ডিক্টেটর রূপে রাজ্যশাসন করতে থাকেন। মনে রাখতে হবে উনিশ শতকে বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের জীবন কাটত দল ও দলপতির অধীনে। অনেকটা খাপ পঞ্চায়েতের ধাঁচে দলপতি ছিলেন দলস্থ সকলের জাতি, জীবন ও ধর্মের রক্ষক ও ভক্ষক। এই দল বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পার্টি হয়ে গেল, বাঙালি ভদ্রলোক দলদাসই থেকে গেলেন। দলাদলি ও দলদাসত্বের শিকড় বাঙালি ভদ্রলোকের সমাজজীবনের খুব গভীরে প্রোথিত। বাঙালি ভদ্রলোক নিজের সমাজ ও জীবনে দলকে অতিক্রম করতে পারেননি। এই শ্রেণি আটকে রয়েছে সেই দলাদলির কর্দমাক্ত জমিতে। লেখক বাঙালি ভদ্রলোকদের ক্রীড়াপ্রীতি নিয়ে যে আলোচনা করেছেন তার প্রধান আকর্ষণ কিন্তু দলাদলি করার সুযোগ, ক্ষুদ্রতাবর্জিত খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের প্রতি ভালবাসা নয়— বরং ঠিক বিপরীত। এই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণি আসলে দলের অধীনেই থাকতে অভ্যস্ত, দলের ছত্রছায়ায় এই ভদ্রলোকরা নিরাপদ বোধ করেন, নিজের স্বার্থকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে চান।
দলতন্ত্রের অধীন এই ভদ্রলোক সমাজ তাই কোনও ক্ষমতাই অর্জন করতে পারেনি। পরনির্ভর, পরমুখাপেক্ষী, দল, গোষ্ঠী, পার্টি-নির্ভর মানুষ কোনও ক্ষমতা অর্জন করতে পারে না। এই কারণে বাঙালি ভদ্রলোকেরা কোনও স্বাধীন নাগরিক সমাজ গড়ে তুলতে পারেননি। লেখক বিচ্ছিন্ন ভাবে দু’একবার এই একই কথা বলেছেন কিন্তু বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করেননি। হেগেল বলতেন একটা বয়সে মানুষকে পরিবারের গণ্ডি অতিক্রম করে নাগরিক সমাজ থেকে শিক্ষা নিতে হয়। কারণ তাঁর মত ছিল সমাজে এথিকস নির্মাণে নাগরিক সমাজের কেন্দ্রীয় ভূমিকা আছে। নাগরিক সমাজ গড়তে ব্যর্থতা, দলাদলি, দলের অধীনতা মেনে জীবনযাপন বাঙালি ভদ্রলোকদের শুধু ক্ষমতাহীন করে রাখেনি, আধুনিকও হতে দেয়নি। জ্ঞান বুদ্ধি মেধা যুক্তির মাধ্যমে যে অটোনমি ও ক্ষমতা অর্জন করা যায়, বাঙালি ভদ্রলোক সেটা কোনও দিন বোঝেননি এবং শেখেনওনি। এই গণ্ডি, এই বেড়ি ভেঙে বেরিয়ে আসতে গেলে দলতন্ত্রকে, দলদাসতন্ত্রকে বর্জন করার সাহস দেখাতে হয়। নিজের চিন্তাভাবনা যুক্তিবোধের উপর বিশ্বাস করার সাহস রাখতে হয়। এই সাহস বাঙালি ভদ্রলোক অর্জন করতে পারেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy