নিখুঁত: গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিক্যাল সার্ভের সময় ‘ক্যালকাটা বেসলাইন’ পরিমাপের কাজ চলছে। শিল্পী জেমস প্রিন্সেপ, ১৮৩২
রাধানাথ শিকদার অ্যান্ড কলোনিয়াল সায়েন্স/ অ্যান ইন্ডিয়ান সার্ভেজ অ্যান আনচার্টেড টেরেন
লেখক: আশীষ লাহিড়ী
৩৫০.০০
সাহিত্য সংসদ
রাধানাথ কি এভারেস্ট ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন? শৃঙ্গটির উচ্চতা মেপেছিলেন? তাঁকে কি প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, যেমনটা ছিল ব্রিটিশের দস্তুর? এই বিতর্কের প্রাথমিক ইন্ধন ১৯০৪-এ ‘নেচার’ পত্রিকায় সিডনি জেরাল্ড বারার্ডের নিবন্ধ ‘মাউন্ট এভারেস্ট: দ্য স্টোরি অব আ লং কনট্রোভার্সি’তে একটি মাত্র বাক্য। তার আগে মাত্র ১৯০৩-এই শিবনাথ শাস্ত্রী রামতনু লাহিড়ী…তে রাধানাথকে নিয়ে লিখেছেন, কিন্তু তেমন কোনও অভিযোগ আনেননি। বারার্ড লিখছেন: ১৮৫২ নাগাদ কলকাতার দফতরে কর্মরত প্রধান গণক, দেরাদুনে অবস্থানরত সার্ভেয়র-জেনারেল অ্যান্ড্রু ওয়া-কে জানালেন, ‘আ পিক ডেজিগনেটেড ‘XV’ হ্যাড বিন ফাউন্ড টু বি হায়ার দ্যান এনি আদার হিদারটু মেজারড ইন দি ওয়ার্ল্ড’। এই প্রধান গণকটি নিশ্চিত রাধানাথ শিকদার। ওদিকে ভারতে সার্ভের ইতিহাসের আকরগ্রন্থ, রেজিনাল্ড হেনরি ফিলিমোর-এর হিস্টোরিক্যাল রেকর্ডস অব দ্য সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র পঞ্চম খণ্ডে (১৯৬৪) রাধানাথের নাম করে জানানো হচ্ছে, এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা গণনায় তাঁর হাত নেই, কাজ চলেছিল দেরাদুনে, কিন্তু তিনি ততদিনে কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছেন। কোনটা সত্যি?
বারার্ডের লেখাটি বিতর্কের সম্ভাবনা জাগিয়েই চুপ, সেখানে ‘কনট্রোভার্সি’ এভারেস্ট শৃঙ্গের নামকরণ নিয়ে। রাধানাথ নিজে কয়েক আঁচড় লিখে গেলেও কথা ছিল। তাও অপ্রাপ্য। ফলে সাক্ষীসাবুদ যা জুটছে সমস্তই কম-বেশি পরোক্ষ। সেগুলির প্রতিটিকে ওজন করে সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। দীর্ঘ দিন ধরে রাধানাথ-জিজ্ঞাসু শ্রীলাহিড়ী সে কাজটি খুবই দক্ষতার সঙ্গে করে ইতিহাসের দাবি মিটিয়েছেন, বাঙালির আত্মগরিমায়ও স্বচ্ছতা এনেছেন।
জরিপ তথা শৃঙ্গের উচ্চতা নির্ণয়, সবই যৌথ কর্মযজ্ঞ। এভারেস্ট পরিমাপ কঠিনতর হয়েছিল নেপাল-ব্রিটিশ বৈরিতার কারণে, কাছে গিয়ে মাপ নেওয়া সম্ভব ছিল না। অত্যধিক দূরত্ব, বাতাসের ঘনত্বের তারতম্য, পৃথিবীপৃষ্ঠের বক্রতা ইত্যাদি প্রতিটা জিনিসের প্রভাব চোখে দেখা মাপজোখ থেকে আলাদা আলাদা ভাবে বাদ দিতে হত, নইলে গণনায় ভুল অবশ্যম্ভাবী। গণিত ও পদার্থবিদ্যা দুটোতেই পারদর্শিতা চাই। আর এই দুটো বিষয়েই রাধানাথ ছিলেন হিরের টুকরো, অনন্য। তাঁর ওপর জর্জ এভারেস্ট থেকে অ্যান্ড্রু ওয়া, এই দুই সার্ভেয়র-জেনারেলের নির্ভরতা ছিল অপরিমেয়, দুজনের কেউই তা এতটুকু গোপন করেননি। কাজেই কলকাতাতেই থাকুন আর দেরাদুনে, রাধানাথকে না ছুঁইয়ে কোনও গুরুত্বপূর্ণ গণনা গৃহীত হত না। এর স্বপক্ষে লেখক বহু প্রমাণ দিয়েছেন দিল্লির জাতীয় অভিলেখাগার ও অন্য নানা সূত্রে পাওয়া চিঠি, দফতরের মেমো ইত্যাদি থেকে। শ্রীলাহিড়ীর সিদ্ধান্ত: রাধানাথ অবশ্যই এভারেস্ট ‘আবিষ্কার’ করেননি, এমনও নয় যে চূড়ান্ত গণনাগুলো তিনিই একা হাতে করেছিলেন, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে রাধানাথকে কেন্দ্রে রেখেই গণনা-যজ্ঞ সম্পন্ন হত, এবং সেই সম্মিলিত উদ্যোগে ভর করেই অ্যান্ড্রু ওয়া পিক-ফিফটিনকে বিশ্বে সর্বোচ্চ বলে ঘোষণা করতে পেরেছিলেন। পরিষ্কার কথা।
রাধানাথের জীবন-ইতিহাসের অনেকটাই ঝাপসা। দু’টি উল্লেখ্য সাম্প্রতিক গ্রন্থ হল শঙ্করকুমার নাথের রাধানাথ শিকদার, তথ্যের আলোয় (২০১২)— রচনাবিন্যাসে আর-একটু পরিচ্ছন্নতা প্রত্যাশিত থাকলেও তা শ্রমলব্ধ তথ্যে পূর্ণ, এবং শ্রীলাহিড়ীরই দ্বিশতবর্ষে রাধানাথ শিকদার (২০১৩)। রাধানাথ-এভারেস্ট হেঁয়ালি এবং উপনিবেশীয় বিজ্ঞানে রাধানাথের স্থান— এই দুটি বিষয় আলোচ্য গ্রন্থের প্রধান অন্বিষ্ট। কলোনিয়াল সায়েন্স সংক্রান্ত তত্ত্বকাঠামোয় রাধানাথের মিশ্র অবস্থানটির কথা তিনি তুলেছেন এই গ্রন্থের প্রারম্ভিক আলোচনায়। শেষত রাধানাথকে তিনি সঙ্গত ভাবেই স্থাপন করেন আধুনিক ভারতীয় বিজ্ঞানের অগ্রদূত হিসাবে। তবে, ফলপ্রত্যাশী ব্যবহারিক গবেষণা— যা অনেকের মতে (যেমন দীপক কুমার, শ্রীলাহিড়ী তাঁর সমর্থক) উপনিবেশীয় বিজ্ঞানের সূচক, তাকে ছাপিয়ে কৌতূহলপ্রণোদিত অন্বেষণ— যার দেখা মেলে অতিক্রান্ত উপনিবেশে, তাতে বিশেষ কৃতিত্ব দেখানোর সুযোগ বোধহয় রাধানাথ পাননি। গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিক্যাল সার্ভেতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন মাত্রই ১৮ বছর বয়সে, এবং তাঁর অপরিমেয় কর্মশক্তি দুই সার্ভেয়র-জেনারেল নিংড়ে নিয়েছিলেন।
রাধানাথের প্রতি একটি নিশ্চিত বঞ্চনার ঘটনা হল থ্যুলিয়ার কর্তৃক ম্যানুয়াল অব সার্ভেয়িং ফর ইন্ডিয়া-র তৃতীয় সংস্করণ থেকে তাঁর অবদানটুকু রেখে স্বীকৃতি লোপাট করে দেওয়া, এবং তাও যখন তিনি আর জীবিত নেই। থ্যুলিয়ার ও রাধানাথের মধ্যে টাইম বল নিয়ে যে-ঘটনা থেকে অপ্রীতির সূচনা হয় বলে শ্রীলাহিড়ী লিখেছেন, তার কোনও তথ্যসূত্র এ বইতে দেওয়া নেই। ওদিকে, অজানা চৌধুরী-র (তৎসহ কেলকার, সেনশর্মা) লেখার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে ফোর্ট উইলিয়ামে টাইম বল চালু করার কাজটি ১৮৫২-র পরে রাধানাথের কৃতিত্ব বলে তিনি জানালেও প্রধান গণকের তত্ত্বাবধানে এই প্রথা চালু হয়েছিল ১৮৩৫-এই (ফিলিমোর, খণ্ড ৪, পৃ ১১৩)। সম্পাদকীয় অনবধানে চৌধুরীর নিবন্ধের বেশ কিছু অংশ হুবহু এই গ্রন্থে বসেছে, উদ্ধৃতিচিহ্ন বা স্বীকৃতি ছাড়াই। শ্রীলাহিড়ীকে ধন্যবাদ, তিনি কেবল এভারেস্ট-কেন্দ্রিক ভাবনায় আটকে না থেকে রাধানাথকে তাঁর কৃতিত্বের সমগ্রতায় বুঝে নিতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy