Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

তর্কের জায়গাও রইল খোলা

‘ভ্রমে-সম্ভ্রমে’ শীর্ষক দ্বিতীয় ভাগে স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতী, ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার, গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য, বাংলার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত নানামুখী প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথের আমেরিকা-ভ্রমণের পিছনে মার্কিন আমন্ত্রকদের চিঠি-চাপাটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে ভুল বোঝার কাহিনি রবীন্দ্র-আলোচক ও ইতিহাস-আলোচকদের কাছে একই সঙ্গে জরুরি।

মৈত্রী: ইন্দিরা গাঁধীকে স্বাগত জানাচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। তেজগাঁও বিমানবন্দর, ঢাকা। ১৯৭২

মৈত্রী: ইন্দিরা গাঁধীকে স্বাগত জানাচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। তেজগাঁও বিমানবন্দর, ঢাকা। ১৯৭২

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:৩৬
Share: Save:

মনোরথের ঠিকানা

দীপেশ চক্রবর্তী

৪৯০.০০

অনুষ্টুপ

অভিজ্ঞতা বলে, বাংলা ভাষায় হাতে গোনা কিছু বই আছে, যা পড়তে পড়তে একই সঙ্গে বোধবুদ্ধির ঝাঁপিটা বড় হতে থাকে, অথচ মনটা যেন হালকা হতে থাকে। দীপেশ চক্রবর্তীর নতুন বই পড়তে বসার আগেই আমার মন বলছিল, এ বই নিশ্চয় সেই বিরল সম্ভারের নতুন সদস্য হতে চলেছে! ঠিক তা-ই। আমাদের পরিচিত পরিমণ্ডলে দীপেশ চক্রবর্তী এক অনন্য পণ্ডিত, যিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টির বিভা ক্রমাগত ছড়িয়ে দিতে পারেন হালকা-ফুরফুরে গল্পচ্ছলের মধ্যে মধ্যেই। এবং সেটা পারেন ইংরেজি বাংলা দুই ভাষাতেই, সমান সহজতায়। তবে ইংরেজি তাঁর কাজের ভাষা, আর বাংলা তাঁর অবসরের ভাষা, তাই বাংলায় যখনই তাঁর কথা শোনার (বা, পড়ার, আগের ‘ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ নামক প্রবন্ধ-সংগ্রহে) সুযোগ হয়েছে, তখনই কথাটা আরও ভাল করে বুঝেছি। দীপেশ চক্রবর্তীকে যাঁরা চেনেন, তাঁরাই বুঝবেন কেন ‘মনোরথের ঠিকানা’ পড়তে গিয়ে বুদ্ধদেব বসুর ওই লাইনগুলো মনে পড়ল: ‘বলতে গেলে আড্ডার হাতেই আমি মানুষ। ...ছেলেবেলায় গুরুজনেরা আশঙ্কা করেছিলেন যে আড্ডায় আমার সর্বনাশ হবে, এখন দেখছি আড্ডায় আমার সর্বলাভ হলো।’

চার ভাগে বিন্যস্ত বইটি। প্রথম ভাগ ‘মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া’য় নিখাদ আড্ডা-মেজাজের দীপেশ চক্রবর্তীকে পূর্ণ ভাবে পাওয়া সম্ভব। তবে গম্ভীর রচনা ছাড়া যাঁরা তুষ্ট হন না, তাঁদেরকেও এই ভাগের ‘ভদ্রলোক প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধটি পড়তেই হবে। ‘ভদ্রলোক’ নামক বিশ্লেষণী গোত্রটি ইতিহাস সমাজতত্ত্ব ও কালচারাল স্টাডিজ়-এর সীমা ছাড়িয়ে এখন অ্যাকাডেমিক মহলের লৌকিক পদে পরিণত হলেও তা যে অহরহ কত ভুল ভাবে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে— এই কঠিন আলোচনাকে এত সহজ সুরে বাঁধতে পারেন দীপেশই। ওই যে অন্তর্দৃষ্টি আর ফুরফুরের সমন্বয়, ‘সময়ের আপন-পর’ তার একটি প্রতিনিধি-রচনা বলা যেতে পারে। সময়ের চেতনায় কত যে বিচিত্র সমন্বয় ও বিচ্ছেদের চিহ্ন বিধৃত, অতি-উপভোগ্য রবীন্দ্রনাথ ও কামিনী রায়ের আলোচনাটি তা তুলে ধরে।

‘ভ্রমে-সম্ভ্রমে’ শীর্ষক দ্বিতীয় ভাগে স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতী, ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার, গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য, বাংলার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত নানামুখী প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথের আমেরিকা-ভ্রমণের পিছনে মার্কিন আমন্ত্রকদের চিঠি-চাপাটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে ভুল বোঝার কাহিনি রবীন্দ্র-আলোচক ও ইতিহাস-আলোচকদের কাছে একই সঙ্গে জরুরি। এক দিকে এডউইন লিউইস ও অন্য দিকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হ্যারি জাডসন ও তাঁর সেক্রেটারি রবার্টসনের পত্রবিনিময়ের মধ্যে কেবল রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে অজ্ঞতাটুকুই তো ফুটে ওঠে না, তখনকার দিনের আমেরিকার ভারত-দর্শনও ধরা পড়ে। সে বড় করুণ দর্শন। সমাপনী অনুচ্ছেদে লেখক বলেন: ‘যে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় একসময় রবীন্দ্রনাথকে পাঁচটি বক্তৃতা দিতে গররাজি ছিল, সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ পৃথিবীতে ভারতবিদ্যাচর্চার অন্যতম পীঠস্থান।’ ঠিক সে রকমই, পরের প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী বিষয়ক ‘বিষণ্ণ চিঠি’র মধ্যে শুধু রবীন্দ্রনাথই উপস্থিত নন, আছে তাঁর সময়কার বাঙালি (বিদ্বৎ)সমাজের ছবিও— যে সমাজ তাঁকে গভীর বেদনাহত করত। একটা কথা না বলে পারছি না। বিশ্লেষণী প্রবন্ধ লেখার সময় প্রবন্ধকারের আবেগ-অনুভূতি তাতে না থাকাটাই সাধারণ দস্তুর। সেই দস্তুর থেকে বেরিয়ে এসেও— রবীন্দ্রনাথের ‘মন-খারাপের কাছাকাছি’ গিয়ে ‘বন্ধুত্বের লোভে’ তাঁর অবসাদের খোঁজখবর করার মধ্যেও যে কত তথ্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণ সম্ভব, এই প্রবন্ধটি তা আমাদের শেখাতে পারে। যদুনাথ সরকার প্রবন্ধটি বিষয়েও একই কথা বলব, যদিও ইতিমধ্যে আমরা দীপেশ চক্রবর্তীর যদুনাথ-বিষয়ক বইয়ে এই আবেগাঙ্কিত বিশ্লেষণের পূর্ণতর রূপটি দেখে ফেলেছি।

বঙ্গবন্ধুর আত্মকথা লেখাটির আলাদা উল্লেখ দরকার। বাংলার মুসলমান নেতার জাতীয়তা, ধর্ম ও আইডেন্টিটি নিয়ে উঁচু মানের প্রবন্ধ আজও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে কম। দীপেশ চক্রবর্তী বলেছেন বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র প্রকাশ বাংলার মুসলিম লিগ ও দেশভাগ বিষয়ে উৎসাহী গবেষকদের সাহায্য করবে। আর এ নিয়ে কিছু গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকায় আমার মনে হয়েছে, দীপেশ চক্রবর্তীর এই প্রবন্ধ আমাদের শেখাবে, দৃষ্টিতে কতখানি ভারসাম্য থাকলে বাঙালি মুসলমান নেতার আত্মকথা এ ভাবে পড়া যায়। বিশ শতকের প্রথমার্ধে রাজনীতি-করা বাঙালি মুসলিম যুবকের আদর্শগত উত্তরণই বা কোথায়, সীমাবদ্ধতাই বা কত রকমের, কোন্ ধারণাগুলি পরিবর্তনশীল, কোন্ ধারণাগুলি স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে স্বীকৃত কিংবা যুক্তিতে খণ্ডিত: এত ছোট পরিসরের লেখায় তার অসামান্য হদিশ।

‘ইতিহাসের কড়চা’ ও জনস্রোতে: নানান মতে’ শীর্ষক দুটি ভাগ এবং একেবারে শেষে সংকলিত সাক্ষাৎকার ‘আধুনিকতা: চেতনার অনুষঙ্গ’ একসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমেই বলি, এই অংশটি পড়তে গিয়ে বড় আক্ষেপ হয়— ছাত্রীজীবনে যদি প্রবন্ধগুলি পড়তে পেতাম! এই ভাবে তাত্ত্বিক খাঁজখোঁজ (বা ‘ইতিহাসের আলপথ’) আড্ডাচ্ছলে বুঝে নেওয়ার সুযোগ তো বড়-একটা আসে না। কত বিবিধ প্রসঙ্গ এখানে এসেছে, শুধু তার মোটের-উপর উল্লেখই সম্ভব। এসেছে সংস্কৃতির পাঠ বা কালচারাল স্টাডি়-র পাশ্চাত্য-প্রাচ্য দর্শনের কথা, ও সেই সূত্রে সভ্যতার বিবর্তন ও ধনতন্ত্রের আগমনের সঙ্গে তাল রেখে ‘মাস কালচার’-এর পরিবর্তনশীল রূপের কথা। তার যেন লেজুড় হিসেবে এসেছে জনসংস্কৃতির চর্চা ও ইতিহাসবিদ্যার সম্পর্ক। কমিউনিজ়মের পতনের আশেপাশের সময়ে লেখা ‘ইতিহাসের মৃত্যু?’ প্রবন্ধে পুঁজি, পণ্য সংস্কৃতি ও ইতিহাসচেতনার কথা। একেবারে শেষে তা পৌঁছেছে ইংরেজি ছাড়া দেশীয় বা মাতৃভাষায় ইতিহাসচর্চার সঙ্কট প্রসঙ্গে। এই প্রবন্ধ থেকে কয়েকটি লাইন তুলে দিতেই হয়: ‘অতীতচর্চার ক্ষেত্রে বাংলায় যে দু-এক জন শিল্পী বা কুশলী গদ্যকার নেই তা বলি না। কিন্তু তাঁরা আজ এক সংকীর্ণ সামাজিক পরিস্থিতিতে কাজ করছেন। ফলে প্রাবন্ধিক গদ্যের বিকাশের পথটি কঠিন।’ এ ছাড়াও এসেছে ক্রিস্টোফার বেইলি, জাক দেরিদা, এজাজ় আহমদের সূত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে ইতিহাস চর্চার ব্যাখ্যা।

সাব-অলটার্ন গোষ্ঠীর তারকা-ইতিহাসবিদ লিখছেন যখন, সাব-অলটার্ন স্টাডিজ়-কে কেন সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা বা অন্ধ স্বাদেশিকতা বলা যায় না, তা নিয়ে অভিমত আমরা পড়বই এ বইয়ে। ‘বিজেপি এসেছে বলেই কি চিন্তাভাবনার পাট চুকিয়ে দিয়ে সবাই মিলে দরবারি রাগে গাইতে হবে?’ প্রশ্নের পরই উত্তর শুনব, ‘বিজেপির লাভ হবে না ক্ষতি হবে, এটাই যদি আধুনিকতার ইতিহাস-জিজ্ঞাসার সত্য যাচাইয়ের চূড়ান্ত নিরিখ হয়, চিন্তার ভাণ্ডে শুধুই থাকবেন মা ভবানী!’ কিন্তু, তার পর, ‘কথালাপ’-এ এও পড়ব: ‘আজকের যে প্রবল বিজেপি জোয়ার, আমাকে সত্যি ভয় পাইয়ে দিয়েছে’। ‘নেহরুর ক্রিটিসিজ়ম করেই যদি এক জায়গায় সেকুলারিজ়ম করে লোক বাঁচাতে হয় তবে তাই করেই বাঁচাতে হবে। পিয়োরিটি-র জায়গা চলে গেছে... আমার নিজের এটা বিশ্বাস।’

সুতরাং, শুধু আড্ডা নয়, তর্কের জায়গাও রইল খোলা। পাঠকেরও অবকাশ রইল প্রশ্ন তোলার, স্বয়ং ইতিহাস-তাত্ত্বিককেও কি বিভিন্ন সময়ের কৌণিকতায় দেখা যায় তবে?

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review Monorather Thikana
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy