স্মৃতিকথা ও অন্যান্য
লেখক: প্রেমেন্দ্র মিত্র
মূল্য: ৬০০.০০
প্রকাশক: দে’জ পাবলিশিং
স্মৃতিকথা ‘নানা রঙে বোনা’ আর ‘অন্যান্য’ শীর্ষক প্রবন্ধ-নিবন্ধ এক অর্থে পরস্পরের পরিপূরক। লেখককে জানাচেনার জন্য ‘নানা প্রসঙ্গ’ এবং ‘অসংলগ্ন’র সাহিত্য-বহির্ভূত লেখাগুলো খুব জরুরি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের সাহিত্যিক পূর্বসূরি থেকে তাঁর সমকালীন সাহিত্যিক-সম্পাদক-চিন্তক-ভাষাবিদ্, রবীন্দ্রনাথ থেকে ভিনদেশি সাহিত্য, অতীত-বর্তমানের রাজনৈতিক, সমাজ-সংস্কারক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সব প্রসঙ্গই মিলবে প্রবন্ধ-নিবন্ধের উপাদানে। প্রাসঙ্গিক শিরোনাম নির্বাচন আর প্রবন্ধগুচ্ছের ক্রমবিন্যাস বেশ অর্থপূর্ণ। আলোচ্য গ্রন্থটি সুপরিকল্পিত। প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথম প্রকাশিত বাংলা গদ্য নোবেলজয়ী সাহিত্যিক জাসিন্তো বেনাভাঁৎ প্রসঙ্গে (পৃ. ২৭৫-২৭৭)। লেখাটির উপস্থিতি বইটিকে সাহিত্যের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বাড়তি মূল্য দিয়েছে।
কথকের সমকালকে বুঝবার পক্ষে, সেই কালকে পিছনে ফেলে অবধারিত যে অগ্রগমন, তার ভিতরকার উভটান, ফাঁকফোকর, সত্যি-অসত্যি অনুভব করার পক্ষে ‘নানা রঙের বোনা’র চলনটি বড় জুতসই। এ রোমন্থন যেন লেখকের নিজে শিখবার তাগিদে, পাঠককে শেখানোর দায় সেখানে নেই। অনুপুঙ্খের বিন্যাসেই স্মৃতিকথাটির পথ। প্রেমেন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প ‘শুধু কেরাণী’ এখানে গৌণ। গল্পটির মুহূর্ত কেমন করে এসেছিল লেখকের কাছে, সেই আপাততুচ্ছ অভিজ্ঞতার অন্তর্লীন মায়া আর মানবিকতাই মুখ্য (১১০-১১২)।
কল্লোল-কালিকলম-এর বিশিষ্টতা নয়, প্রাধান্য পেয়েছে মুরলীধর বসুর মতো আড়ালের মানুষের নীরব সাহিত্যসেবাকে সাহিত্যের ইতিহাসে গ্রথিত করার অঙ্গীকার (১৪৩)। মহাবিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার বা উপেন বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা পেরিয়ে মনে পড়ে বাল্যে দেখা আদীশ্বর ভট্টাচার্যের বজ্রগর্ভ প্রশান্তি (৬৩-৬৪)। স্মৃতির বুনটে মূর্ত হয় অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এক মন; যে-মন সমসাময়িক লেখকবন্ধুদের হারিয়ে যাওয়া সৃজন পরবর্তী পাঠকের কাছে বিছিয়ে দিতে আগ্রহী। অচিন্ত্য শৈলজানন্দকে নিয়ে স্বতন্ত্র প্রবন্ধও লেখেন প্রেমেন্দ্র (২২৫-২২৯, ২১২-২১৫)। সমকালের জনপ্রিয় সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গে খেদোক্তি তাঁর— ‘সহজ কৃতিত্ব তাঁর সত্যকারের কীর্তিকে... আড়াল করে আছে।’ (১৯৪)। মনের মানচিত্রে যেমন আছেন ভাস্কর দেবীপ্রসাদ বা জ্ঞানতপস্বী দীনেশচন্দ্র সেনের মতো স্বনামধন্যরা, তেমনই আছেন টেনদার মতো হৃদয়বান অসমবয়সি বন্ধু বা সুধাংশু মুখোপাধ্যায়ের মতো সংস্কৃতির সুহৃদ্। এসব মানুষের সঙ্গে পরিচিতি যে জীবনের উদ্বৃত্ত বাড়ায়, পাঠকের এমন বোধোদয় প্রেমেন্দ্রর স্মৃতিকথা বানিয়ে তোলে। সুধাংশু অর্থাৎ ‘সুধাদা’কে নিয়ে তাঁর ‘গল্পের বাইরে’ (২৬৫-২৭০) বড় সুন্দর লেখা।
ওই মানচিত্রেই তো নিরাবরণ পরিসর মেলে একবার-এটা-একবার-ওটা-র ফেরে অস্থির, খেয়ালি, অনিশ্চিত কিশোর কি যুবক প্রেমেন্দ্রের, তাঁর আলস্যের, দীর্ঘসূত্রিতার, হরেকরকম বই পড়ার তথা ইমপিরিয়াল লাইব্রেরির অভিজ্ঞতার, পরাধীন উপনিবেশের দুনিয়ায় জীবন আর জীবিকার মিলমিশ হওয়া-না-হওয়া প্রসঙ্গে বিচিত্র সব আলেখ্যের। যেন অবচেতনেই প্রেমেন্দ্র বুনে তুলেছেন নিজের সাহিত্যিক হয়ে ওঠার আখ্যান।
জীবনের প্রথম আকুল কান্নার স্মৃতি মিশে আছে এমন এক গল্প পড়ার সঙ্গে, যে-গল্পের নাম গিয়েছেন ভুলে, মনে আছে কেবল কাহিনিটাই। বাল্য যে কতখানি নির্দয় হতে পারে, তার প্রমাণ দেখি স্মৃতিকথায়, কথকের সাধের নিজস্ব চিড়িয়াখানা সহপাঠীদের দৌরাত্ম্যে বিনষ্ট হওয়ার বর্ণনায় (২৮-৩২)। ওই স্মৃতি কি বড় বেশি জাগরূক ছিল মনে, যখন অনেক পরে লিখেছিলেন ‘খোকার খেলনা’র মতো (৪৫০-৪৫২) অসামান্য নিবন্ধ? লালনের অছিলায় যে অসম্মান সাবালক নাবালককে করেন, অথবা সম্মানের অছিলায় যে অত্যাচার, তার থেকে মুক্তির ইঙ্গিত তবে এত স্বল্প পরিসরেও এমন অব্যর্থ হতে পারে? এরকম মন আর কলমই তো ‘রবীন্দ্রনাথ ও শিশু-সাহিত্য’র (৩০৬-৩১১) তুল্য সার্থক প্রবন্ধ রচনার অনুকূল। লেখার ছত্রে ছত্রে যেন ইংরেজি গীতাঞ্জলি-র ভূমিকায় ইয়ট্স্-এর সেই অনবদ্য পর্যবেক্ষণের অনুররণ— রবি ঠাকুর যখন শিশুর কথা বলেন, তখন যেন তিনি ঋষির কথাও বলেন।
স্মৃতিকথা আর প্রবন্ধ-নিবন্ধরা একে অন্যের সুরে সুর মিলিয়ে যে বিশিষ্ট মনের হদিশ পাঠককে দেয়, তা আজ আর বড় সুলভ নয়। এমন মনের জরুরত যদি একুশ শতকের নতুন পাঠক আবিষ্কার করতে পারেন, তাকে হয়তো বলা যাবে তেলেনাপোতা আবিষ্কারের সার্থক উত্তরপর্ব। স্মৃতিকথা ও অন্যান্য তেমন সার্থকতার পথ দেখিয়েছে। বাকি দায় পাঠকের, তার মন-মর্জির, তার পরিপার্শ্বের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy