Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

গ্রামীণ জীবনের গহন ধারা

একবার কথায় কথায় এই বৃহত্তর মেদিনীপুরেরই একজন মৃৎশিল্পী তাঁর কাজ নিয়ে বলছিলেন, ‘বতর ঠিক রাখতে হয়’। কথাটা ছিল— কতটা শুকোলে পোড়ামাটির তুলসীমঞ্চে মূর্তিগুলো ঠিকঠাক তৈরি হবে, খাপ খাবে। তেমনই বতর ঠিক রেখেই মাটির মৃদঙ্গ উপন্যাসের গড়ন তৈরি করেছেন নলিনী বেরা।

দীপঙ্কর ঘোষ  
শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

মাটির মৃদঙ্গ

লেখক: নলিনী বেরা

২৫০.০০

দে’জ পাবলিশিং

গ্রাম তো শুধু নিস্তরঙ্গ, অমলিন, ধুলো-পায়ের যাত্রাপথ নয়। গ্রামে মুখে মুখে শব্দ ঘোরে, কথা চলে; প্রকৃতির নিস্তব্ধতায় নদীর বয়ে যাওয়ার মতো আছে— মানুষের যাপনের প্রাত্যহিকতা। কখনও কথায় কথায় কাহিনিও গড়ে ওঠে। এমনই এক গ্রামীণ চৌহদ্দির ভিত্তিভূমি এই উপন্যাসের পরিসর। বোলচাল, আদবকায়দা, পেশা, সম্পর্কের দোলাচলের মধ্যে সুবর্ণরেখা নদীর অদূরে বাছুরখোঁয়াড় গ্রামটিও আছে বাস্তবে। কথা-কাহিনিতে এমন গ্রামীণ জীবনের গহন ধারা বয়েই চলে।

বাস্তব থেকে কাহিনিতে উঠে আসা এ গ্রামেই কেতাদুরস্ত দাদা আর বোন এসেছে বাইকে চেপে; সেই ওডিশার বারিপদার কাছে মুরুডা গ্রাম থেকে। মামাবাড়ির গ্রাম হলেও বোনেরই পাত্র খুঁজতে বাংলার এই কুম্ভকার-প্রধান গ্রামে আসা। এর মধ্যে হঠাৎ ওডিয়া ফুটানিতে বোন বলে ফেলেছে— ‘ভাই, আমে যে মনিষকু বাহা হেবি সে হেব তুমর পরি ভল-অ ও সুন্দর-অ।’ ওডিয়া ভাষার এক বাক্যই আলোড়ন তুলে দিল বাংলার এই গ্রামে। অর্থাৎ— ভাই, আমি যাকে বিয়ে করব সে হবে তোমার মতো ভাল ও সুন্দর। শব্দের ব্যঞ্জনায় কখনও অলক্ষ্যে তরঙ্গ ওঠে যা জনসংস্কৃতির অন্য কাঠামো গড়ে তোলে।

একবার কথায় কথায় এই বৃহত্তর মেদিনীপুরেরই একজন মৃৎশিল্পী তাঁর কাজ নিয়ে বলছিলেন, ‘বতর ঠিক রাখতে হয়’। কথাটা ছিল— কতটা শুকোলে পোড়ামাটির তুলসীমঞ্চে মূর্তিগুলো ঠিকঠাক তৈরি হবে, খাপ খাবে। তেমনই বতর ঠিক রেখেই মাটির মৃদঙ্গ উপন্যাসের গড়ন তৈরি করেছেন নলিনী বেরা। এ কাহিনিতে শব্দের টানাপড়েন আছে; আছে ছড়া, কাব্যকাহিনি, শুভঙ্করের আর্যা, ওডিয়া ছন্দ, সাঁওতালি গান আর আঞ্চলিক কথ্য ভাষাশৈলী। অনেক চরিত্র নিয়ে নলিনী নিরন্তর কথা বলে গিয়েছেন— সূত্র ধরে লোকায়ত শাখাপ্রশাখায় বিচরণ করেছেন। সেটা গ্রামসমাজের ভাবনার মধ্যে রৈখিক গতিতে নয়, অনেক স্তরে স্তরে; গাছপালা, মাঠ-প্রান্তর, গ্রাম, হাট, নদী, পাতালফোঁড়া ঝর্না, মাটিশালা, পোয়ানশালা বা হরিবাসরে সংকীর্তনের মধ্যে অন্য উষ্ণতা খুঁজেছেন। ভৌগোলিক ব্যাপ্তিতে তা দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিনতায় কুম্ভকার জাতিগোষ্ঠীর সমাজ-সম্পর্ক। মাটির কাজের কারিগরি খতিয়ান মেশা এই কথালাপের মগ্ন-অন্বেষণে উন্মোচিত অন্য এক জগৎ।

এই মগ্নতার মধ্যে নিত্য দিনের যাপনের অন্তররূপ ধরা পড়ে। কখনও বা মনে হয় তথ্য-নিবন্ধীকরণের ধাঁচে সংলাপই এ কাহিনির অলিগলির সন্ধান। তাই ক্ষেত্র-অন্বেষণে গবেষণার ছাপ থাকলেও, লেখকের আত্মস্থ অভিজ্ঞতাই কথাসাহিত্যের সম্পদ হয়েছে। গ্রামের কুম্ভকার আর সাঁওতালদের সম্পর্ক, সাঁওতালি ‘ঠার’-এ গল্পগুজব সবই চলে এখানে। চিনিবাস কুম্ভকারের পুখরি-আড়ার ঘাট-পাথর নাকি মাঝে মাঝে উড়ে যায়— সে সব কি কেউ দেখতে পায়? এই দেখা আর না-দেখার মধ্যেই কল্পজগৎ আছে। কুম্ভকার মাটি দিয়ে খোল বা মৃদঙ্গ গড়ে— পুড়ে তা স্থায়ী রূপ পায়, চামড়ার তালবাদ্য তৈরি হয়, তারপরই শব্দের তাল ওঠে। চিড়িয়া-চিড়িয়ানি পালা, শীতলামঙ্গল গান, বালক-সংগীতের লোকায়ত সুর-ছন্দের সঙ্গে মিলে যায় কেশিয়াড়ি বা কুলটিকরি হাট থেকে ফেরার পথে হাটসঙ্গীদের হাসিঠাট্টার কথা, যাতে অনেক গ্রামসমাজেরই অন্দরমহল দেখা যায়। সুবর্ণরেখা নদীর এপার-ওপারের নানা গ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে এই বাছুরখোঁয়াড়ের সমাজকাঠামোর কাহিনি তৈরি হয়েছে। আট অধ্যায়ে সম্পূর্ণ এই উপন্যাসে ছড়া-কাব্য-গীতের নানা উদ্ধৃতি। তবে এ সবের সূত্র উল্লেখের প্রয়োজন থেকেই যায়। আর কথাকারের বয়ানে আঞ্চলিক শব্দার্থ তো নলিনীর অধিকৃত— তা দিতেই পারতেন। কারণ, বহু শব্দ তো বাংলায় সর্বজনীন মান্যতা পায় না। ‘মানি’, ‘তয়ারি’, ‘বরহই’, ‘কুলুপখাড়ি’, ‘কুকার’— এমন নানা শব্দের অর্থ কি সাধারণ ভাবে সবাই জানেন? না কি, এ সব অর্থের অস্পষ্টতায় পাঠক বুঁদ হয়ে কাহিনিতে আরও গভীরতার খোঁজ করবেন? ফিন্‌-ফোটা জ্যোৎস্নার কথা বহু ব্যবহৃত হতে হতে তা স্পষ্ট হতে পারে, তবে ভিন্ন ভিন্ন বানানে তা আবার জটিলতাও তৈরি করে। এমন বানানভেদও কিছু আছে। বড় পাত্র তৈরিতে খাঁজকাটা পিটনার চাপে যে নকশি-কাটা ছাপ পড়ে, তেমন ছোট ছোট মুহূর্ত তৈরি হয়েছে কাহিনি জুড়ে। আবার, ঘুরন্ত চাকের মতো সরল বিমূর্ততাই এই উপন্যাসের অন্তঃকাঠামো।

উপন্যাসের এই পটভূমিতে কল্পনার বুনন ফুলকারি নকশার মতো বিস্তারি সমাজদর্পণ তৈরি করে। এমনই এক প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে— ‘‘ফিন্‌-ফোটা জ্যোৎস্নায় আজ কুম্ভকারপল্লীতে ও তার মাঠে-ঘাটে কী সব হচ্ছে? একে তো উড়িয়া ছোঁড়া-ছেমড়ীরা ঢেউ তুলে দিয়েছে গোটা গ্রামটায়, তার উপর দিনক্ষণ তিথিনক্ষত্র বিবেচনা করে জমি-জরীপে নেমে পড়েছে কোকিল কুম্‌হার, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চেইন টানাটানি করছে গরুড়ধ্বজ কুম্‌হার আর নেপাল কুম্‌হার! ঢড়হার ভিতর রোদন করে চলেছে কালা-মুহী, বালি চালাচালি করতে বসেছে বসন্তর পিসি, যে কোনও মুহূর্তে কাঁধে গাগরা নিয়ে ঢলাঢলি করে হাসতে হাসতে ভুড়ভুড়ি-ঝর্ণার জলে এখন নামলেও নামতে পারে ‘সাতভউনী’।’’এ কাহিনির চলাচল তাই অনেক গ্রামীণ মানুষের নিবিড় ক্রিয়াশীল আত্মবিশ্লেষণের পরিক্রমা। আর, যদি যাওয়া যায় বাস্তব পটভূমিতে? সে সব দৃশ্য কি মেলে— না কি অস্পষ্টতার মোহভঙ্গে জড়িয়ে পড়ে মন? বাছুরখোঁয়াড়ের বাঁধানো রাস্তার মাঝে হরিবাসরে বা পুবপাড়ার মাটির কাজে ব্যস্ত লোকজনের সঙ্গে আলাপে আলাপে বোঝা যায়, এমন কথাকাহিনি গড়ে ওঠার চমৎকারিত্ব। এই আঙিনায় দারিদ্র, আশঙ্কা, আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই আশাবাদের টান থেকে যায়। তাই মাটিখানার মাটি ফুরোলে যেমন কুম্ভকার খাবে কী, তেমনই জঙ্গলের কাঠ শেষ হলে সে হাঁড়ি পোড়াবে কী দিয়ে? এমন প্রশ্ন উঠলেও, তা তো ফুরোয় না, বালিনালার বালি ফি-বর্ষায় বাড়ে বই কমে না। মানুষের মনেও থেকে যায় নানা অভীপ্সা। যেমন এ গ্রামের কুম্ভকার বিচারসভায় কুলডিহা গ্রামের কুম্ভকার আর নদিয়ার কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পী জি পাল বা গোপেশ্বর পালের নাম উচ্চারণ না করে হয় না। হাওয়ায় হাওয়ায় লতায় পাতায় ভেসে আসা নামও জায়গা করে নেয়। এই আখ্যানের অবসরে এলাকার রামেশ্বর মন্দির, বেলপাহাড়ির লালজল পাহাড়ের গুহা, আষাঢ়ে কানাইসর পাহাড়ের পুজো আর ছোট্ট নদী ডুলুং-এর বড় খাদে মেশা বহমান সুবর্ণরৈখিক সংস্কৃতির ইতিহাস, প্রকৃতি আর কুম্ভকার সমাজের দিবানিশির স্বরলিপি তৈরি হয়েছে।

বাংলার পেশাভিত্তিক সমাজচিত্রণের এমন বয়ানে আর বর্ণনাতেই আছে উপন্যাসের বাস্তবতার খোঁজ। লেখকের অভিমতের অনুসারী হয়ে, প্রাচীন কুম্ভকারদের ইতিহাস বা বাছুরখোঁয়াড়ের সংস্কৃতি আগামীর সন্ধানে মিলবে হয়তো-বা। এমন নানাস্তরীয় প্রেক্ষাপটে এ উপন্যাসের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। চাঁদনি আলোয় ভেসে যাওয়া পল্লিগ্রামের নিহিত জীবনের মতো— ভেসে থাকে কথাসাহিত্যের অন্তর্দীপ্তি আকাঙ্ক্ষা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy