স্বাধীনতা: ভারতের জাতীয় পতাকা হাতে ছিটমহলের অধিবাসীরা। মশালডাঙা, কোচবিহার। ৩১ জুলাই ২০১৫
কুমারী মেঘের দেশ চাই
অমর মিত্র
৩৫০.০০
দে’জ পাবলিশিং
‘‘এই পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ আছে, যে দেশের কোনো দেশই নেই’’ (পৃ ২৪); সে-দেশের অন্তঃসত্ত্বা বউ সন্তানপ্রসবের জন্য যদি নিকটতম হাসপাতালে যায়, সে-হাসপাতাল ভর্তি নেয় না তাকে। কারণ সে হাসপাতালের দেশের বাসিন্দা নয়। সেই দেশহীন দেশের মেয়ে, যতই মেধাবী হোক, মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম সে পূরণ করতে পারে না তার আসল বাবার পরিচয় দিলে। কারণ বিদ্যালয়ের বা পরীক্ষক সংস্থার দেশে ওই বাবা-মেয়ে ভিনদেশি। হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে, দেশহীন দেশের বউকে এমন একজন প্রায় অপরিচিত পুরুষের স্ত্রীর পরিচয়ে ভর্তি হতে হয়, যে-পুরুষ ওই হাসপাতালের দেশের স্বীকৃত অধিবাসী। হাসপাতালের কার্ডে সেই অচেনা পুরুষটির নাম থাকে সদ্যোজাত শিশুটির জনক হিসেবে। এই ভাবে আসন্নপ্রসবার স্বামীর পরিচয়, পরীক্ষার্থীর বাবার পরিচয়, এ সব বিক্রি হয় অর্থের বিনিময়ে। ইন্ডিয়ার ভিতরকার বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের মধ্যেকার ইন্ডিয়ার অধিবাসী যাঁরা, সেই ছিটমহলের বাসিন্দার ঘরের মেয়েকে যদি তুলে নিয়ে যায়, যদি বেইজ্জত হয় সেই মেয়ে, নিকটতম থানা কিন্তু নালিশ শুনবে না। কারণ দেশবিহীন ছিটের মেয়েকে থানার দেশ দেশবাসী বলে মানে না। ২০১৫-র জুলাই-অগস্টে ছিটমহল স্বাধীনতা পেল। তার আগে থেকেই অমর মিত্র ভারতের মধ্যেকার বাংলাদেশ-ছিটমহলকে আর বাংলাদেশের অন্তর্গত ভারত-ছিটমহলকে নিজের সাহিত্যিক চিন্তার অঙ্গাঙ্গী করে তুলেছেন। দীর্ঘ দিন ধরে দু’দিকের ছিটমহলবাসীদের নিরালম্ব, অনিশ্চিত দৈনন্দিনকে অনুভব করেছেন। আলোচ্য উপন্যাসের ‘ভূমিকা’য় ন্যায্যতই লিখেছেন তিনি, ‘‘...ছিটমহলের জন্ম নিয়ে সীমান্ত ঘিরে কত কিংবদন্তি, ইতিহাসের সত্যমিথ্যা... খুঁজে খুঁজে বের করতে চেয়েছি। ... নিজে যদি অনুভব না করি ভিতর থেকে, উপন্যাস লেখা হয় না। উপন্যাস শুধুই বাস্তবতার চর্চা নয়।’’ (পৃ ৮)
এই অনুভবের কথাটাই উপন্যাসে মুখ্য। তার সুবাদেই তো বিনি সুতোর মালায় গায়ে-গায়ে গাঁথা হয়ে যায় একশো পাঁচ বছরের ছিটমহলবাসী সাগির আলির অতীত রোমন্থন আর ছিটের ষোলো বছরের কিশোরী জিন্নতের দেখা যাত্রাপালার অভিজ্ঞতা। কোচবিহারের স্বাধীনতা হারানোর ইতিহাস উপন্যাসে ফিরে ফিরে ছায়া ফেলে। উপেন্দ্রনারায়ণ, মুঘল ফৌজদার সৌলর জং, বিশ্বাসঘাতক দীননারায়ণ কি ইতিহাসের চরিত্র না সাম্প্রতিকের লোকজন, যাত্রাপালার চরিত্র না বাস্তবের অংশীদার— এই নীরব সওয়াল-জবাব সরব আখ্যানের পরতে পরতে বিছিয়ে দেন লেখক। অতীত-বর্তমানের ক্রমকে ভেঙেচুরে এই যে চলন কাহিনির, তার অন্বিষ্ট তো একটিই! যে-মেধাবী ছাত্রীকে পরীক্ষায় বসতে গেলে মিথ্যে পিতৃপরিচয় জোটাতে হয়, যে যুবতীকে সন্তান প্রসব করতে গেলে সাজতে হয় অপরিচিত পুরুষের বৌ, তারা সবাই অতীতের ভার বহন করে বিনা দোষে। তাদের অনিশ্চিত জীবনের উপরে, অপমানিত যৌবনের উপরে যে কোনও মুহূর্তে নেমে আসতে পারে চরম বিপর্যয়। যে-ইতিহাসের সুবাদে এ-উপন্যাসের লেখক পাঠক স্বাধীন দেশের স্বীকৃত নাগরিক, সেই একই ইতিহাসের মারে বাঁধা সায়মা অথবা জিন্নতের নিরুদ্দেশ জীবন! ইতিহাস-নির্দিষ্ট এই বিভেদের অনাচার যে অতলান্ত যন্ত্রণার উপাদান, সে-কথাটা পাঠকের মনে চারিয়ে দেওয়াই তো এমন আখ্যানের অন্বিষ্ট!
‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’ থেকে ‘চোখ আর নদীর জল’ হয়ে অন্তিম পর্ব ‘কুমারী মেঘের দেশ নাই’তে পৌঁছনো। ভুবন সেন ছিটমহলকে দেশ অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন। সায়মা ইন্ডিয়া পেয়েছে, নিয়তি পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু জিন্নতের পড়ালেখার সাধ মেটেনি, মশালডাঙায় ইন্ডিয়ার পতাকা উড়বার আগেই উজারা হয়ে গিয়েছে জবার মতো সাহসী মেয়ে। শাদির নামে পাচার হয়ে যাওয়া রূপসী ফতিমার মা হেরাতুন দাই আর লোপাট হয়ে যাওয়া জবার বুড়ি মা যে উপন্যাস জুড়ে খুঁজে বেড়ায় হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের, সেই নিরুদ্দেশ যাত্রা কি ‘চাই’ থেকে ‘নাই’তে পৌঁছে দেয় পাঠককে? পতাকার প্রতীকে যে দেশের প্রতিমা ধরা দেয় না সচরাচর! অন্তত ইতিহাস তেমনই বলে, যদি সে ইতিহাসের ভাষা অনুভবরিক্ত না হয়; এই মর্মান্তিক সত্যিকে পাশ কাটিয়ে কোনও ইচ্ছাপূরণে ভর করেননি ঔপন্যাসিক।
রাজাকার হওয়ার স্মৃতিতে আচ্ছন্ন যে লোক তার স্বপ্নের পাকিস্তান ফিরে চায়, তার চোখের জলও জায়গা পায় এ আখ্যানে। আবার ছিটের জমি ইন্ডিয়ায় এসে গেলে সে-জমির গায়ে লাগবে জোত-জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনের বালাই। ছিট তবে ছিটই থেকে যাক, এমন কামনারও হদিস মেলে। বিচিত্র সব মন-মননের কিংবা মননহীনতার কিনার ধরে পথ চলতে চলতে লেখক দেখেন, বিভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষা, কত শত হতাশা-হাহুতাশ, বিকৃত, অমানবিক আচরণ আবার মানবিক অসহায়তা— সবই তো ছিটমহলের জীবনপ্রবাহ বহন করছে ইতিহাসের মারে মরতে মরতে। শয়ে শয়ে বিঘে জমির নিশ্চিত মালিকানা বনাম নিজ দেশের আকাঙ্ক্ষা, পাকিস্তানের স্বপ্ন বনাম ভারতীয় বা বাংলাদেশি পরিচয় স্পর্শ করবার আকুলতা— এমন সব অসহায় স্ববিরোধের সূচনা তো সেই কবে, যখন, ‘‘বাউন্ডারি কমিশনের প্রধান... র্যাডক্লিফ অবিভক্ত বঙ্গের উত্তর অংশকে বুঝতে চেষ্টা করেননি। মানচিত্রে দাগ মেরে কি দেশটিকে ভাগ করা যায়?’’ (পৃ ১৮৫)
কলমের আঁচড়ে দেশ বদলে যাওয়ার যন্ত্রণাকে ছিটমহল-অন্বেষণে চিহ্নিত করতে করতে অমর মিত্র খুঁজে পান তাঁর বিমলেশকে; যে-সাংবাদিক ছিটের ইতিহাস খুঁজতে এসে বার বার দেখা পায় জীবনে কোনও দিন না-দেখা, শুধুমাত্র মায়ের বর্ণনায় বিন্যস্ত তার দাদামশায়কে। পঁয়তাল্লিশের পরে দাদামশায়ের বয়স আর বাড়তে পারেনি। সেই পঁয়তাল্লিশ বছরের মিতভাষীকে আজ বাষট্টির বিমলেশ বার বার দেখে নিজের ছিট সংলগ্ন যাত্রাপথে। ছিটের আশেপাশে অধুনা বাংলাদেশে ছিল বিমলেশের নির্মাতার পিতৃকুল, মাতৃকুল, উভয়েরই নিজবাসভূমি। কিন্তু অশ্রুসজল, স্মৃতিমেদুরতার পক্ষে বিমলেশের বা অমর মিত্রের যাত্রাপথ বড় বেশি প্রখর, আধুনিক। তাই তো শতায়ু আজগর আলির কথকতায় শুনি, আলিবাবার জমানা কত শান্তির ছিল আধুনিক পৃথিবীর তুলনায়। আলিবাবার দুয়ারে যে-ঢ্যাঁড়া এঁকেছিল দস্যু, তার দলকে ও-বাড়ি চেনাবে বলে, সে-ঢ্যাঁড়া দুয়ারে দুয়ারে ছড়িয়ে মর্জিনা পেরেছিল দস্যুদলকে ঠেকাতে। অথচ আজগর জেনেছে, দুয়ার থেকে দুয়ারে যদি ছড়িয়ে পড়ে ঢ্যাঁড়া, তবে সেই সব বাড়ির নির্দোষ সংসারজীবন চলে যায় আক্রমণকারীর দখলে। রূপকথার সাবেকি বর্বরতার চেয়ে কত না ভয়ানক এই আধুনিক বর্বরতায় কলমের আঁচড়ে ভাগ হয় দেশ, আজন্মের স্বদেশ হয় ভিনদেশ, বিদেশকে দেশ মানতে হয়, স্বাধীন জীবনপ্রবাহ দেশহীন ছিটমহলে বাঁধা পড়ে।
সিরাজুল-বংশীর মতো প্রতিনায়কদেরও কি আজকের পরিণামে পৌঁছতে বইতে হয়েছে কোনও প্রতিকূল জীবনের ভার? একদা-রাজাকার হাফিজুর রহমানের চোখের জল দেখতে দেখতে কি পাঠকের মনে সিরাজুল-বংশীর জন্যেও কোনও সহানুভবের ইঙ্গিত তৈরি হয়? উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাস্তবের যে অনুসন্ধান চলে, সে-সন্ধানের মানচিত্র ইতিহাস-ভূগোল-সমাজ-রূপকথা-লোকগাথা-স্মৃতির অতল পর্যন্ত নিজের নিশানা জাগিয়ে রাখে। বাস্তবের বদলে যদি অবাস্তবের অর্জন ঘটে যায় অন্বেষণের শেষে? সে-অর্জন যে বাস্তবের চেয়েও বাস্তবতর নয়, এমন নির্ণয়ের উপায় কোথায়? বিশেষত যখন দেশহীন ছিটযাপনেই আখ্যানের চলন? সেই যাপনের অনুপুঙ্খ নিয়েই আখ্যানের বয়ান? এর শেষে ন্যায্যতই কোনও শেষ কথা নেই। বরং সেখানে দুরূহতর কোনও আখ্যানের উপক্রমণিকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy