Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

নদীর বুকে হাওয়ার আলপনা

কাঠুরে কুড়ুল দিয়ে বাঘের মুন্ডু কাটার পর আর বাঘিনিকে দড়ি দিয়ে বাঁধার পরেও বাঘের বাচ্চাদের দেখে তার প্রাণ গলে যায়। তখন আবার সুতলি আর গুনছুচ দিয়ে বাঘের মুন্ডু জোড়া হয়। আর বাঘিনির বাঁধনও খুলে দেওয়া হয়। তবে কাঠুরেকে ভয় দেখানোর শাস্তি ওরা যে একেবারেই পায়নি তা নয়।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৮ ০১:১১
Share: Save:

গৌরী ধর্মপাল সমগ্র

লেখক: গৌরী ধর্মপাল

৫০০.০০

লালমাটি

এক সময় আঁকার আর পরিবেশপাঠের ইস্কুল খুলেছিলেন। সেই ইস্কুল পরে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তাঁর লেখা দিয়ে আজীবন তিনি শিশুদের আঁকা শিখিয়ে গিয়েছেন। অক্ষরে অক্ষরে জাল বুনে তিনি যে ছবি তৈরি করতেন তা তো যতটা না গল্প তার চেয়ে আরও বেশি করে এক একটা ছবি। একেই কি বলে রূপকথা? ছোট্ট ছোট্ট গল্পের আয়তন, পড়লেই মনে হবে, গৌরবুড়িকে ডেকে বলি, ‘অ ঠাকমা, তারপর কী হল?’ তিনি ততক্ষণে আমাদের হাতে চোদ্দো পিদিম ধরিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছেন। সেই পিদিমের আলোয় আমাদেরই খুঁজে বুঝে নিতে হয় তারপর কী? আমাদের কল্পনার বাঁধন খুলে দিয়ে টুক করে গল্পের ঝুলি গুটিয়ে তিনি সরে পড়তেন।

ছোটবেলায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় বেরোনো তাঁর লেখা ‘মালশ্রীর পঞ্চতন্ত্র’ পড়ে বড় আরাম হত। কী স্বচ্ছ সাবলীল ভাষা। নদীর বুকে ঝিরঝিরে হাওয়ার আলপনা আঁকার মতো সহজ গতিতে বয়ে চলেছে যেন। আমাদের খেলাঘর বানানো, পুতুলের শাড়ি পরানো, ফড়িং আটকে রাখা, তিনি কোথা থেকে খবর পেলেন এই সবের? আর কী ভাল ভাল সব চরিত্র। এরা কেউই তেমন নিষ্ঠুর নয়। শূলে চড়ানো নেই, হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়ে মেরে ফেলা নেই। শাস্তি কী রকম শুনবেন? পিঁপড়েদের রানি তাঁর রাজ্যে কেউ একবার দোষ করলে একটু হেসে বলেন, খবরদার, আর করবি না। বলে ছেড়ে দেন। দু’বার করলে চোখ দিয়ে বকেন। তিন বারে হুঙ্কার দেন। চার বারে মারেন, পাঁচ বারে একঘরে করে দেন, ছ’বারে খাওয়া বন্ধ, নাকখত, একলা ঘরে বন্দি, আর সাত বারে— ডুমুর গাছ একটি ডুমুর ফেলে দেয় দুষ্টু পিঁপড়ের মাথার ওপর। এই হচ্ছে তাঁর পক্ষে চরমতম শাস্তি। এখন বুঝি, খুব সচেতন ভাবেই তিনি নিষ্ঠুরতাকে তাঁর চৌহদ্দির বাইরে রাখতে চেয়েছেন। তাই ‘চিনুর ঝুড়ি’ গল্পে ভালমানুষ রাজার সিং-তক্তপোষের মাথার কাছে যে বারোশিঙা হরিণের শিংটা সাজানো আছে, সেটা আদৌ কোনও শিকার করা হরিণ নয়। আসলে রাজামশাইয়ের পোষা হরিণটা মারা যাওয়ার পরে সেটিকে রাজামশাই ফেলতে না পেরে নিজের কাছেই সাজিয়ে রেখে দিয়েছেন।

কাঠুরে কুড়ুল দিয়ে বাঘের মুন্ডু কাটার পর আর বাঘিনিকে দড়ি দিয়ে বাঁধার পরেও বাঘের বাচ্চাদের দেখে তার প্রাণ গলে যায়। তখন আবার সুতলি আর গুনছুচ দিয়ে বাঘের মুন্ডু জোড়া হয়। আর বাঘিনির বাঁধনও খুলে দেওয়া হয়। তবে কাঠুরেকে ভয় দেখানোর শাস্তি ওরা যে একেবারেই পায়নি তা নয়। বাঘের মুন্ডুটা বাঁকা করে জোড়া হল আর টানাটানিতে বাঘিনির লেজ পড়ল কাটা। ব্যস, এই পর্যন্তই!

‘রাজকন্যা ও কইমাছ’ গল্পে রাজকন্যা কইমাছ খাওয়ার জন্য বেজায় বায়না করছিল। যখন তাকে তার মা বলেছেন, ‘ফটফটাফট ভাঙবে মাথা/ হামানদিস্তের ঘায়ে,/ ঘষঘষাঘষ ঘষবে যেন/ আঁশ থাকে না গায়ে।/ ল্যাজমুড়ো সাপটে ধরে/ কাটবে গলা বঁটির ধারে/ কাটা গায়ে নুনের ছিটে,/ সেই কই বড়ো মিঠে।/ কর্তা-গিন্নি ছটফট করবে গরম তে-লে/ বলক জলে ধড়ফড় করবে দশটি ছে-লে/ তবে তো খাবি? রাজকন্যা এতশত জানত না, সে কেঁদে বলে, কেটো না, আমি কই মাছ খাব না। মা হেসে বলেন, তবে কী করবি? –পুষব’। এই তো চলে এলাম আমরা নিষ্ঠুর বাস্তব থেকে মায়ার জগতে। সেই জগতের সবাই সুন্দর, নির্লোভ, ভালবাসায় ভরা।

বাংলায় নাকি প্রাইমারের অভাব? এই গল্পগুলো তো অনায়াসেই প্রাইমার হিসেবে সবে পড়তে শেখা কচিকাঁচাদের হাতে তুলে দেওয়া যেতে পারে। তাতে তাদের শুধু অক্ষর পরিচয় ঘটবে না, সঙ্গে সঙ্গে মনের জগৎটাও তৈরি হয়ে যাবে। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ যাদের হাতে তাদের এটুকু ভালবাসা দিয়ে যদি গড়ে তোলা যায়, দুনিয়ার চেহারাটাই এক দিন সত্যি সত্যি বদলে যেতে পারে।

তাঁর গল্পে প্রকৃতি, পরিবেশকে রক্ষা করার কথা, নদীকে বাঁচানোর কথা সযত্নে, প্রায় না-বুঝতে দিয়ে বলে দেওয়া হয়েছে। গাছের চেয়ে যখন লোহালক্কড়ের থাম উঁচু হয়ে যায়, ছোট্ট পাখি তখন এসে গাছকে কাঁদতে দেখে বলে, ‘ওর কি আছে তোমার মতো ডাল পাতা ফুল ফল’? ‘সোনা’ গল্পে সরকারের লোক নদী থেকে সোনা তুলতে যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে এত কম সোনা পেল যে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেল। তবে খোঁড়াখুঁড়িতে নদীর ময়লা বেরিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল। তার পর থেকে কেউ নদীতে নোংরা ফেলতে গেলেই তারা ছুটে আসত।

তিনি মনে করতেন, এই পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য নয়, পশুপাখি, পোকামাকড়, গাছপালা সব্বার জন্য। এমনকি জড় পদার্থও প্রাণ পেত তাঁর হাতে, যেমন গাগুনির চরকা। তাকে অনেক দিন কেউ ব্যবহার করেনি বলে দুঃখে তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে তেল পড়তে লাগল। তাঁতি, কাঠুরে, পুতুল-গড়া কারিগর, কামার, জোলা, শাঁখারি, জেলে, পাখির পালক-কুড়োনো মানুষ— এই সব খেটে খাওয়া সাধারণের কথা বলতেই তাঁর বেশি ভাল লাগত।

তাঁর গল্পে পাওয়া যায় মেয়েদের কথা। তাদের ছিঁচকাঁদুনে করে ঘরে বসিয়ে রাখতে চান না তিনি। মেয়েরাও ছেলেদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। যেমন, গাগুনি ছোট্ট বয়স থেকে সারা দিন নিজে নিজে চরকায় সুতো কাটে, সেই সুতোয় তার বাবা আর স্বামী কাপড় বোনে।

শাঁখারিমামা যখন ময়নার জন্য শাঁখা নিয়ে এসে হাঁক পাড়েন, তখন ময়নার মা বলে, এ বছরটা থাক দাদা, আসছে বছর দিয়ো। কাউকে বুঝতে না দিয়ে বাল্যবিবাহ ইত্যাদির মতো কঠিন বিষয়কেও তিনি অনায়াসে ছুঁয়ে যান।

সব মেয়েকে যে বিয়ের পর বাপের বাড়ি ছেড়ে বহু দূর শ্বশুরবাড়ি চলে যেতেই হবে, তেমনটাও নয়। ‘চাঁদনি’ গল্পে চাঁদকে তো চাঁদনির বাড়িতেই থেকে যেতে হল, চাঁদে আর ফেরা হল না। অবিশ্যি মাঝে মাঝে চাঁদনিকে নিয়ে চাঁদ যায় সেখানে, আবার ভুবন-মায়ের বাড়িয়ে ধরা অলখ-রশির মই ধরে তারা নেমেও আসে।

এ বইয়ের অলঙ্করণে সত্যজিতের সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য, প্রচ্ছদও শিবশঙ্করের। পটের ধাঁচে আঁকা ছবিগুলি বাংলার লোকশিল্পধারাকে গ্রহণ করে নিজের মতো হয়ে উঠেছে। কোন বই? ও আসল কথাটাই বলিনি বুঝি? লালমাটি প্রকাশনা সম্প্রতি গৌরী ধর্মপালের রচনা সমগ্রের প্রথম খণ্ড বার করেছে। তাই এত কথা বলা।

শুভশ্রী ভট্টাচার্য

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review Gouri Dharmapal Samagra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy