রণাঙ্গন: তৃণমূল সমর্থকের ভস্মীভূত বাড়ি, আমড়াতলা, নন্দীগ্রাম। জানুয়ারি, ২০০৮
নন্দীগ্রাম / আসলে যা ঘটেছিল
লেখক: বিতনু চট্টোপাধ্যায়
মূল্য: ৪০০.০০
প্রকাশক: পত্রভারতী
তালপাটি খাল-ভাঙাবেড়া সেতু-গড়চক্রবেড়িয়া-সোনাচূড়া-অধিকারীপাড়া-তেখালি...
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের নানা অধ্যায়ে এই নামগুলি বারে বারে উঠে আসবেই। যে প্রেক্ষাপটে রক্তে ভেজা এই সব ভূখণ্ডের নাম উঠে এসেছে ও আসবে, সেই প্রেক্ষাপটের নাম নন্দীগ্রাম। সেখানে কেমিক্যাল হাব গড়ে তোলার প্রস্তাব ঘিরে যে গণপ্রতিরোধ ও নানা রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হয়েছিল, উত্থান ঘটেছিল অতি বাম শক্তির, নজির সৃষ্টি হয়েছিল সেই অতি বাম শক্তিকে সুচতুর ভাবে মূল ধারার রাজনীতিতে নানা সময়ে কাজে লাগানোর— তা সমাজবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মী এবং সমাজসচেতন যে কারও কাছেই গবেষণার বিষয়।
২০০৭-এর সেই কুখ্যাত ১৪ মার্চ, যে দিন নন্দীগ্রামের গণপ্রতিরোধ ভাঙতে নির্বিচার গুলি চালিয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ, মৃত্যু হয়েছিল ১৪ জনের, সেই ১৪ মার্চ, ঘটনাচক্রে, কার্ল মার্কসেরও মৃত্যুদিন। ঐতিহাসিক সমাপতনই বটে!
দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে কী ঘটেছিল নন্দীগ্রামে? কী ভাবে, কোন ঔদ্ধত্যে বুদ্ধদেববাবু জনমানসকে গুরুত্বই দিতে চাননি? তারই উত্তর খুঁজতে চেয়েছেন সাংবাদিক বিতনু চট্টোপাধ্যায়, তাঁর নন্দীগ্রাম/আসলে যা ঘটেছিল বইয়ে। মূলত টেলিভিশন সাংবাদিক বিতনু পেশাগত কারণেই বার বার গিয়েছেন নন্দীগ্রাম। খুব কাছ থেকে দেখেছেন নন্দীগ্রামের জমি বাঁচাও আন্দোলন।
নন্দীগ্রামের এই আখ্যান প্রায় চিত্রনাট্যের মতো। দীর্ঘ দিন ‘লেফ্ট বিট’ করা সাংবাদিক বিতনু দেখেছেন, নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন নিয়ে সিপিএম অন্দরের টানাপড়েনও।
বিতনুর লেখার সময়কাল মূলত ২০০৬ সালের ১৮ মে থেকে ২০১১ সালের ২০ মে পর্যন্ত। সেই ১৮ মে-তে রাজভবনে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু তাঁরই পূর্বসূরি আপাত-উদাসীন জ্যোতি বসু যে ভাবে মাটিটা চিনতেন, ততটা কি চিনতেন বুদ্ধদেববাবু?
সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জমি অধিগ্রহণ একটা বড়সড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সৃষ্টি হয় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম অধ্যায়ের, যে অধ্যায় দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের জগদ্দল পাথর সরানোর পক্ষে মস্তবড় সহায়ক হয়ে ওঠে। কার্যত বিরোধীহীন পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে দাঁড়ায় তৃণমূল। বস্তুত, সিপিএম সরকারের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছিল নন্দীগ্রাম।
অবশ্য এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ করতে হয় সিঙ্গুর আন্দোলনের। টানতে হয় মাওবাদীদের কার্যত মুক্তাঞ্চলে পরিণত হওয়া লালগড় আন্দোলনকেও। বাম শাসনকালের ঐতিহাসিক, আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক পুনর্মূল্যায়ন করতে গেলে এই অধ্যায়গুলিকেও বিশ্লেষণ করতে হবে।
বিতনুর গ্রন্থ বেশ কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে করতে তিনি পাঠককে নিয়ে গিয়েছেন এই রণাঙ্গনে। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির রণকৌশল, সেই আন্দোলন ভেঙে দিতে শাসক দল সিপিএমের পাল্টা ছক, নন্দীগ্রামের বধ্যভূমিতে বুলেট আর অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহ, নানা নাটকীয় চরিত্র— যেন পরতের পর পরত খুলেছে এই চিত্রনাট্যের।
যেমন ‘মাস্টারদা’! ফ্রন্টলাইন নন্দীগ্রামে একেবারে সামনে থেকে বন্দুক হাতে সিপিএমের যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন এই নেতা। দীর্ঘ দিন ধরেই যে অভিযোগ উঠত, বহিরাগত ‘হার্মাদ’দের দিয়ে সিপিএম নন্দীগ্রামের হারানো এলাকা উদ্ধার করতে পথে নেমেছে, এই গ্রন্থে ‘মাস্টারদা’র বয়ান সে কথারই মান্যতা দিয়েছে! সময়কালের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে বিতনু দেখিয়েছেন, কী ভাবে, কোন কোন এলাকা থেকে সিপিএম বাইরের শক্তিকে নন্দীগ্রামে নিয়ে এসেছিল। ‘মাস্টারদা’ জানিয়েছেন, কী ভাবে সিপিএম আবার নন্দীগ্রাম দখল করেছিল।
আর কী ভাবেই বা মাওবাদীরা যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সঙ্গে? তৃণমূল নেতৃত্ব বারে বারেই এই আন্দোলনে মাওবাদীদের সঙ্গে তাঁদের কোনও রকম যোগাযোগের কথা আগাগোড়া অস্বীকার করে এসেছেন। কিন্তু বিতনু তাঁর গ্রন্থে বলছেন, ১৪ মার্চের গণহত্যার ক্ষত ধীরে ধীরে শুকোতে শুরু করার মধ্যেই অসম্ভব লড়াকু এক বাহিনী তৈরি করে ফেলেছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। এই সময়ে টানটান চেহারার এক যুবক সোনাচূড়ায় গিয়ে কথা বলেন প্রতিরোধ কমিটির দুই নেতা নিশিকান্ত মণ্ডল ও মধুসূদন মণ্ডলের সঙ্গে। জানান, তাঁর নাম গৌরাঙ্গ। জহুরি সে দিন জহর চিনেছিল। সেই গৌরাঙ্গই হলেন তেলুগু দীপক, মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আরও চার-পাঁচ জন মাওবাদী স্কোয়াড সদস্য। প্রায় আট মাস নন্দীগ্রামে থেকে লড়াই চালিয়ে দীপক নন্দীগ্রাম ছাড়েন ২০০৭-এর ১০ নভেম্বর। দীপক থাকাকালীনই সে বছরের জুনে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন সুদীপ চোংদার, মাওবাদীদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক। নন্দীগ্রামে তাঁর নাম ছিল সুকুমার। ১৪ মার্চের গুলিচালনার পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশাসন ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিল। এরই ফাঁক দিয়ে নন্দীগ্রামে ঢুকতে থাকে আরও অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থ।
যদিও এর অর্থ এ রকম নয় যে সিপিএম সে সময় হাত গুটিয়ে বসে ছিল! ২০০৭-এর ১০ নভেম্বর নন্দীগ্রাম পুনর্দখল করে সিপিএম। সিপিএমের ভাষায়: ‘অপারেশন সূর্যোদয়’। ১৩ নভেম্বর মহাকরণে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেই ঐতিহাসিক উক্তি করেছিলেন, ‘দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক বাই দেয়ার ওন কয়েন।’
ইতিহাসের পরিহাসই বটে! ২০১১-র মে মাসে মুখ্যমন্ত্রী পদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথগ্রহণের কালে সেই উক্তি অনেকেরই মনে পড়েছিল। একটি নির্দিষ্ট সময়কালে এই গ্রন্থ বেঁধেছেন বিতনু। অত্যন্ত ঝরঝরে, টানটান এই বইয়ে বহু অকথিত কাহিনি শুনিয়েছেন তিনি। তবে, সাংবাদিকদের লেখায় একটা তাৎক্ষণিকতা থাকে, এই গ্রন্থে সেটা প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু এরই পাশাপাশি, সাংবাদিকের রোজের দেখার বাইরে গিয়ে একটা সামগ্রিকতায় পৌঁছনোটাও জরুরি। আশা করা যায়, এই গ্রন্থের পরবর্তী কোনও সংস্করণে অথবা নন্দীগ্রাম নিয়ে পরবর্তী কোনও গ্রন্থে তিনি এই রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের একটা সামগ্রিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করবেন। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের মতো সামাজিক, নাগরিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস ফিরে দেখার ক্ষেত্রে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy