ছবি: সুব্রত চৌধুরী
মুঠোর মাপ উপচে যেন পড়ে
লেখক: পৌলোমী সেনগুপ্ত
৪০০.০০
সিগনেট প্রেস
কবিতা কি সত্যিই কোনও নির্জন শিল্প? না কি কবিতা সেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী যুদ্ধের ভিতরও যিনি চুপ করে বসে থাকেন আর চারপাশে ভেঙে পড়তে থাকে সব, কেন্দ্র কিছুই ধরে রাখতে পারে না? পৌলোমী সেনগুপ্তর পাঁচটি কাব্যগ্রন্থের সঙ্কলন মুঠোর মাপ উপচে যেন পড়ে পড়তে পড়তে প্রশ্নটা ঘাই মারল মাথায়। নব্বই দশকের কবি পৌলোমী আজকের বাংলা কবিতায় একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ১৯৯৭-এ পেনসিল খুকি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তিনি সচেতন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং দুই দশক পেরিয়েও তাঁর কবিতা আমাদের মন টানে।
কিন্তু এই ইন্টারনেট বিপ্লবের যুগে আমাদের মনও তো বদলে গিয়েছে। সে তো নিজের প্রতীক হিসেবে জোসেফকে কিংবা লিওপোল্ড ব্লুমকে বাছে না আর, মাইকেল জ্যাকসন কিংবা ম্যাডোনায় মোহিত হয়। পেনসিল খুকি থেকে আমরা আজ রুমাল চোর (২০০০), উল্কি (২০০৪), মেট্রোয় বৃষ্টি (২০১২) এবং সাম্প্রতিক অগ্রন্থিত কবিতা সংগ্রহ অমৃত মন্থন পর্যন্ত পৌলোমীর কবিতা পড়তে পড়তে পাঠকের তাই মনে হয়, মন নিয়ে নিরন্তর মাটি মাখার বদলে মনের বিবর্তনকেই একটা জার্নি হিসাবে তুলে ধরেছেন কবি। ‘তোমার সম্বন্ধে অনেক তথ্যই/ আমি গোপনে লিখে রেখেছি/ থার্ড বেঞ্চের পাশের দেওয়ালে……তবু শেষ অবধি হেরে যেতে হল/ যেদিন দেখলাম তুমিও লিখে রাখো/ আমার বিষয়ে সব গোপন খবর/ থার্ড বেঞ্চের অন্য পাশের দেওয়ালে।’ (পরাজয়: পেনসিল খুকি) কিংবা ‘এদিকে তো স্পেস বলতেই/ হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকেছে মহাশূন্য/ সূর্য চন্দ্র গ্রহ উল্কা/ সকলে নাচছে হাত ধরাধরি করে/ আর স্পেস কেমন যেন থমকে গিয়েছে/ ’ (ভ্রমণ: উল্কি)
‘এই থমকে দাঁড়ানো স্পেস’ টাই আমাদের আজকের অভিজ্ঞান। সে গুলিয়ে দিয়েছে ভার্চুয়াল ও রিয়াল, কথা ও ছবি, খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা এমনকি যন্ত্রণা ও জন্ম। হাসান আজিজুল হকের একটি গল্পে এক কলসি কাঁচা রক্তের মধ্যে বসে থাকা মেয়েটি গল্পের কথককে বলে, ‘বাবা আমার সন্তান হবে’। যুগ যুগ ধরে কবিতার জন্ম দেওয়ার সময় কবিরাও কি পাঠককে একই কথা বলতে চাননি? কিন্তু হাজার ওয়াটের আলোয় যখন ধাঁধিয়ে যায় চোখ, আদম আর ইভের ভিতরে সেতু হওয়ার বদলে কেবলই প্রযুক্তি হয়ে ওঠে আপেল তখন ‘তোমাকে বধ করার পথে তুমিই আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু’র (রাক্ষস: মেট্রোয় বৃষ্টি) মতো পংক্তি অমোঘ হয়ে ওঠে।
পৌলোমী যদিও ‘পুরুষের সংজ্ঞা লিখি তার নামে ভালবাসা পুষি/ তারিফ করেই যাই পুরুষের অনন্য গুণের/ সে স্বার্থপরতা একা শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছে’র মতো ক্ষুরধার লেখা লিখেছেন (পুরুষের কথা অন্য: উল্কি) তবু তার কবিতা পড়তে পড়তে সারাক্ষণ মনে হয় না যে কোনও মেয়ের কবিতা পড়ছি। বরং যে নিপুণতায় তিনি একটি ছেলের ভাবনার পরিবর্তন তুলে ধরেন, ‘১৬ বছরে ছেলেটি যা লিখেছিল’ থেকে, ‘২৮ বছরে ছেলেটি যা লিখেছিল’ পর্যন্ত পাঁচটি কবিতার সিরিজে তা যে কোনও পুরুষ কবিকে ঈর্ষান্বিত করে তুলতে পারে। আসলে পুরুষ-নারীর ঘেরাটোপ পেরিয়ে পৌলোমীর কবিতায় বারবার সেই জনসমুদ্রের একজনকেই খুঁজে পাই লিঙ্গ নির্বিশেষে যাকে পিষে ফেলে সভ্যতা। ভুবনগ্রামের একজন ভ্রষ্ট নাগরিক হিসাবে প্রতিটি সন্ধ্যায় যে উচ্চারণ করে ‘তাদের ঘাড়ে সাতজন্মের বোঝা/ আমার ঘাড়ে সতেরো জন্মের’ (বিভাব কবিতা: উল্কি)
ওই বোঝা বয়ে নিয়ে চলার বাধ্যবাধকতার মধ্যেও তো শেরপা গুনগুন করে, শিস দিয়ে ওঠে কুলি। অরফিউস তার প্রেমিকা এউরুদিকে’কে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় মৃত্যুপুরী থেকে পৃথিবীতে। শেষ অবধি পারে না; মৃত্যু আর জীবন, সম্পর্ক আর ভালবাসার ভিতরে দেওয়াল মাথা তোলেই তবু হিরোশিমা, ভিয়েতনাম, চুকনগর, ভাগলপুর পেরিয়ে এসেও এউরুদিকে ডেকে ওঠে তার ইপ্সিতকে। অতীতের ভেতর থেকে প্রতিধ্বনি উঠে এসে মিশে যায় আমাদের সাঁঝসকালের শব্দে যে ভাবে পাঁউরুটিতে মেশে ডিম। তাই পড়তে পাই... ‘সময় একটি মাদক দ্রব্য।/... সকালের সময় একটু অলস গতিতে ওড়ে... / দুপুরের সময় ধারাবাহিকভাবে/ স্রোতের মতো বয়ে যায়... / ভোররাতে সময় ঘুমোয়/ নেশা ছাড়ার পর যেমন আকুল/ যেমন বিরক্ত/ যেমন বোধহীন/ সময়কে বাঁধতে সেটাই প্রশস্ত সময়/ লম্বা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে দিতে হবে মাঝসমুদ্রে (সাময়িক: অমৃত মন্থন)।
সময় আর অসময়ের এই কার্নিভালে ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে’ দোলা দিয়ে নয়, গদগদ প্রেম বা শাণিত প্রতিবাদেও নয়, পৌলোমীর কবিতা ভালবাসার দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে আবার ভালবাসার থেকে নিজেকে সরিয়েই টিকে থাকে চিরবর্তমানে। ‘হ্লাদিনী’র মতো স্মরণীয় দীর্ঘ কবিতাও তাই ইতিহাস আর পুরাণ অঙ্গে ধারণ করেও শেষে সমকালে এসে দাঁড়ায়। হয়তো সত্যিই, ‘পরবর্তী দিন আসলে কোথাও টিকে নেই/ তার আলো পিছিয়ে আসছে/ আশা দিয়ে রাঙিয়ে দিচ্ছে আজকের চিহ্নিত সীমানা’। (একটি দিন: অমৃত মন্থন)।
শিম্বোর্স্কা লিখেছিলেন, ‘পৃথিবী কখনও তৈরি নয় একটি নতুন বাচ্চার জন্মের জন্য।’ তৈরি নয় বলেই শ্রীধর ভট্টাচার্যের ‘ভালবাসিবে বলে ভালবাসি নে/’ নিধুবাবুর রসে চুবে নিধুবাবুর নামেই বাজারে চলে। বাংলা কবিতাতেও যুগে যুগে অনেক শ্রীধর ভট্টাচার্যের ভিড়। তার ভিতরেই পৌলোমী সেনগুপ্তর মতো যাঁরা নিজস্ব এবং নতুন কবিতার জন্ম দেবেন কিছুটা নীরবতা এবং আড়াল ঘিরে থাকবে তাঁদের। সে এক রকম ভালই। কারণ, আড়াল না পেলে কবি ইউনিফর্ম বদলে বারবার নতুন হয়ে উঠবেন কী ভাবে?
‘পুরো জীবনটাই এক ইউনিফর্ম ছেড়ে/ অন্য ইউনিফর্মে ঢুকে পড়ার গল্প/ আমি যেমন অফিসে যাওয়ার সময়/ একটা ইউনিফর্ম পড়ে যাই/ ছুটির দিন রাতে যখন আমরা বেরোই তখন রঙিন জামা পড়ে যাই/ কী? যাই তো?/ সেটাও আসলে একটা ইউনিফর্ম। প্রমাণ করে আমরা তখন ফ্রি। মানে মুক্ত।/... জানো সোনা আমরা যখন জন্মাই/ তখনও যে বার্থডে স্যুট পড়ে থাকি/ তাও ইউনিফর্ম। জন্মানোর ইউনিফর্ম... (মেয়েকে, হাইস্কুলে যাওয়ার আগে: মেট্রোয় বৃষ্টি)
সিগনেট প্রেস প্রকাশিত এই গ্রন্থটির বাঁধাই, অঙ্গসজ্জা এবং সৌরীশ মিত্রের করা প্রচ্ছদ এক কথায় চমৎকার। তবে দাম আরেকটু কম রাখা গেলে খুব ভাল হত। আজও বাংলা কাব্যগ্রন্থের ক্রেতারা অধিকাংশই টিউশনি-নির্ভর তো!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy