শ্রীপান্থদর্পণ/ শ্রীপান্থ স্মারক নিবন্ধসংগ্রহ। সম্পা: রতন খাসনবিশ, সুবীর দত্ত ও শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। থীমা, ২৭৫.০০
ধরা যাক, কোনও মনোযোগী ও সংবেদী পাঠক খুব মন দিয়ে একটি বই পড়ছেন। কী ঘটছে তখন তাঁর মনের মধ্যে? তাঁর এত দিনের মনটি দিয়েই কি আগাগোড়া বইখানা পড়ে ফেলছেন তিনি? না কি, বইটি যা বলে, তার প্রভাবে তিনি নিজে ভেতর থেকে সমানেই পাল্টাতে থাকছেন, আর সেই ক্রম-বিবর্তনশীল মন নিয়ে বইটি পড়ছেন? অর্থাৎ একটি বই পড়ার সময় পাঠকের মনের রসায়নটা কি অপরিবর্তিত থাকে?
অনেক তত্ত্বকথা চলতে পারে এ নিয়ে, তার মধ্যে এখন না গেলেই ভাল। কিন্তু শ্রীপান্থ-কে নিয়ে ‘শ্রদ্ধাদর্পণ’টি পড়লে এই প্রশ্ন মনে ধাক্কা দেবেই। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতেই হবে যে, সাধারণ পাঠক সাধারণত প্রথম গোত্রে বিরাজ করলেও কিছু পাঠক আছেনই যাঁরা নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় গোত্রভুক্ত। তাঁদের মনোমধ্যে নিষিক্ত হয়ে পঠিত যে কোনও বই-এর বক্তব্য একটা আশ্চর্য রূপ পরিগ্রহ করে, যা তাঁদের মনের সহায় ছাড়া ঘটতেই পারত না, কিছুতেই না। শ্রীপান্থ তেমন এক জন অ-সাধারণ পাঠক, তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় এটাই। তাঁর পরের পরিচয়, সেই বিশিষ্ট পাঠ-অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি যখন লিখতে বসতেন, নথিবদ্ধ ইতিহাস হয়ে উঠত চলমান জীবনের প্রাণময় ইতিহাস। দুর্বোধ্য তত্ত্বের বদলে ফুটে উঠত সুবোধ্য ছবির ধারা। পাঠক শ্রীপান্থের মনের মধ্যে ‘পুরনো সময়’ আশ্চর্য ভাবে প্রাণ পেয়ে উঠত, তার টানে লেখক শ্রীপান্থের একটা বৃহত্তর দৃষ্টি তৈরি হত, আর সেই দৃষ্টিতে কেবল অতীত নয়, বর্তমানেরও একটা আলাদা অর্থ তৈরি হত। শ্রীপান্থের কলকাতা, ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক, দায় এবং আরও অনেক বইয়ের দীর্ঘ তালিকার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, ইতিহাস সত্যিই কথা কয়ে উঠলে তা অনেকাংশেই আজকের কথা, বর্তমানের কথাও হয় বটে। এই সংকলনে তাঁর নানা বন্ধু, সহকর্মী, প্রীতিভাজন মানুষ তাঁকে স্মরণ করতে বসে এই কথাটিই নানা আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।
একই সঙ্গে ইতিহাস আর সাংবাদিকতার জগতে ডুবে থাকতেন বলেই কি তাঁর দৃষ্টি একাধারে সহজ এবং সমৃদ্ধ হতে পেরেছিল? এর উত্তর অবশ্য এখানে নেই। উত্তর সহজও নয়। কিন্তু অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখাটির রচয়িতা গৌতম ভদ্র যখন বলেন, ‘একাধারে [শ্রীপান্থ] গাল্পিক এবং চাক্ষিক: ইতিহাস পড়তে, দেখতে, চাখতে ও দেখাতে তিনি ভালবাসতেন, ইতিহাসের খাঁজে খাঁজে নানা অভিজ্ঞতায় যে চমৎকৃতি বা অভিনব রসটুকু মাঝে মাঝে জমে থাকে, তাই আস্বাদন করেই তাঁর তৃপ্তি,’ তখন সম্ভবত তাঁর সাংবাদিক সত্তাটির মধ্যে যে বিরাট শক্তি ছিল তার একটা আন্দাজ মিলতে পারে। ‘খাঁজে খাঁজে নানা অভিজ্ঞতার চমৎকৃতি’ খুঁজে যাওয়াটা তো সাংবাদিক সত্তারই একটি বিশেষ ধরন। শ্রীপান্থ ওরফে নিখিল সরকার পাঠক ছাড়াও ছিলেন সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসবিদ এবং সম্পাদক। তাঁর এই নানা পরিচয়ের উপর বিভিন্ন দিক থেকে আলো ফেলেছে এই বই। কিন্তু কী ভাবে তাঁর এই নানা পরিচয় নিজেদের পরিচিত ও স্বীকৃত গন্ডি ছাড়িয়ে পরস্পরের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে, পাশাপাশি প্রবাহিত হতে হতে একে অন্যকে পূর্ণতর করেছে, তার হদিশটি প্রত্যক্ষ ভাবে পাওয়া গেল না। এই একটি দুর্বলতা এই সংকলনের। হয়তো সামান্য দুর্বলতা, কিন্তু আক্ষেপ থেকেই যায়। নানান ইন্টেলেকটুয়াল প্রবণতা ও ভূমিকার আশ্চর্য সন্নিবেশ ছিল এই মানুষটির মধ্যে। আর তাই, তাঁর বহু সত্তার মধ্যে সংযোগের আলোচনাও জরুরি ছিল এই স্মারকগ্রন্থে। এমন মানুষ তো সুলভ নন! এমন আলোচনার সুযোগও সহজে মেলার নয়।
নিখিল সরকার (১৯৩২-২০০৪)
আর একটি সুযোগও সহজে মেলে না। কোনও পরিশ্রমী ও বুদ্ধিদীপ্ত সম্পাদকের কাজকর্ম-ভাবনাচিন্তার অন্দরমহলে উঁকি দেওয়ার সুযোগ। সম্পাদকরা সাধারণত পাদপ্রদীপটির নীচের কালোয় হারিয়ে যান, হারিয়ে যেতে চানও বটে। কিন্তু দীর্ঘ সময় যিনি আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগকে অনতিক্রম্য উচ্চতায় ধরে রেখেছিলেন, কী ভাবে তিনি লেখক খুঁজে বার করতেন, লেখক তৈরি করতেন, এবং সবচেয়ে বড় কথা, লেখকের মধ্যে এক-একটি লেখাকে তৈরি করতে পারতেন, সে সব কাহিনি তো কেবল গল্পগাছা নয়, তার থেকে অনেক বড় কোনও লক্ষ্যের সন্ধান। বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংবাদ চর্চা জগতে নিখিলবাবুর এই নেপথ্য অভিভাবকত্বের বিবরণ জানা গেল রতন খাসনবিশ, রমাকান্ত চক্রবর্তী, গণেশ হালুই, সুদেষ্ণা চক্রবর্তী, অভিজিৎ গুপ্ত, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, আনিসুজ্জামানের মতো লেখক, এবং অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ও গৌতম রায়ের মতো সহকর্মী-লেখকদের স্মরণের মধ্য দিয়ে। এ একটা দুর্মূল্য কাজ, ভবিষ্যতের দিগ্দর্শন হওয়ার মতো। কেবল প্রবন্ধ নয়, বইতে সংকলিত শ্রীপান্থকে লেখা অনেকগুলি ব্যক্তিগত চিঠিও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয় সম্পাদকের প্রাত্যহিক উৎসাহময় বোধদীপ্ত চর্যা। এই সব চিঠির লেখকের মধ্যে আছেন নীরদচন্দ্র চৌধুরি, নীহাররঞ্জন রায়, তপন রায়চৌধুরি, অমিয়া চৌধুরানী, লীলা মজুমদার, সুভো ঠাকুর, অশোক মিত্র, অশোক রুদ্র, সোমনাথ হোর, গণেশ পাইন, শঙ্খ ঘোষ, সুকান্ত চৌধুরি।
কেমন ছিল এই চর্যা? বাড়িতে বহমান আড্ডার মধ্যে হঠাৎ এক গোছানো মন্তব্যে আড্ডাধারীদের মধ্যে প্রেক্ষিত এনে দেওয়া। গম্ভীর আলোচনায় ছোট্ট মজার অভিজ্ঞতা এনে এক লহমায় ‘সেমিনার-সেমিনার ভাব’টা কাটিয়ে ভাবনায় তরঙ্গ তোলা। দেশবিদেশের বই নিজে পড়ে অন্যদের পড়িয়ে পাঠভুবনের সীমান্ত বাড়িয়ে চলা। ঝোলায় লুকিয়ে থাকা অজানা পাণ্ডুলিপি থেকে তসলিমা নাসরিন নামক ঘটনাকে নির্মাণ করা। প্রবাসী বন্ধুকে বিচিত্র দুর্লভ বই কিনে পাঠানোর তাগাদায় অতিষ্ঠ রাখা। নিজের বহু-পরিশ্রমসাধ্য লেখার কাজে ইটপাথর কুড়নো থেকে সৌধ তৈরি অবধি সব স্তরে বয়ঃকনিষ্ঠ সহকর্মী সম্পাদককে শামিল করে নিয়ে পড়াশোনার শিল্পকর্মটি তাকে হাতেকলমে শেখানো।
এবং শেখানো, পড়াশোনার সেই শিল্পকর্ম— কোনও বাঁধাধরা শৃঙ্খলিত অ্যাকাডেমিক-তা ছাড়াও যার সাধনা সম্ভব। অ্যাকাডেমিক ও অ্যাকাডেমিক-বহির্ভূত জগতের মধ্যে সাধারণত একটা অতিরঞ্জিত বিভেদ-প্রাচীর ভেবে নিই আমরা। এই প্রাচীরের ভিতটি কিন্তু বেশ নড়বড়ে, একটু চেষ্টা করলেই ভেঙে দেওয়া সম্ভব। গৌতম ভদ্রের লেখায় এই কথাটি জোরালো ও গভীর ভাবে ফুটে উঠেছে। অ-অ্যাকাডেমিক গবেষক-সন্ধানীদের শৌখিন বললেও মূল আরবি শৌকিন শব্দে যে বিলাসী রুচির নমুনাই বোঝায়, আনাড়িপনার আভাস তাতে থাকে না। তাই ‘আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদ্বৎ প্রতিষ্ঠানের বাইরের লোক হলেও’ এমন ভাবা যাবে না যে ‘ইতিহাস চিন্তনে বা লেখালিখির প্রকরণে, বিদ্যাচর্চার নিরিখে এঁরা সবাই অপেশাদার।’ রাধারমণ মিত্র, যম দত্ত, রাধাপ্রসাদ বসুর মতো বাঙালি শৌখিন গবেষকদের সঙ্গে শ্রীপান্থ কোথায় এক, কোথায় আলাদা, সে কথা পড়তে পড়তে বাঙালির চিন্তাভুবনের বিচিত্রগামী সমৃদ্ধি যেন হঠাৎ এক ভিন্ন উপলব্ধিতে মথিত করে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি বই-পড়ার উপর একটি বিখ্যাত লেখা লিখেছিলেন চার্লস ল্যাম্ব। তাতে একটি ভারি মোহময় উক্তি ছিল: ‘I love to lose myself in other people's minds...’। সংকলনে শংকরলাল ভট্টাচার্যের অতি-সুপাঠ্য লেখাটিতে রয়েছে এই উদ্ধৃতি। তিনি বলেছেন, চার্লস ল্যাম্বের মতো শ্রীপান্থও এ কথা ষোলো আনা সততার সঙ্গে বলতে পারতেন। খুব ঠিক কথাটি, তবু হয়তো পুরো ঠিক নয়! শ্রীপান্থ সেই গোত্রের পাঠক, যিনি কেবল অন্যের ভাবনায় ডুবে যান না, যাঁর মধ্যে অন্য ভাবনাও বিবর্তিত হয়ে ওঠে অনুভূতি ও উপলব্ধির অবলম্বনে, আর লেখা ও লেখানোর মধ্য দিয়ে তন্নিষ্ঠ পাঠক কিংবা পরিচিত নিকটজনের মনে একটা আশ্চর্য চিত্রলোক রেখে দিয়ে যায়। তাই, যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটার সংশোধন দরকার এ বার। শ্রীপান্থ কেবল এক অসাধারণ পাঠক নন। এই সংকলন সাক্ষী— লেখক ও সম্পাদক, দুই সত্তাতেই পাঠ-বিষয় ও পাঠক-সমাজের মধ্যে তিনি এক অ-সামান্য ‘মিডিয়াম’ বা সেতু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy