গ্রন্থের ভূমিকা নিবন্ধে অধ্যাপক অশোক সেন লিখেছেন, ‘যত দিন যাচ্ছে কেমন যেন বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের রাজনীতির ভাবনা’। এই সিদ্ধান্ত বেশ জোরদার বইটি জুড়ে। বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে আধুনিক নানা রাজনৈতিক ধারণার (concept) সূত্রে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন অধ্যাপক সেন। তিনি লিখেছেন, ‘কিছুদিন হল রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি চিন্তা সম্বন্ধে কয়েকটি নতুন লেখা পাঠকসমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। আমার দিক থেকে পুনর্ভাবনার তাগিদে সে-সব লেখার ভূমিকা অবশ্যস্বীকার্য।’ এর মধ্যে
তাঁর সর্বাধিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাবীন্দ্রিক নেশন কী’ প্রবন্ধটি। পার্থ রবীন্দ্রনাথের নেশন চিন্তা ও তার সূত্রে কবির রাজনৈতিক ভাবনার মধ্যে এ কালে গ্রহণযোগ্য তেমন কোনও সূত্র খুঁজে পাননি। রবীন্দ্রনাথের নেশন-সমালোচনা মূলত উনিশ শতকীয় নেশনের ধারণার বিরুদ্ধে, বিশ শতকের পরিবর্ধিত ক্ষমতাতন্ত্রের প্রেক্ষিতে তার কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই বলে তিনি মনে করেন। তা ছাড়া, রবীন্দ্রনাথ যে ‘স্বদেশী সমাজ’-এর ধারণা নির্মাণ করেছেন, তা তো নেশন গঠনের সমতুল্য, তা হলে কোন যুক্তিতে রবীন্দ্রনাথকে নেশন-বিরোধী বলা যাবে, এ প্রশ্নও তুলেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বিশ শতকের পৃথিবীতে গভর্নমেন্টালিটির বিপুল বিস্তারে যে ক্ষমতাতন্ত্র তৈরি হয়েছে ও গণতান্ত্রিকতার প্রসার ঘটেছে, রাবীন্দ্রিক ভাবনাবৃত্তে তার কোনও প্রতিফলন নেই বলে তিনি মনে করেন। রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বচিন্তাও মূলত ‘এলিটিস্ট’ এবং সাধারণের জন্য যে চিন্তা-কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন আমাদের, তার থেকে বহু দূরে রবীন্দ্রনাথ। তিনি মূলত এক ‘ব্যক্তিভাবুক’, এবং তাই কবির বিশ্বমানবিকতা ও বিশ্বনাগরিকত্বের ধারণা তাঁর হৃদয়ে কোনও আনন্দের হিল্লোল তোলে না।
অধ্যাপক সেন পার্থর এই রবীন্দ্র-বিশ্লেষণ আদপেই স্বীকার করেননি, বরং আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের সূত্রাবলি সামনে রেখে রাবীন্দ্রিক রাজনীতির অনন্যতা ও এ কালে তার বাস্তবিক গুরুত্ব নিয়ে দীর্ঘ বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হল ‘স্বদেশী সমাজ’-এর ধারণা, যার ভিতরে প্রোথিত হয়ে আছে আত্মশক্তির চিন্তা। ১৯০৪ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সূচনাপর্বে রবীন্দ্রনাথ দেশবাসীকে আহ্বান করেছিলেন ‘স্বদেশী সমাজ’ গড়ে তোলার জন্য। সে আমলে ন্যাশনাল রাজনীতি বলতে বোঝাত বিদেশি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সমালোচনা, আস্ফালন আর প্রতিবাদ। নরমপন্থীরা নিয়মতান্ত্রিক বোঝাপড়ার কথা ভাবতেন, অন্য দিকে চরমপন্থীরা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পক্ষপাতী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই দুই ধারার বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন। রাজনীতির সংকীর্ণ পরিসর পাল্টে দিতে আগ্রহী রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, সামাজিক জীবনযাপনের ব্যবস্থায় দেশবাসীর গঠনমূলক কর্মোদ্যম ও দায়দায়িত্বের মধ্য দিয়ে স্বাদেশিকতার ধর্ম পালন করতে হবে। অধ্যাপক সেন এই চিন্তার স্বরূপ ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ ইতিহাসের পারম্পর্যে সমাজের ভূমিকা অগ্রগণ্য। বিদ্যাদান থেকে জলদান, সবই ছিল সমাজের পালনীয় কর্তব্য। হিন্দু-মুসলমান সব রাজত্বেই সে-ধারা মোটের ওপর অব্যাহত ছিল। ইংরেজ শাসনে আমাদের সেই সমাজ নষ্ট হয়ে একেবারে লক্ষ্মীছাড়া দেশের অবস্থা। তেমন সর্বনাশ থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে স্বদেশী সমাজের পথনির্দেশ।’ ‘স্বদেশী সমাজ’ গঠনে ভারতবর্ষের মূল কেন্দ্র গ্রামসমাজ গঠনের ব্রতকে প্রধান কর্তব্য বলে চিহ্নিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গ্রন্থকারের ভাষায়, ‘রাষ্ট্রক্ষমতায় ভাগ বসানোর চেয়ে সামাজিক প্রাধান্যের কর্মোদ্যোগ ভারতবর্ষের স্বরাজসাধনার পক্ষে বিশেষ জরুরি।’
‘স্বদেশী সমাজ’ গঠনের প্রত্যয়ের অঙ্গাঙ্গি ছিল রবীন্দ্রনাথের আত্মশক্তির ব্রত। অধ্যাপক সেন লিখেছেন, ‘স্বদেশীর পরিচয়ে তার ঐক্যবন্ধন। আত্মশক্তির ভরণপোষণেই অবধারিত সে ঐক্য। পরনির্ভরতা ত্যাগ করে নিজেদের বোধবুদ্ধি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শক্তিসামর্থ্যে স্বাবলম্বন স্বাদেশিকতার পক্ষে অপরিহার্য।’ ১৮৯০-এর যুগ থেকে জীবনের শেষ পর্ব পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের কর্মজীবনে এই ধারণাগুলির মূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। শিলাইদহ পর্বে গ্রাম গঠনের আয়োজন ও শ্রীনিকেতনের ব্যাপক কর্মকাণ্ডে তার পরিচয়। অধ্যাপক সেন খুব বিস্তৃত পরিসরে তার তথ্যগত ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আর সেই সূত্রে নেশন সংক্রান্ত তাঁর মন্তব্যগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ‘নেশন বানাবার কর্তব্য রবীন্দ্রনাথও মানেন নি তা নয়’, ‘স্বদেশী সমাজে নিহিত আছে এক জাতি সৃজনের পরিপ্রেক্ষিত... তবে তাঁর মত এই যে ইংরেজ-মার্কা জাতিরাষ্ট্রের মতো প্রতিযোগী স্বার্থের জুলুমে ধরা যোগফল তা হবে না। আগাগোড়া আত্মপরের সামঞ্জস্যে লালিত সমাজ হবে সে ‘নেশন’-এর প্রধান অবলম্বন’। এরই প্রেক্ষিতে অধ্যাপক সেন জানাচ্ছেন, ‘রাষ্ট্রীয় প্রভুত্বের বিপরীতে সামাজিক প্রাধান্য বিস্তারের আহ্বান’ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং এ যুগেও তার বিশেষ প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।
১৮৮০-র যুগ থেকেই রবীন্দ্রনাথ দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনসাধারণের সঙ্গে নেতাদের যোগাযোগহীনতার সমস্যার কথা বলেছেন। বিশ শতকের ইউরোপ-আমেরিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কেও তাঁর বিস্তর অভিযোগ ছিল। শ্রেণিভেদের অসাম্য, স্বার্থতন্ত্রের নিদারুণ যথেচ্ছাচার, প্রতিযোগী জীবনযাত্রার অহরহ দ্বন্দ্বে সমাজকে ক্ষত-বিক্ষত করা সেই গণতন্ত্রের ধর্ম। কবি লিখেছিলেন, আধুনিক গণতন্ত্রে যে-নির্বাচনব্যবস্থা তাতে তো ‘জমিদার, মদের কারখানার কর্তা, রেল কোম্পানির অধ্যক্ষ’দেরই শাসন, ‘কতগুলো প্রাইভেট স্বার্থের আত্মম্ভরি শক্তিকে ছাড়িয়া দেওয়া’ই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের উদ্দেশ্য। এতদ্সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ গণতন্ত্রে আস্থা হারাননি। সম্মিলিত আত্মকর্তৃত্বের যোগে সাধারণের স্বার্থে গণতন্ত্রের ভিত গড়ে তোলা তাঁর লক্ষ্য ছিল। সেটা বোঝা যায় তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ ও তার পরিপূরক ‘পল্লীসমাজ’-এর সংবিধানে গণতান্ত্রিক বন্দোবস্তের স্বীকৃতি দেখে। পল্লিসমাজের বিধিবদ্ধ কার্যক্রমে একেকটি পল্লির তত্ত্বসংগ্রহের দৃষ্টান্ত থেকে অধ্যাপক সেনের মনে হয়েছে যে, এ তো ‘মিশেল ফুকো-কথিত প্রশাসনিকতার আদিসূত্র’। আর তাই তাঁর সঠিক সিদ্ধান্ত, ‘... রবীন্দ্রনাথের সমাজ-রাজনীতি সংক্রান্ত আলোচনা আর কর্মোদ্যোগে এমন চিন্তাভাবনা ও তত্পরতার অনেক দৃষ্টান্ত ছিল, যাতে একালের গণতন্ত্রের সমস্যাপটও অচেনা থাকে না’।
গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে অধ্যাপক সেন লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের পরিবর্তন অভীপ্সায় অবান্তর আকাঙ্ক্ষার জায়গা নেই। সামাজিক সাধ্য ও সার্থকতার বিবেচনা বাদ দিয়ে তিনি কখনো রাজনীতির তাত্পর্য খোঁজেন না’। প্রসঙ্গটি গ্রন্থকার তুলেছেন এই জন্য যে, কবির সমকাল থেকে বর্তমান কাল অবধি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি ‘রোমান্টিক’, ‘ব্যক্তিভাবুক’, বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন। অধ্যাপক সেন দীর্ঘ বিশ্লেষণ করে বুঝিয়েছেন যে কল্পনা (imagination) আর কাল্পনিকতা (fancy) এক কথা নয়। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেই তাঁর বক্তব্য, যথার্থ কল্পনা ‘যুক্তি সংযম সত্যের দ্বারা সুনির্দিষ্ট আকারবদ্ধ’, কাল্পনিকতায় সত্যের ভান আছে, কিন্তু তা অদ্ভুত আতিশয্যে স্ফীতকায়। রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি চিন্তায় কাল্পনিকতা নেই, তবে কল্পনার স্থান খুব প্রবল এবং সেটা যথার্থ। কারণ, কল্পনার বিস্তার না থাকলে কোনও তত্ত্ববিশ্ব গড়েই উঠতে পারে না।
রাবীন্দ্রিক ‘স্বদেশী সমাজ’-এর ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এ কালের ভাবুকদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন যে, এ হল এক কৌমের (community) ভাবনা। অধ্যাপক সেনের মতে ‘রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি ভাবনায় নিয়ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সর্বাঙ্গীন সমাজকল্যাণ। গোড়ার দিকে কৌম সমন্বয়ের দৃষ্টান্তেও তিনি নির্ধারিত কর্তব্যের হদিশ খুঁজতে চান। সমকালে কিন্তু তেমন উপায়ে কাজ হওয়ার নয়। এসেছে কৌমের বন্ধনরিক্ত কেমন খোলামেলা ব্যক্তিমানুষ। তার প্রতিক্রিয়ায় জাগে আত্মশক্তির প্রেরণা, একসঙ্গে ব্যক্তির সচেতন উদ্যোগ, কর্মকাণ্ড এবং সব জনহিতের আয়োজন’। ইউরোপীয় সিভিল সোসাইটির বর্গেও পুরোপুরি একে ব্যাখ্যা করা যাবে না, কারণ ঔপনিবেশিক জাঁতাকলে পিষ্ট অগোছাল ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় তেমন সুসংবদ্ধ আকার এর ছিল না। তথাপি রাষ্ট্রীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে সামাজিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য যখন আত্মশক্তিতে প্রাণিত ব্যক্তিসমষ্টির অবদানের কথা বলেন রবীন্দ্রনাথ, তখন কৌমের পরিবর্তে ‘সুশীল সমাজ’-এর আদলই ভেসে ওঠে বলে অধ্যাপক সেন মনে করেন।
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা বিশ্লেষণের যে-ধারা এতকাল বহমান ছিল, অধ্যাপক সেনের এই বই আদৌ তার অনুরূপ নয়। রাজনৈতিক তত্ত্বচিন্তার বিস্তৃত পাঠক্রমে রবীন্দ্রনাথকে কী ভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন, তার এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত হয়ে রইল এই গ্রন্থ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy