গদ্যসংগ্রহ বইটির সম্পাদকীয় ভূমিকায় একেবারে শুরুতেই যখন বলে দেওয়া হয়, এটি ‘পাপেট শিল্পী রঘুনাথ গোস্বামীর বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বিষয়ক প্রবন্ধের একটি সংকলিত গ্রন্থ’, তখন একটু বিরক্তি তৈরি হয় বইকী! রঘুনাথ হয়তো ‘অধুনা বাঙালি জনজীবনে বিস্মৃত এক নাম’ ঠিকই, তবু স্বয়ং সম্পাদক গোবর্দ্ধন অধিকারীর মতো যাঁরা তাঁকে মনে রেখেছেন, তাঁরা মনে রেখেছেন, পুতুলনির্মাণ, পুতুলনাট্য ও পুতুলচলচ্চিত্রের বর্ণময়, প্রাণস্ফূর্ত ক্ষেত্রটি রঘুনাথের যতই আদরের হোক, সেটি ছিল তাঁর সৃষ্টিপ্রতিভার বিচিত্র বহতা বিপুলপ্রসূ ধারার একটি স্রোত মাত্র, যা কোনও অর্থেই তাঁর কল্পনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল না। বরং অন্য একটা ভাবনা তাঁর চিন্তাকে অবিচল চালনা করত। সেই ভাবনার আবহ তৈরি হয়েছিল তাঁর সময়ের সাংস্কৃতিক রাজনীতির টানাপড়েনে। সদ্য যৌবনে উপনীত রঘুনাথ যখন বিজ্ঞাপনী ডিজাইন ও চিত্রণের পেশায় প্রবেশ করছেন, সেই পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে স্বদেশাভিমানের একটা নতুন চেতনা যেন জেগে উঠছিল। তার প্রভাবেই পণ্যের বিপণনে ও প্রচারে (তখনও সেই ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজি ও প্রতিষ্ঠানেরই প্রাধান্য)
দেশজতার একটা হাওয়া বইতে থাকে। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর রাজনৈতিক দর্শনে সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনার হাত ধরে একটা স্বদেশীয় শিল্পবিপ্লব তথা সর্বাত্মক ও গণতান্ত্রিক দেশোন্নয়নের যে প্রয়াস শুরু হয়েছিল, তারই মধ্য থেকে দেশের বৃহত্তর জনসমাজের অভ্যস্ত ও চিরাচরিত জীবনচর্যায় সতত বহমান দৃশ্যসম্পদ ও ভাষায় ‘সমাজসংযোগ’-এর (‘কমিউনিকেশন’ শব্দটির এই অনুবাদটিই রঘুনাথের পছন্দ) লক্ষ্য ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রঘুনাথ স্বভাবতই লক্ষ্য করেন, ‘যন্ত্র উৎপাদিত পণ্য তেল-সাবান-দাঁতমাজনের লেবেল, ব্যবসায় বাণিজ্য সংক্রান্ত প্রচার বা বিজ্ঞাপন, বইয়ের ছবি ও প্রচ্ছদ, প্রচারপুস্তিকার রূপগত পরিকল্পনা ও চিত্রকর্মের কাজ কমার্শিয়াল আর্ট নামে পরিচিত। কিন্তু সম্প্রতিকালে সমাজজীবনে এমন নতুন নতুন প্রযোজন দেখা দিয়েছে যে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিত্রকরের সহায়তা অপরিহার্য অথচ সেগুলি ঠিক কমার্শিয়াল আর্টের পরিসীমার মধ্যে পড়ে না। যেমন রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, এয়ারপোর্ট, শিক্ষালয়, হাসপাতাল, নানা রকমের পাবলিক বিলডিং, নানা রকমের প্রয়োজনীয় নির্দেশসূচক বোর্ড, সংকেত, শিক্ষাসহায়ক চিত্র, বিশেষ ধরনের চিত্রসংবলিত পুঁথি-পুস্তক নকশা, স্বাস্থ্য সহায়ক চিত্রগত নির্দেশ, বয়স্ক শিক্ষার উপযোগী চিত্রনির্ভর বই-প্রচারপত্র, গ্রাম ও শহরে সমাজ-উন্নয়ন কর্মীর পক্ষে প্রয়োজনীয় ভিস্যুয়াল কমিউনিকেশন, শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ ধরনের চিত্রকর্ম। তালিকাটি ক্রমবর্ধমান। কমার্শিয়াল আর্ট এই শব্দটি দিয়ে মানুষের সমাজজীবনে ক্রমবিবর্ধমান প্রয়োজনানুগ এইসব চিত্রকর্মকে চিহ্নিত করা যায় না বলে সম্প্রতি গ্রাফিক ডিজাইনের অন্তর্গত কিন্তু গ্রাফিক ডিজাইন তথাকথিত কমার্শিয়াল আর্ট বলতে যা বোঝায় তার চেয়ে বৃহত্তর ভূমিকা গ্রহণ করে এক ধরনের problem-solving design activity রূপে ভিস্যুয়াল কমিউনিকেশনের সমস্যা নিরসন করাটাই মূলত গ্রাফিক ডিজাইনারের কাজ।... বিজ্ঞাপন ও প্রচারের দাসত্ব কাটিয়ে গ্রাফিক ডিজাইনার ও এই কাজে নিযুক্ত চিত্রকররা নিজের বৃত্তির কার্যসাধিকা শক্তি সম্বন্ধে তীব্র ভাবে সচেতন হয়ে উঠছেন। গ্রাফিক ডিজাইন সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি অমিত শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি আজকের গ্রাফিক ডিজাইনারের কাছে একটি নবলব্ধ সচেতনতা।’
গ্রাফিক ডিজাইনারের এই ‘নবলব্ধ সচেতনতা’ই কি কোথাও বিজ্ঞাপনী প্রচারকলায় খ্যাতিমান ও কৃতবিদ্য শিল্পীর মধ্যে একটা গভীর দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছিল? সেই অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্য থেকেই তিনি যেন পেয়ে যান তাঁর অনুসন্ধায়ী বিবেকের মুক্তির আশা, ১৯৬৪ সালে কেন গারলান্ড ও বাইশজন গ্রাফিক ডিজাইনার, আলোকচিত্রী ও মিডিয়াকর্মী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে যা তিনি অনুবাদ করে দেন: ‘আমরা উপভোগভিত্তিক বিজ্ঞাপনব্যবস্থা বাতিল করার পরামর্শ দিচ্ছি না। তা সম্ভবও নয়। জীবনের মজার অংশটুকুর একেবারে ছেঁটে ফেলার পক্ষপাতী আমরা নই। আমরা শুধুমাত্র অন্যদিকটায় জোর দিতে চাই— আরও গভীর অন্তঃস্পর্শী ও দীর্ঘস্থায়ী কমিউনিকেশনের উপর— যার সামাজিক মূল্য আছে। আমরা আশা করব যে আমাদের সমাজ শুধুমাত্র কায়দাবাজ বাণিজ্যসংস্থা ও চালিয়াত বিক্রেতার মোহন ভোজবাজির খপ্পরে আমাদের ফেলে না রেখে সত্যকারের গঠনমূলক কাজের জন্য আমাদের দক্ষতার তলব করবেন।’ চিত্রবাণী নামে সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় রঘুনাথ একবার (তাঁর নিজের ভাষায়) ‘সমাজ ও ব্যক্তির সম্পর্কে যে পারস্পরিক আনুগত্য ও দায়িত্ববোধ নিহিত রয়েছে তার উপর ভিত্তি করে নতুন আদর্শে গ্রাফিক ডিজাইন প্রসঙ্গে একটি কোর্স পরিচালনা’ করেন।
বিজ্ঞাপনী চিত্রকলার পরম্পরার বিশ্লেষণ ও বিচারে রঘুনাথ তাঁর পূর্বসূরি ও সমকালীন শিল্পী পূর্ণ চক্রবর্তী, অন্নদা মুন্সী, মাখনলাল দত্তগুপ্ত, সত্যজিৎ রায়, ও সি (অরুণকুমার গঙ্গোপাধ্যায়) ও রণেনআয়ন দত্তের গ্রন্থচিত্রণ, প্রচ্ছদচিত্রণ ও বিজ্ঞাপনী চিত্রণের যে ইতিহাস গ্রথিত করেছেন (সুভো ঠাকুর সম্পাদিত ‘সুন্দরম’ পত্রিকায় এই লেখাগুলির অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছিল), তাতে স্পষ্ট হয়ে যায়, কী ভাবে বিদেশি বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলির দাবি পূরণে ‘কমার্শিয়াল আর্টের’ ‘মূলত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান’ যে চরিত্র ও ‘বিদেশি বই ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনচিত্র ও ইলাসট্রেশন... অন্ধভাবে অনুকরণ’ করার যে ‘ছব্বা’ চেপে বসেছিল, তা এই শিল্পীকুল ভেঙে ফেলে ‘গ্রাফিক ডিজাইনের ক্ষেত্রে এমন কিছু সৃষ্টি করতে চাইলেন যা চরিত্রের দিক থেকে হবে সৃজনধর্মী, বিদেশের প্রভাবমুক্ত এবং ভিস্যুয়াল ভোকাবুলারির দিক থেকে হবে দেশজ।’ রঘুনাথ ধরিয়ে দেন, ‘এই ধরনের চেতনায় সঞ্জীবিত মূলত বিজ্ঞাপন বা প্রচারশিল্পে লিপ্ত বেশ কয়েকজন শিল্পী বাংলা প্রকাশনের কাজে উৎকৃষ্ট নজির সৃষ্টি করেছেন।’ বিজ্ঞাপনী চিত্রণের কাজে বাজারিয়ানার যে নির্মম চাপ তা থেকে পালিয়ে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার তাগিদেই কি এই শিল্পীরা কমিউনিকেশন-এর বিপুল শক্তি ও জনমনে তার গ্রাহ্যতার বিজ্ঞানানুসারী অনুসন্ধানলব্ধ সিদ্ধান্ত অনুধাবন করে গ্রন্থচিত্রণ ও গ্রন্থসজ্জাবিন্যাসে, পুতুলনাট্য, পুতুলচলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র ও ক্ষুদ্রায়ত চিত্রের পরিসরে ডানা মেলেছিলেন? এঁদের প্রত্যেকের শিল্পশৈলীর অনুপুঙ্খ আলোচনায় ও ঐতিহাসিক ভাবে তাঁদের আদি পথপ্রদর্শক নন্দলাল বসুর কাজে রেখার সবল স্বচ্ছন্দ গভীরতা ও সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের পেশল অন্তঃসারতায় ‘দেশজ সংস্কৃতির মধ্যে জাত এবং লালিত’ ভারতবর্ষের রূপায়ণের বর্ণনায় রঘুনাথ তাঁদের প্রত্যেকের স্বাতন্ত্র্য ও এক প্রচ্ছন্ন যৌথ বোধের ইঙ্গিত দিয়েছেন। আবার তাঁদের মধ্যেও তিনি সত্যজিৎ রায়কে শীর্ষ সম্মান জানিয়ে লিখেছেন: ‘সত্যজিৎ স্টিরিওটাইপের খপ্পরে পড়েননি, একঘেয়ে কোনো ম্যানারিজ্ম্-এ বাঁধা পড়েননি। বিষয় অনুসারে নানা টেকনিকে ছবি এঁকে তিনি চাক্ষুষ করে তুলেছেন গ্রন্থের অন্তর্গত হর্ষ, বিষাদ, হাসিকান্না, ব্যঙ্গ-কৌতুক, ননসেন্স ও রহস্যরোমাঞ্চ। প্রয়োজনমতো টেকনিকের মতো বদল হলেও সমস্ত চিত্রকর্মে খুঁজে পাওয়া যাবে সত্যজিতের নিজস্ব স্টাইল।’
রঘুনাথ গোস্বামীর গদ্যসংগ্রহ-এ বিষয়বৈচিত্রের ব্যাপ্তি যতই রোমাঞ্চকর হোক, তাঁর বহু রকমের কাজের মধ্যেও যেমন (কেমন করে ভুলব গ্র্যান্ড হোটেলের সাঁতার পুলের ধারে তাঁর পরিকল্পনায়, তাপস সেনের আলোকসম্পাতে বাটার জুতোর মডেল-লীলা, ‘হট্টগোল বিজয়’ নামে সেই আশ্চর্য পুতুলচলচ্চিত্র, ‘অশ্বত্থামা’ নাটকের মঞ্চবিন্যাস, মিনিবই সমাহার!), তাঁর যাবতীয় লেখার মধ্যেও তেমনই থেকে যায় মানবমঙ্গলবোধের প্রতি এক একনিষ্ঠ আনুগত্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy