উপহার পেতে কার না ভাল লাগে? তা সে কোনও উৎসব-পার্বণেই হোক বা বিয়ে-থা, জন্মদিনের মতো অনুষ্ঠানে। কিন্তু কখনও কখনও কাছের মানুষগুলোর ভালবেসে দেওয়া সেই সব জিনিসেরপত্রের সঙ্গেও জুড়ে থাকে করের কাঁটা। ঠিক মতো বাছতে না-পারলে কিন্তু তার খোঁচা খেতে হবে আপনাকেই। তাই চলুন আজ দেখে নিই কারও থেকে কিছু পাওয়ার পরে কী কী বিষয় খেয়াল রাখলে উপহার নিয়ে অযথা বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না।
আইন বলে
১৯৫৮ সালের আইনে ছিল, যিনি উপহার দেবেন, কর বইবেন তিনিই। সেই আইন ১৯৯৮ সালে উঠে গিয়ে সব উপহার হয়ে যায় করমুক্ত। ২০০৪ সালে আবার বদল। আয়কর আইনের আওতায় ফিরে আসে উপহারে কর। তবে উপহার দাতা নয়, এখন সেই কর দিতে হয় প্রাপককে।
উপহার কোনটা?
প্রশ্নটা শুনে বিরক্ত হওয়ারই কথা। ভালবেসে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব যা দেন তা-ই যে উপহার, এটা আবার বলে দিতে হবে? কিন্তু করের হিসেব করতে খাতা-কলম নিয়ে বসলে কিন্তু এই প্রশ্নটাই সব থেকে জরুরি। যার একটা স্পষ্ট সংজ্ঞাও আছে— যে জিনিস পাওয়ার পরে আপনি তার বদলে প্রদানকারীকে কিছু দিচ্ছেন না। মোদ্দা কথা, যে বস্তুটির বিনিময়মূল্য বলে কিছু নেই।
তবে ব্যতিক্রম আছে। ধরা যাক, একটি ফ্ল্যাট ২০,০০,০০০ টাকার। কোনও আত্মীয় (আয়কর আইন মাফিক) ৫,০০,০০০ টাকার বেশি নিলেন না। এটা দান বা উপহারই। তবে বিনিময়মূল্যের একাংশ দেওয়া হল। এটাতেও উপহার কর প্রযোজ্য।
করের হিসেব
একটি অর্থবর্ষে হাতে আসা উপহারের মূল্য ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত হলে তা করমুক্ত। কিন্তু তার বেশি হলে পুরোটাতেই কর বসবে।
ধরুন, আপনি এক জনের ৫০,০০০ টাকা মূল্যের উপহার পেয়েছেন। অন্য জনের থেকে ২৫,০০০ টাকার। কর কিন্তু পুরো ৭৫,০০০ টাকার উপরেই দিতে হবে।
নগদে পেলে
একটি অর্থবর্ষে পাওয়া নগদ উপহার ৫০,০০০ টাকা পেরোলে তাতে কর বসবে। ওই নগদকে প্রাপকের অন্য সূত্র থেকে আয় হিসেবে দেখাতে হবে।
স্থাবর সম্পত্তির জন্য
১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইনের ১৭ নম্বর ধারা অনুসারে জমি-বাড়ির মতো স্থাবর সম্পত্তির রেজিস্ট্রি করানো বাধ্যতামূলক। তার জন্য স্ট্যাম্প ডিউটি এবং রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হয়। আয়কর আইনে আত্মীয়ের থেকে এই সম্পত্তি উপহার পেলে এই দুই হার কম হয়। না-হলে অনেকটাই বেশি।
ধরুন কেউ দানপত্র করে এমন সম্পত্তি দিল। মনে রাখবেন, স্ট্যাম্প ডিউটি হিসেব করতে সরকার নির্ধারিত বাজারদরের (সার্কল রেট) অঙ্ক ৫০,০০০ টাকা পেরোলেই কর লাগবে। হতেই পারে, দানপত্রে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের যে দাম লেখা (এডিকোয়েট কন্সিডারেশন), তা সার্কল রেটের চেয়ে কম বা বেশি। স্ট্যাম্প ডিউটি কমিয়ে দেখানোর জন্যও অনেক সময়ে তার অনেকটা ফারাক দেখানোর ঝোঁক থাকে। সে ক্ষেত্রে, দানপত্রে লেখা দর এবং স্ট্যাম্প ডিউটির জন্য নির্ধারিত বাজারদরের তফাত ৫০,০০০ টাকা পেরোলে এবং সেই পার্থক্যের হার ৫ শতাংশের বেশি হলে কর লাগবে।
উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে। ধরুন—
দানপত্রে লেখা ১ কাঠা জমির দাম ১,৫০,০০০ টাকা। স্ট্যাম্প ডিউটি হিসেবের জন্য দেখা গেল জমিটির বাজারদর ৪,০০,০০০ টাকা। অর্থাৎ দুই দামের ফারাক ২,৫০,০০০ (৪,০০,০০০-১,৫০,০০০) টাকা। এই অঙ্ক ৫০,০০০ টাকার বেশি তো বটেই। ৫% (১,৫০,০০০ টাকার ক্ষেত্রে ৭৫০০ টাকা) ছাড় ধরলেও, তার থেকে অনেকটা বেশি। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে করছাড় মিলবে না। তা দিতে হবে ২,৫০,০০০ টাকার উপরেই।
সাবধানের মার নেই
যে উপহার বা দান পাচ্ছেন সেটি যে করমুক্ত, তা প্রমাণের দায় কিন্তু আপনারই। তাই মাথায় রাখুন—
• জমি-বাড়ির মতো স্থাবর সম্পত্তি পেলে গিফ্ট ডিড রেজিস্ট্রি করান।
• সোনা, গয়নার ক্ষেত্রে পারলে দাতার থেকে হলফনামা, অলঙ্কারের ভ্যালুয়েশন রিপোর্ট নিন।
• উপহার পাওয়া চেক বা ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট ফোটোকপি করে রাখুন।
• সম্ভব হলে দাতার প্যান কার্ড এবং শেষ অর্থবর্ষের আয়কর রিটার্নের ফোটোকপি নিন। তাঁর দামি উপহার দেওয়ার সঙ্গতি সত্যিই আছে কি না, তা প্রমাণে কাজে লাগতে পারে।
আত্মীয় কারা
আয়কর আইনের ৫৬ ধারা অনুযায়ী আত্মীয়ের তালিকায় যাঁরা পড়েন, তাঁদের দেওয়া উপহার বা দানই শুধু কর রেহাইয়ের যোগ্য। এঁরা হলেন উপহার প্রাপকের—
• স্বামী অথবা স্ত্রী।
• ভাই কিংবা বোন।
• স্বামী/স্ত্রীর ভাই অথবা বোন।
• বাবা/মায়ের ভাই কিংবা বোন (কাকা, জ্যাঠা, পিসি, মামা, মাসি)।
• সরাসরি পূর্বসূরি বা বংশধর।
• স্বামী/স্ত্রীর সরাসরি পূর্বসূরি কিংবা বংশধর।
• উপরেরটি ছাড়া বাকিগুলিতে উল্লিখিত আত্মীয়ের স্বামী বা স্ত্রী।
উপহার অস্থাবর
নগদ অর্থ ছাড়াও উপহারের তালিকায় অস্থাবর সম্পত্তি থাকতে পারে—
• সোনা, রুপো, হিরের গয়না।
• সোনা, রুপোর কয়েন বা বার।
• শেয়ার, বন্ড।
• প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহ।
• আঁকা ছবি (ড্রয়িং)।
• রং ছবি (পেন্টিং)।
• আর্ট ওয়ার্ক বা মূর্তি ইত্যাদি।
নগদের কথা আগেই বলেছি। বাকিগুলিতেও স্থাবর সম্পত্তির নিয়মই প্রযোজ্য (৫% এডিকোয়েট কন্সিডারেশন বাদে)। তবে এগুলির ক্ষেত্রে কর হিসেবের জন্য বাজারদর স্থির করতে সার্কল রেটের বদলে ফেয়ার মার্কেট ভ্যালু বিচার্য।
যেমন ধরুন—
উপহার হিসেবে পাওয়া গয়নার দর ২,৫০,০০০ টাকা। প্রাপককে ওই পুরো টাকাতেই কর দিতে হবে। কিন্তু দানপত্রে বাজারদর ১,০০,০০০ টাকা লেখা থাকলে কর বসবে ১,৫০,০০০ (২,৫০,০০০-১,০০,০০০) টাকায়।
তবে গয়না বিয়েতে পাওয়া হলে তাতে কর লাগবে না।
যেখানে নিশ্চিন্তি
যে সমস্ত দান বা উপহারে কর নেই—
• আয়কর আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী কোনও আত্মীয়ের কাছ থেকে পাওয়া (সারণি দেখুন)।
• বিয়েতে পাওয়া।
• উইল বা উত্তরাধিকার সূত্রে পেলে।
• আয়কর আইনের ১০(২০) ধারা মাফিক স্থায়ী কর্তৃপক্ষের থেকে পেলে।
• ফান্ড, ফাউন্ডেশন, বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বা অন্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, ট্রাস্ট বা আয়কর আইনের ১০(২৩) ধারায় উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানের থেকে পেলে।
• ১২(এএ) ধারায় নথিভুক্ত ট্রাস্ট বা প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া সম্পত্তিতে।
দান করে ছাড়
কোনও কোনও নথিভুক্ত প্রতিষ্ঠানে দান করলেও করছাড় মেলে।
কিন্তু
আত্মীয়ের দেওয়া উপহারে কর বসে না ঠিকই। তবে সেই উপহার থেকে আপনার আয় হলে কিন্তু তার উপরে কর বসবে। তবে এই কর দিতে হবে যিনি উপহার দিচ্ছেন তাঁকে। একে ক্লাবিং অব ইনকাম বলে।
যেমন ধরুন, স্বামী তাঁর স্ত্রীকে জমা বা আয় থেকে ১০ লক্ষ টাকা উপহার দিলেন। স্ত্রীকে তাতে আয়কর দিতে হবে না। কিন্তু স্ত্রী যদি সেই টাকা স্থায়ী আমানতে রেখে সুদ পান, তা হলে সেই সুদ স্বামীর আয়ের সঙ্গে যোগ হবে এবং তাঁকে তাঁর আয়করের হার অনুসারে কর দিতে হবে।
করের হার
উপহারে করের আলাদা কোনও হার নেই। যিনি উপহার পাচ্ছেন, তাঁর অন্যান্য সূত্র থেকে আয় হিসেবে তা ধরা হয়। প্রাপকের আয়ের স্তর হিসেবেই করের হার স্থির হয় এবং সেই অনুযায়ী কর দিতে হয়।
উপহার এবং জিএসটি
নিয়োগকারীর থেকে পাওয়া ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত উপহারে কর্মীদের আয়কর দিতে হয় না। কিন্তু কোনও সংস্থার কাজে ব্যবহৃত সমস্ত পরিষেবা জিএসটি-র আওতায় আসে। ফলে এ ক্ষেত্রেও জিএসটি দিতে হবে সংস্থাকে।
ধরুন, সংস্থা কর্মীকে ২০,০০০ টাকার মোবাইল দিল ৫০০০ টাকায় অথবা বিনামূল্যে। সে ক্ষেত্রেও পুরো ২০,০০০ টাকার উপরে জিএসটি দিতে হবে সংস্থাকে। কিন্তু ওই ২০,০০০ টাকা নগদ দিলে জিএসটি বসবে না (কারণ এটি পণ্য বা পরিষেবা নয়)।
লেখক কর বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy