পরিচিতি: কস্তুরী (২৯)
সঞ্জয় (৩৪)
কী করেন: স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই বেসরকারি সংস্থার কর্মী। থাকেন জেলা শহরে
লক্ষ্য: লগ্নি পরিকল্পনা তৈরি। শ্বশুর, শাশুড়ি, বাবা ও মায়ের স্বাস্থ্য বিমা। ইচ্ছে, নিজেদের বাড়ি কেনা। সন্তানের জন্য সঞ্চয়। বেড়াতে যাওয়া
আজকের লেখা শুরু করব সকল পাঠককে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে। অতীতে বেশ কিছু পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিছু ক্ষেত্রে কঠোর ভাবেও বলতে হয়েছে। কারণ, শরীর এবং আর্থিক পরিকল্পনা— এই দু’টি বিষয়ে যত আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, ততই ভাল। প্রত্যেককেই বলার চেষ্টা করেছি, আয় যতই কম হোক না কেন, প্রথম থেকেই লগ্নি শুরু করা উচিত। আজকের মূল কথাও সেটাই।
গত বছর বিয়ে হয়েছে কস্তুরী ও সঞ্জয়ের। দু’জনেই চাকরি করেন। তবে লগ্নি পরিকল্পনা এখনও গুছিয়ে উঠতে পারেননি কেউ। হয়তো আলাদা করে তাঁদের বেতন আজকের দিনে খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু সঞ্জয়ের ফ্রিলান্সিংয়ের কাজ ধরে সব মিলিয়ে মাস গেলে হাতে আসে প্রায় ৩৫,০০০ টাকা। যা খুব একটা খারাপও নয়। দেখে নেব কী ভাবে লগ্নি শুরু করতে পারেন তাঁরা।
মিউচুয়াল ফান্ড
কস্তুরী জানতে চেয়েছেন মিউচুয়াল ফান্ড সম্পর্কে। যাঁরা সরাসরি শেয়ার বা ঋণপত্রের বাজারে লগ্নি করতে চান না, তাঁদের জন্য ভাল মিউচুয়াল ফান্ড। বাজারে অনেক ফান্ড সংস্থা রয়েছে, যারা লগ্নিকারীদের থেকে টাকা নিয়ে একটি তহবিল তৈরি করে। তার পরে সেই তহবিল খাটানো হয় বিভিন্ন জায়গায়। এই সিদ্ধান্ত নেন ফান্ড ম্যানেজার। কোথায় সেই টাকা লগ্নি হচ্ছে, মূলত সেই অনুসারে ফান্ডের নামকরণ হয়।
শেয়ার বাজার ভিত্তিক (ইকুইটি) ফান্ড
• মূলত বাজারে নথিভুক্ত সংস্থার শেয়ারে টাকা ঢালে। এই ফান্ড কনভার্টিবল ডিবেঞ্চারের মতো ইকুইটি নির্ভর অন্যান্য প্রকল্পেও টাকা রাখতে পারে।
• এই ফান্ডের লক্ষ্য হল দীর্ঘ মেয়াদে লগ্নিকারীর তহবিল চোখে পড়ার মতো বাড়িয়ে তোলা। ফলে ফান্ড ম্যানেজার শেয়ার বাছেন সে ভাবেই।
• শেয়ার বাজারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ইকুইটি ফান্ডে ঝুঁকির মাত্রা বেশি।
• কোন ধরনের সংস্থার ফান্ডে টাকা ঢালা হচ্ছে, সেই অনুসারে ফান্ডের চরিত্র বদলায়। নামকরণও হয় তার ভিত্তিতে। যেমন, ডাইভার্সিফায়েড ফান্ড বিভিন্ন শিল্পের নানা ধরনের সংস্থা মিলিয়ে মিশিয়ে লগ্নি করে।
ডেট ফান্ড
• এই ফান্ডের টাকা খাটে ঋণপত্র নির্ভর সিকিউরিটিতে। তা বন্ড, ডিবেঞ্চার, সরকারি সিকিউরিটি, ট্রেজারি বিল ইত্যাদি হতে পারে।
• সাধারণত লগ্নির মেয়াদ এবং কে ওই সিকিউরিটি ছাড়ছে, তার উপরে ফান্ডের রিটার্ন ও ঝুঁকি নির্ভর করে।
• তবে ইকুইটি ফান্ডের তুলনায় ঝুঁকি এখানে কম।
সঞ্চয় কী ভাবে
কস্তুরী জানতে চেয়েছেন, কোন খাতে কী ভাবে টাকা রাখা যায়। খরচের পরে ১৫,০০০-২০,০০০ টাকা থাকে।
• একটা পিপিএফ অ্যাকাউন্ট খুলুন এবং মাসে চেষ্টা করুন অন্তত ৫,০০০ টাকা করে রাখতে। ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে এই প্রকল্প খোলা যায়। যার মেয়াদ ১৫ বছর। এখানে বছরে সর্বাধিক ১.৫ লক্ষ টাকা রাখা যায়, যার পুরোটাতেই করছাড় মেলে। সুদ এবং মেয়াদ শেষের টাকাও করমুক্ত।
• মাসে ৫,০০০ টাকা করে ডাইভার্সিফায়েড ইকুইটি ফান্ডে লগ্নি শুরু করুন। তবে মাঝপথে এখান থেকে টাকা তোলা যাবে না, এমনটা ধরেই এগোন। না-হলে কিন্তু লগ্নি পরিকল্পনা ধাক্কা খাবে।
লগ্নির শুরুতেই মাথায় রাখতে হবে এখনকার রিটার্নের হিসেব দিয়ে পরের তহবিল ঠিক করা যাবে না। এ জন্য জরুরি মূল্যবৃদ্ধিকে মাথায় রাখা এবং সেই অনুসারে টাকা ঢালা।
পরিবারের স্বাস্থ্য বিমা
• অনেক বিমা সংস্থাই বয়স্ক মানুষদের স্বাস্থ্য বিমা করাতে চায় না। তাই প্রথমে একটু নেট ঘেঁটে দেখে নিতে হবে কোন সংস্থা তা দিচ্ছে। তাদের প্রিমিয়াম কী রকম। আগে থেকে থাকা রোগের ক্ষেত্রে কত দিন অপেক্ষা করতে হবে চিকিৎসার টাকা পেতে। কস্তুরী লিখেছেন যে, তাঁর মায়ের হৃদরোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে কয়েকটি বিমা সংস্থার সঙ্গে আগে কথা বলে নিন। দেখুন সর্বাধিক কত টাকার বিমা করাতে তারা রাজি।
• নিজেদের জন্য আলাদা করে ফ্যামিলি ফ্লোটার বিমা কিনুন। তবে দু’ক্ষেত্রেই দেখে নিতে হবে বিমায় যেন কোনও লিমিট না-থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনও রোগের চিকিৎসায় নির্দিষ্ট অঙ্ক পর্যন্তই বিমার টাকা মেলে। আবার কোথাও নিজেদের পকেট থেকে খরচের কিছু অংশ দিতে হয়। বিমা কেনার আগে এই সব বিষয়ই খতিয়ে দেখে নিতে হবে। দরকারে নেটে বিভিন্ন বিমা সংস্থার নাম দিয়ে সার্চ করে প্রকল্পগুলির তুলনা করুন।
সন্তানের পরিকল্পনা
• এক-দু’বছরের মধ্যে সন্তানের পরিকল্পনা রয়েছে দু’জনের। মনে রাখতে হবে, সব বিমা সংস্থা কিন্তু এ জন্য হাসপাতালের খরচ দেয় না। যখন নিজেদের জন্য বিমা কিনবেন, তখনই সে বিষয়টিও দেখে নিতে হবে।
• সন্তানের জন্মের আগেও দীর্ঘ দিনের চিকিৎসার খরচ লাগবে। সে জন্য এখন থেকেই লিকুইড ফান্ডে টাকা রাখতে হবে। চাইলে ২,০০০ টাকা করে সেখানে রাখুন। মূল্যবৃদ্ধি ধরলেও বেশ কিছুটা টাকা জমবে।
কিনুন টার্ম প্ল্যান
সঞ্জয়ের এখন যে এনডাওমেন্ট পলিসিটা রয়েছে, তাতে রিটার্ন খুব একটা বেশি পাবেন বলে মনে হয় না। তার উপরে বিমার কভারেজও সে রকম বেশি হবে না। ফলে পলিসির কাগজ দেখুন। দরকারে সংস্থার সঙ্গে কথা বলুন। যদি নির্দিষ্ট সময় (কোনও কোনও ক্ষেত্রে চার বছর) প্রিমিয়াম দেওয়া হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে তা পেড-আপ করুন।
কস্তুরী এবং সঞ্জয় পরিবারে কিছুটা হলেও টাকা দেন। ফলে একটা দায়িত্ব থেকেই যায়। এই সবই মাথায় রেখে বলব অবশ্যই নিজেদের জন্য একটা করে টার্ম প্ল্যান কিনুন। এটা অনেকটা স্বাস্থ্য বিমার মতো। এতে মেয়াদ শেষে টাকা মেলে না। কিন্তু প্রথাগত প্রকল্পের তুলনায় অনেকটাই বেশি কভারেজ পাওয়া যায়। আমার মতে, প্রথমে দু’জনে ১৫ লক্ষ টাকা করে মোট ৩০ লক্ষের টার্ম পলিসি করতে পারেন।
সন্তানের ভবিষ্যৎ
সন্তানের জন্মের পরেই মাসে কমপক্ষে ৩,০০০ টাকার এসআইপি করতে হবে। এ জন্য বাছতে হবে ইকুইটি ফান্ড। তবে তা চালিয়ে যেতে হবে দীর্ঘ মেয়াদে। মাঝে তুললে চলবে না।
বাড়ি কেনা
বাড়ি কেনা যদি খুব জরুরি না-হয়, তা হলে এখন সেটা নিয়ে ভাববেন না। বরং আশু সমস্যা মেটানো জরুরি। আর দরকার নিজেদের পায়ের নীচের জমি পোক্ত করা। চাইলে ২,০০০ টাকা করে ডেট ফান্ডে লগ্নি করতে পারেন। সেটা পরে বাড়ির ডাউনপেমেন্টে কাজে লাগতে পারে। নয়তো অন্য কোনও খাতেও তা ব্যবহার করা যাবে।
অবসরের লগ্নি
পিপিএফ এবং ডাইভার্সিফায়েড ফান্ডে লগ্নির কথা আগেই বলেছি। সেগুলি চালিয়ে যান। এর সঙ্গে অল্প অল্প করে সেভিংসে টাকা জমিয়ে ফিক্সড ডিপোজ়িট করে রাখতে হবে। তার সঙ্গে যখনই বেতন বাড়বে, তখনই নতুন একটা এসআইপি শুরু করতে হবে। ধরে নিতে হবে যে ওই মাইনে আদৌ বাড়েনি। না-হলে কিন্তু ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে।
চাকরির সূত্রে রাজ্যের বাইরে
যদি রাজ্যের বাইরে সত্যিই ভাল সুযোগ পান, অবশ্যই তা নেওয়া উচিত। হয়তো হাতে বেতনও এখনকার তুলনায় বেশি আসবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে তখন রাজ্যের বাইরে আলাদা সংসার চালাতে হবে। আবার পরিবারকেও টাকা দিতে হবে। সঙ্গে সন্তানের স্কুল, কলেজের খরচও থাকবে। এটা দেখে ভাল লাগল যে, বাইরে যাওয়ার জন্য খরচের চিন্তার কথা তাঁদের মাথায় রয়েছে। আমি বলব ১,০০০ টাকা করে ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডে রাখুন।
বেড়াতে যাওয়া
দীর্ঘ দিন ধরে টানা কাজ করে যাওয়ার পরে বেড়াতে যেতে আমাদের সকলেরই ভাল লাগে। তবে দেখতে হবে, তা যেন সাধ্যের মধ্যে থাকে। তাই পাঁচ বছর পরে পরিবারের সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন এই মুহূর্তে না-দেখাই ভাল। তবে হ্যাঁ, কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসাই যায়। সঞ্জয়ের ফ্রিলান্সিংয়ের টাকা থেকে পারলে ১,০০০ টাকা করে রেকারিং করুন। তার সঙ্গে যদি অন্যান্য খাতে টাকা হাতে আসে, সেই টাকা দিয়ে কাছেপিঠে ঘুরে আসতে পারবেন।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy