Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
PPF

দুই গাছই বাড়ুক

এক দিকে পিপিএফ, অন্য দিকে ইএলএসএস। কোনটা এখন, কোনটা পরে— এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পথে হঠাৎ এল অতিমারি। তার পরেই সব এলোমেলো। করোনা এখনও যায়নি। তবে এলোমেলো বাগান ফের গোছাতে বসে মনে হচ্ছে, সব গাছই বাড়ুক না নিজের মতো। লিখছেন আদিল শেঠিগত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন আয়করের দ্বিতীয় মডেল আনার কথা জানিয়েছিলেন। সেটি বাছলে করের বোঝা কমবে ঠিকই, কিন্তু কিছু লগ্নি প্রকল্পে করছাড়ের সুবিধা মিলবে না।

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২০ ০৩:১৯
Share: Save:

হিসেব মিলছে না কিছুতেই? ছ’সাত মাস ধরে করোনাকে সামলাতে গিয়ে পাবলিক প্রভিডেন্ড ফান্ড (পিপিএফ) এবং ইকুইটি লিঙ্কড সেভিংস স্কিমের (ইএলএসএস) কথা ভুলে যাওয়ার কারণে নয়তো? কর সাশ্রয়ের প্রশ্নে যাদের নিয়ে বিস্তর তর্কাতর্কি চালিয়েছেন এক সময়। যুক্তি-পাল্টা যুক্তির বন্যা বইয়েছেন লগ্নি ও সঞ্চয়ের তালিকায় কোনটিকে অগ্রাধিকার দেবেন, তা নিয়ে। অতিমারির যাওয়ার নাম নেই, কিন্তু ওই বিতর্ক ও প্রশ্নগুলিকে ভুলে গেলে চলবে না। কারণ ফের লগ্নি ও কর সাশ্রয়ে মন দিতে হবে। তাই আজ শুধু এই দু’টির সুবিধা-অসুবিধার তুলনা নিয়েই আলোচনায় বসি চলুন।

দুই প্রকল্প

পিপিএফ

• ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্প। নিশ্চিত, নির্দিষ্ট রিটার্ন দেয়। সরকারি গ্যারান্টিও।

• ডাকঘর এবং বিভিন্ন ব্যাঙ্কের শাখায় অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। ভরতে হয় ফর্ম, দিতে হয় ছবি ও ব্যক্তিগত নথি।

• বছরে অন্তত একবার এবং সর্বাধিক ১২ বার টাকা জমা দেওয়া যায়। তবে একটি অর্থবর্ষে ১.৫ লক্ষ টাকার বেশি জমা দেওয়া যায় না।

• প্রকল্পের মেয়াদ ১৫ বছর। ছ’বছর পরে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা তোলা যায়।

• প্রতি ত্রৈমাসিকে একবার সুদ ঠিক হয়। এখন সুদ ৭.১%। প্রতি বছরের ৩১ মার্চ চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ জমা পড়ে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে।

ইএলএসএস

• বাজার নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ড।

• একলপ্তে টাকা রাখা যায়। আবার মাসে মাসেও কাটানো যায় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে।

• লক-ইনের মেয়াদ তিন বছর। তার আগে টাকা তোলা যায় না।

• ইএলএসএসের ঝুঁকি মাঝারি থেকে উঁচু। রিটার্ন নির্ভর করে যে ফান্ডে টাকা ঢালছেন তার উপরে।

• বছরে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা নেই। তবে আয়কর আইনের ৮০সি ধারায় ১.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জমাতেই আয়কর ছাড় পাওয়া সম্ভব।

অতিমারির যে বিরূপ প্রভাব শেয়ার বাজারে পড়েছিল, তাতে ধাক্কা খেয়েছে ইকুইটি ফান্ডগুলিও (শেয়ার নির্ভর)। ফলে কমেছে তাদের রিটার্ন। দেখা গিয়েছে, গত এক বছরে ইএলএসএস প্রকল্পগুলি ৫.৩% রিটার্ন দিয়েছে। তিন বছরে দিয়েছে ২.২৬%। আবার গত পাঁচ বছরে ৭.৫৮% এবং ১০ বছরে ৮.২৮%। অতিমারির আগে পর্যন্ত রিটার্নের ছবিটা তুলনায় ভাল ছিল। অর্থাৎ, এর রিটার্ন অনেকটাই দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। তবে অভিজ্ঞতা বলছে, দীর্ঘমেয়াদে ইএলএসএস করলে রিটার্ন বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। কমে ঝুঁকিও। প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট ফান্ডটি বাছার আগে তার অতীতের রেকর্ড এবং রেটিং দেখে নেওয়া জরুরি। পিপিএফের ক্ষেত্রে সেই ঝুঁকি নেই। তবে কয়েক বছরে ক্রমাগতই কমেছে এই প্রকল্পের সুদ।

করের সুবিধা

সঞ্চয় প্রকল্প তো অনেক আছে। কিন্তু রিটার্নে সুদের হিসেব কষার পরে প্রকৃত রিটার্ন হাতে কত থাকে, তা মূল্যবৃদ্ধির হারকে ছাপিয়ে যেতে পারছে কি না, সেগুলিও গুরুত্বপূর্ণ। পিপিএফ এবং ইএলএসএসে কিন্তু আয়কর আইনের ৮০সি ধারায় করছাড়ের সুযোগ মেলে বছরে সর্বাধিক ১.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত (৮০সি ধারার সব প্রকল্প মিলিয়ে)। এই সুবিধা তাদের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।

• পিপিএফের লগ্নি, লগ্নির উপরে মেলা সুদ ও অ্যাকাউন্ট থেকে পাওয়া টাকা— তিনটিই করমুক্ত। অন্য দিকে, ইএলএসএসের দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভ যদি বছরে ১ লক্ষ টাকার বেশি হয়, তা হলে সেই বাড়তি মুনাফার উপরে ১০% কর গুনতে হয়। ফলে ইএলএসএস অ্যাকাউন্ট থেকে বছরে ১ লক্ষ টাকার কম মুনাফা তুললে করের বোঝা চাপবে না।

• ইতিমধ্যে যা বিনিয়োগ রয়েছে, সেই বাবদ কেমন করছাড় পাচ্ছেন এবং আরও পেতে গেলে কতটা বিনিয়োগ করতে হবে তার হিসেব আগে কষে নিন। সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিন কোনটায় কতটা পুঁজি ঢালতে হবে।

বিনিয়োগের অঙ্ক

• ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে বছরে যে কোনও অঙ্ক রাখা যায় ইএলএসএস প্রকল্পে। তবে বছরে সর্বোচ্চ ১.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্তই করছাড়ের সুবিধা দাবি করা যাবে। পিপিএফের ন্যূনতম বিনিয়োগের অঙ্কও বছরে ৫০০ টাকা। তবে বছরে ১.৫ লক্ষ টাকার বেশি বিনিয়োগ করা যায় না।

• পিপিএফে বছরে এক থেকে ১২ বার টাকা জমা দেওয়া যায়। এক একটি কিস্তিতে গ্রাহক ক্ষমতা অনুযায়ী যে কোনও অঙ্ক জমা করতে পারেন। যে অঙ্কই জমা দিন, আমি বলব মাসের ৫ তারিখের আগে দেওয়া ভাল। কারণ, ওই তারিখে তহবিলের সুদের হিসেব কষা হয়। অন্য দিকে, ইএলএসএসের লগ্নি যেমন একবারে করা যায়, তেমনই ব্যাঙ্কে স্ট্যান্ডিং ইনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে এক মাস, তিন মাস কিংবা ছ’মাস অন্তর টাকা জমা করা যায়। এসআইপি মারফত। বাজারের অনিশ্চয়তার আশঙ্কা কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদে রিটার্ন ভাল পেতে এই ভাবে এসআইপি পথে প্রতি মাসে ইএলএসএস করাই ভাল।

নগদ লাগলে

প্রয়োজন পড়লে কত আগে কী ভাবে নগদ হাতে পেতে পারেন, এই দিক থেকে ইএলএসএস কিছুটা এগিয়ে। যদিও এতে পুঁজি তিন বছরের জন্য আটকে থাকে। তবে পিপিএফে ১৫ বছর পরে পুরো সম্পদ হাতে পাওয়া যায়। ছ’বছর পর থেকে সেই তহবিলের আংশিক টাকা তোলার সুযোগ রয়েছে। আবার ১৫ বছর শেষ হলে পিপিএফের মেয়াদ পাঁচ বছর করে বাড়ানো যায়।

শুরুর সময়

ফর্ম ভরা। কেওয়াইসি নথি জমা দেওয়া। প্রকল্প শুরুর প্রক্রিয়া। কোনওটিতেই জটিলতা নেই। তবে কেওয়াইসি নথি-সহ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকলে, বাড়িতে বসে নেটেই ইএলএসএস চালু করা যায়। পিপিএফ অ্যাকাউন্ট খুলতে হয় ডাকঘর বা ব্যাঙ্কের শাখায়। কয়েকটি ব্যাঙ্ক অবশ্য অনলাইনে পিপিএফ চালুর ব্যবস্থা করেছে। তবে মনে রাখতে হবে, এসআইপি মারফত বা এককালীন, ইএলএসএস যেমন যতগুলি ইচ্ছা এবং বিভিন্ন মেয়াদের খোলা যায়। কিন্তু পিপিএফ অ্যাকাউন্ট এক জনের একটির বেশি থাকতে পারে না।

ঋণ নিতে হয় যদি!

প্রকল্প থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকলে সেটা অবশ্যই বাড়তি সুবিধা। হঠাৎ কোনও দরকার হলে এই সুযোগকে কাজে লাগানো যায়। তবে এই ধরনের ঋণ নেওয়ার আগে সমস্ত শর্তাবলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে নেওয়া দরকার। কারণ, এ ক্ষেত্রে সুদের পাশাপাশি কিছু জটিল শর্তও থাকে।

• পিপিএফের ক্ষেত্রে তৃতীয় অর্থবর্ষের পর থেকে ঋণ নেওয়া যায়। তবে ঋণের অঙ্ক জমা তহবিলের ২৫ শতাংশের বেশি হবে না। ডিসেম্বর থেকে এই ঋণে সুদ হতে চলেছে পিপিএফ প্রকল্পের সুদের চেয়ে ১% বেশি। তবে ৩৬ মাসের মধ্যে ঋণ শোধ করতে হবে। না-হলে তার পর থেকে বাড়তি ৬% সুদ গুনতে হবে। ঋণ শোধের আগে পর্যন্ত পিপিএফের সুদ জমা কিন্তু স্থগিত থাকে। ঋণ নেওয়ার এটি মাথায় রেখে এগোতে হবে।

• যে কোনও ধরনের মিউচুয়াল ফান্ড প্রকল্পের উপরেই ঋণ নেওয়া যায়। তবে তার শর্ত নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ফান্ড এবং ব্যাঙ্কের উপরে। কারণ, আপনার মিউচুয়াল ফান্ড অনেকটা বন্ধকের মতো কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে সুদের হার হয় ১১ শতাংশের কাছাকাছি। গুনতে হতে পারে প্রসেসিং ফি।

শেষের কথা

গত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন আয়করের দ্বিতীয় মডেল আনার কথা জানিয়েছিলেন। সেটি বাছলে করের বোঝা কমবে ঠিকই, কিন্তু কিছু লগ্নি প্রকল্পে করছাড়ের সুবিধা মিলবে না। পিপিএফ এবং ইএলএসএস-ও সেই তালিকায় আছে। পুরনো না নতুন, কোন ব্যবস্থায় কর দেবেন আপনার সিদ্ধান্ত। রোজগার এবং বিনিয়োগের হিসেবের উপর দাঁড়িয়ে ঠিক করতে হবে। প্রয়োজনে আর্থিক পরামর্শদাতারও সাহায্য নিতে পারেন। নতুন ব্যবস্থায় এক বার রিটার্ন দাখিল করলেও পুরনো ব্যবস্থায় ফেরার সুযোগ রয়েছে। তবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পরামর্শ— নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও বিনিয়োগে দাঁড়ি টানবেন না। বিমা, পিপিএফ, ইএলএসএস শুধু করা সাশ্রয়ের অস্ত্র নয়। ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত রাখারও ছাতাও। তখন বরং করের চাপকে মাথা থেকে বার করে স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক লক্ষ্যের দিকে মন দেওয়া সহজ হবে।

লেখক ব্যাঙ্কবাজার ডটকমের সিইও

(মতামত ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

PPF ELSS
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy