Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Petrol price

Petrol Price: জ্বালানির উপর থেকে কর কমাবে কেন্দ্র? কোষাগারের হাল আর বৈদেশিক ঋণ কিন্তু সহমত হবে না

যদি বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম কমে, তা হলে হয়তো আগামীতে আমার আপনার স্বস্তির কিছুটা জায়গা তৈরি হতে পারে।

সুপর্ণ পাঠক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২১ ১১:০০
Share: Save:

পেট্রল আর ডিজেলের দাম কমাতে কি কেন্দ্র বা রাজ্য কর কমানোর রাস্তায় হাঁটবে? কোষাগারের হাল ও বৈদেশিক ঋণ শোধের দায়ের প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এক কথায়, ‘না’। তবে ওপেক উৎপাদন বাড়াতে রাজি হয়েছে। তাতে যদি বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম কমে, তা হলে হয়তো আগামীতে আমার আপনার স্বস্তির কিছুটা জায়গা তৈরি হতে পারে। তবে না হলেও অবাক হওয়ার কারণ দেখি না। এবং তাও ওই কোষাগারের হালের কারণেই।
চলতি বছরের ২২ মার্চ মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, ২০২০-’২১ অর্থবর্ষের প্রথম ১০ মাসে শুধু পেট্রল আর ডিজেলের উপর বসানো কর থেকেই কেন্দ্রীয় কোষাগারে এসেছে ২ লক্ষ ৯৪ হাজার কোটি টাকা। মনে রাখতে হবে মন্ত্রী যখন এই হিসাব দিচ্ছেন তখনও বছর শেষ হয়নি। আরও মাথায় রাখতে হবে যে সেই বছরের সংশোধিত বাজেট প্রস্তাবে কর বাবদ ১৩ লক্ষ ৪৪ হাজার কোটি টাকার একটু বেশি আয়ের কথা বলা হয়েছিল। তাই মাথায় রাখতে হবে, বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে কিন্তু সোনার ডিম পেড়েই চলেছে পেট্রোলিয়াম হাঁস।
লিটারে কত টাকা শুল্ক? অনুরাগ ঠাকুর যে দিন এই উত্তর দিচ্ছেন সেই দিনই সকালে দিল্লিতে পেট্রলের দাম লিটার প্রতি ৬৯ টাকা ৫৯ পয়সা আর ডিজেলের ক্ষেত্রে তা ৬২ টাকা ২৯ পয়সা। ২০১৪ সালে বর্তমান সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন পেট্রলের উপর উৎপাদন শুল্ক ছিল লিটারে ৯ টাকা ৪৮ পয়সা, আর ডিজেলে ৩ টাকা ৫৬ পয়সা। অনুরাগ ঠাকুরের দেওয়া উত্তর অনুযায়ী তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৩২ টাকা ৯০ পয়সা এবং ৩১ টাকা ৮০ পয়সা! অর্থাৎ দামের প্রায় ৫০ শতাংশ কেন্দ্রীয় করের কারণেই। আর যার মধ্যে মাত্র পাঁচ টাকার মতো থাকছে যৌথ রাজস্ব খাতে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

মাথায় রাখতে হবে জ্বালানির দাম বাড়ালে তার একটা রাজনৈতিক অনুরণন থেকেই যায়। তাই রাজকোষ নড়বড়ে না হলে কোনও সরকারই এই চাপ নিতে চাইবে না। আর কেন্দ্রের চাপ যদি বেড়ে এমন জায়গায় পৌঁছয় যে যৌথ রাজস্ব খাতে না তুলে শুধু কেন্দ্রীয় কোষাগার ভরার রাস্তাতেই হাঁটতে হয়, তা হলে তো কেন্দ্রের আর্থিক অবস্থা নিয়ে একটা সংশয়ের জায়গা তৈরি হয়েই যায়!
অনুরাগ ঠাকুরের উত্তর বলছে ২০১৪ সালে পেট্রল এবং ডিজেল থেকে কর বাবদ আয় ছিল গোটা কর বাবদ রাজস্ব আয়ের ৫.৪ শতাংশ। তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.২ শতাংশ।
শুধু তাই নয়, ২০২০ সালের শুধু মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে পেট্রলের উপর কেন্দ্রীয় শুল্ক বেড়েছে ১৩ টাকা আর ডিজেলের উপর ১৬ টাকা! এই হিসাব ২০২০ সালের মে মাসের ৬ তারিখের।
এ তো গেল করের হিসাব। কিন্তু কেন? শুধু সমালোচনার জন্য সমালোচনা আর অভিযোগের আঙুল তুলে লাভ নেই। কোথাও গিয়ে মূল প্রশ্নগুলোকে খতিয়ে দেখাটা জরুরি। পেট্রোপণ্যের উপর এই করের চাপ কী কারণে সেই প্রশ্নটা কিন্তু খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা উচিত।
মাথায় রাখতে হবে ব্যবসার বহর না বাড়লে সংস্থার আয় বাড়ে না। ঠিক একই ভাবে কোনও দেশে যদি আর্থিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির হার না বাড়ে তা হলে কোষাগারও তার স্বাস্থ্য হারায়। বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ভারতের জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হার ক্রমাগত পড়েছে। আর তার প্রভাব তো শেষে গিয়ে কোষাগারে পড়বেই।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

টেবিলে চোখ রাখলেই দেখতে পাওয়া যাবে দেশের অর্থনীতির হাল। ২০১৬ সালে যেখানে বৃদ্ধির হার ছিল ৮ শতাংশের উপর। সেখানে ২০১৯ সালে এসে বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৪ শতাংশের একটু উপরে। ২০২০ সালকে এই হিসাবে বাদ রাখার কারণ অনুমানের অপেক্ষা রাখে না। বৃদ্ধির হারের এই সঙ্কোচন যে অবশ্যই তার ছায়া রাজস্ব আয়ের উপর ফেলবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মাথায় রাখতে হবে এই ২০১৯ সালই কিন্তু ভারতের কোষাগারের ইতিহাসে এক বিশেষ মাইলফলক। তা খুব শ্লাঘার নয়। এই বছরেই রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকায়। দেশের বাজেটের ইতিহাসে এই বছরেই প্রস্তাবিত কর আর আদায়ের মধ্যে ফারাক রেকর্ড পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। এই ঘাটতির চাপ মেটাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা কোষাগারে ঢোকাতে বাধ্য হয় কেন্দ্র।
এই টাকা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে বার করা আদৌ উচিত হয়েছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক এখনও চলছে। কিন্তু ২০১৯ সালে এসেই যে প্রশ্নের মুখে আমরা দাঁড়িয়ে পড়েছি সেটা হল, আর্থিক বৃদ্ধির হারের ক্রমাগত সঙ্কোচনের প্রবাহের মধ্যেও কেন্দ্রীয় সরকার কিন্তু আয়-ব্যয়ের হিসাব করতে গিয়ে বাস্তবটা মানতে অস্বীকারই করে এসেছে। আর খরচের বহর সামলাতে তাদের হাত বাড়াতে হয়েছে নাগরিকের নিত্য ব্যবহারের পণ্যের দিকে। কর বসিয়েছে এমন ভাবে যাতে তা যৌথ খাতে না হয়। আর কেন্দ্রের রাস্তায় হেঁটেই রাজ্যগুলিকেও জিএসটি-র আওতার বাইরে হাতে থাকা কয়েকটি খাতেই কর বাড়াতে হয়েছে। কোষাগার সামলাতে যার অন্যতম অবশ্যই পেট্রোপণ্য।
প্রশ্ন উঠেছে করের বোঝা হালকা করতে কেন্দ্র ঋণ করছে না কেন? তারও উত্তর রযেছে কোষাগারের দুরবস্থাতেই। আমরা যখন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে যাই, ব্যাঙ্ক শুধু আমাদের আয়ই খতিয়ে দেখে না, দেখে নেয় আমাদের দায়ের হিসাবও। মাসিক রোজগারের কত টাকা আমরা ঋণ নিলে ব্যাঙ্ককে ফিরিয়ে দিলেও সংসার চালাতে অসুবিধা হবে না সেটা দেখে নেয় ব্যাঙ্ক। তার কারণ একটাই। ব্যাঙ্ক চায় না ঋণের খেলাপ হোক। দেশের ক্ষেত্রেও অঙ্কটা একই। দেশের ক্ষেত্রে ঋণ চোকানোর দায়ের অনুপাতকে কারেন্ট ইনকাম বা রাজস্ব আয়ের ৮ শতাংশের মধ্যে ধরে না রাখলে বিশ্ব বাজারে ঋণ পাওয়া সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

কতটা? এটা বোঝার জন্য ফিরে যেতে হবে ১৯৯০-’৯১ সালে। ১৯৯১ সালের জুন মাসে নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী হন আর অর্থমন্ত্রীর দায়ভার নেন মনমোহন সিংহ। রাজকোষের হাল খারাপ। এতটাই যে বাজারে কেউ ঋণ দিতেও রাজি নয়, কারণ ভারত তা শোধ করতে পারবে না এই ভয়ে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে যে সোনা আছে তা বন্ধক দিয়ে ঋণ নেওয়ার।
কিন্তু কোনও দেশই তাতে রাজি হয় না। শর্ত দেওয়া হয় সোনা সরাসরি ঋণদাতাদের কোষাগারে তুলে দিতে হবে বন্ধক হিসাবে। সেই শর্ত মেনে ৪৬.৯১ মেট্রিক টন সোনা ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ড এবং ব্যাঙ্ক অব জাপানে গচ্ছিত রাখা হয়। এর বিনিময়ে ৪০ লক্ষ ডলার ঋণ নিয়ে কোষাগারের অবস্থা সামলানো হয়। সেই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই অবশ্য বন্ধক ছাড়িয়ে নেওয়া যায়, দেশের আর্থিক হালের উন্নতি হওয়ার কারণে। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া প্রকাশিত ‘অ্যান অ্যাসেসমেন্ট অব ইন্ডিয়া’স এক্সটারনাল ডেট’ রিপোর্টটিতে মনমোহন সিংহের রাজকোষকে ঘুরে দাঁড় করানোর কৌশলের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।
প্রসঙ্গে ফেরা যাক। চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষে ভারতে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে মার্কিন ডলারে ৫৭ হাজার কোটি। ২০২০ সালের বৈদেশিক ঋণ থেকে যা ১ হাজার ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার বেশি। অর্থাৎ বৈদেশিক ঋণ বাড়ছে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

একই সঙ্গে কিন্তু কমছে রাজস্ব খাতে আয়। বাড়ছে জাতীয় ঋণের তুলনায় ঋণের অনুপাতও। মার্চের শেষে এই অনুপাত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১.১ শতাংশে যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ২০.৬ শতাংশে। অর্থাৎ আয়ের তুলনায় ঋণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। আর পাটিগণিতের সোজা অঙ্কেই আয়ের তুলনায় ঋণ শোধের দায় যে বাড়বে তা কি বলার অপেক্ষা রাখে! মনমোহন জমানা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঋণশোধের দায়, রাজস্ব আয়ের ৮ শতাংশে বেঁধে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেও তা মার্চ মাসের শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.২ শতাংশে।
আপনার যদি আয় কমত আর ঋণ শোধের দায় বাড়ত তা হলে কি আপনি আরও ঋণের রাস্তায় হাঁটতেন? না। কেউই চাইবে না এমন পরিস্থিতি যাতে ঘরের সোনা বন্ধক রেখেও ঋণ পাওয়া মুশকিল হয়ে ওঠে। আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারও তা চাইছে না। কোভিডের আগে থেকেই বৃদ্ধির হার পড়ছে। কোষাগার নড়বড়ে। বাড়ছে ঋণশোধের দায়। এমতাবস্থায় উপায় একটাই। আরও ঋণ না করে যা আছে তার থেকেই রাজস্ব বাড়িয়ে ঋণ শোধের অনুপাতকে ৮ শতাংশে ধরে রাখা। আর সেখানে দাঁড়িয়ে পেট্রোপণ্যকেই বাজির ঘোড়া করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। অন্য কী ভাবে কর বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানো যেত তা অন্য আলোচনা। কিন্তু এই মুহূর্তে সোজা রাস্তা এই পেট্রোপণ্যই।
তা হলে কি আলোচনাটা কর কমিয়ে পেট্রোপণ্যের দাম কমানোর থেকে আরও দক্ষ কোষাগার পরিচালনায় সরে যাওয়া উচিত নয়? তথ্য তো রাজকোষ পরিচালনায় দক্ষতার উপর প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিয়েছে। তা হলে কি এই পরিস্থিতিতে পেট্রোপণ্যে কর কমিয়ে ঋণ শোধের অনুপাতকে বাড়ানোর রাস্তায় হাঁটতে রাজি হবে কেন্দ্র? যদি হাঁটে তা হলে অবাক হতে হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Petrol price
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy