Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতা যাবে কি, ভারতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব কতটা?

দিনভর হত্যে ব্যাঙ্কের অজগর-লাইনে। মাঝরাতেও এটিএমে দৌড়। বন্ধের মুখে পাইকারি বাজার। মাথায় হাত দোকানির। খালি হাত খেটে খাওয়া মানুষের। সরকারের হুঙ্কার। বাতিল টাকার বস্তার খোঁজ।

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৪
Share: Save:

দিনভর হত্যে ব্যাঙ্কের অজগর-লাইনে। মাঝরাতেও এটিএমে দৌড়। বন্ধের মুখে পাইকারি বাজার। মাথায় হাত দোকানির। খালি হাত খেটে খাওয়া মানুষের। সরকারের হুঙ্কার। বাতিল টাকার বস্তার খোঁজ। টাকা তুলতে গিয়ে মৃত্যু। আত্মহত্যা, উৎকণ্ঠা, প্রশ্ন আর চায়ের ঠেক থেকে ফেসবুক— সর্বত্র তরজা। পাঁচশো ও হাজারের নোট বাতিলের পরে এ ভাবেই কাটল দশটি দিন। কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতা যাবে কি না, উত্তর দেবে সময়। আপাতত অর্থনীতিতে তার প্রভাব খুঁজলেন অমিতাভ গুপ্ত

কালো টাকা কমবে?

২০০৭ সালে বিশ্বব্যাঙ্ক হিসেব দিয়েছিল, ভারতে ‘কালো অর্থনীতি’র আয়তন দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৩.২%। ধরে নেওয়া যায়, গত দশ বছরে সেই অনুপাত মোটামুটি একই আছে, হয়তো বা একটু বেড়ে ২৫% হয়েছে। ২০১৫-’১৬ সালে ভারতের জিডিপি প্রায় ১৫০ লক্ষ কোটি টাকা। ‘কালো অর্থনীতি’র আয়তন অতএব ৩৭.৫ লক্ষ কোটি টাকা। আয়কর দফতরের হিসেব অনুযায়ী, এই টাকার ৯০ শতাংশই দেশের বাইরে। জমি-বাড়ি ও সোনার মতো সম্পদের বাইরে নগদে রয়েছে মাত্র ৩ থেকে ৫ শতাংশ কালো টাকা। মানে, ১ লক্ষ ১২ হাজার কোটি থেকে ১ লক্ষ ৮৭ হাজার কোটি। খুব বেশি হলে এই পরিমাণ টাকাই আর ব্যাঙ্কে ফেরার কথা নয়। অর্থাৎ, নোট বাতিলের জেরে এত ভোগান্তির পরেও ‘লাভ’ ২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি নয়। সকলকে ব্যাঙ্কের চৌহদ্দিতে এনে ফেলা বা রাজস্ব বৃদ্ধি, তার মাপ অবশ্য এখনই করা শক্ত।

মুকুট ফের চিনের?

চিনকে পিছনে ফেলে দ্রুততম বৃদ্ধির দেশ হওয়া নিয়ে প্রায়ই ডঙ্কা বাজায় মোদী সরকার। কিন্তু বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রাথমিক ভাবে অনুমান, নোট বাতিলের কারণে বৃদ্ধির হার জোর ধাক্কা খাবে অন্তত দু’টি ত্রৈমাসিকে। আর্থিক বছরের শেষে ৭.৩ শতাংশ থেকে তা নেমে যেতে পারে ৫.৮ শতাংশের আশেপাশে। অর্থাৎ, ফের দৌড়ে টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাবে পড়শি মুলুক।

আবার আর একটি হিসেব বলছে, জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে ০.৭% থেকে এক শতাংশ পর্যন্ত।

কার গায়ে কত ধাক্কা?

সমস্যার পুরো ছবিটা এখনই আঁচ করা মুশকিল। কিন্তু স্পষ্টতই বেশি ধাক্কা লাগছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে। যেখানে কারবার চলে মূলত নগদে। ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, ই-ওয়ালেট, নেট-ব্যাঙ্কিং ব্যবহার করা চাকরিজীবীদের সমস্যা তুলনায় কম।

নগদে ব্যবসা করেন যাঁরা, তাঁরা সমস্যায় পড়েছেন। সবচেয়ে বেশি সমস্যা দৈনিক বা সাপ্তাহিক মজুরিতে খেটে খাওয়া মানুষের। অনেকেরই কাজ জুটছে না। সমস্যায় উচ্চবিত্ত পেশাজীবীরাও। চিকিৎসক, সফল গৃহশিক্ষক বা আইনজীবীরা, যাঁদের আয় মূলত নগদে, এখন বেশ মুশকিলে। অনেক চিকিৎসকের চেম্বার বন্ধ। ফলে বিপদে পড়ছেন রোগীরাও।

অসংগঠিত ক্ষেত্রের ধাক্কার প্রভাব ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে সংগঠিত ক্ষেত্রেও। প্রথমেই ধাক্কা জোরদার হতে পারে আবাসন ও নির্মাণ শিল্প, ইস্পাত, কয়লা, বিদ্যুৎ ইত্যাদির উপরে।

খাবারের দাম

সারা দেশেই তরি-তরকারি, মাছ-মাংস কেনায় ভাটা পড়েছে। হিসেব বলছে, ২০% অবধি দাম কমেছে খাদ্যপণ্যের। স্বল্পমেয়াদে এটা খারাপ খবর নয়। কিন্তু, খুচরো বাজারে চাহিদা কম থাকার প্রভাব পড়ছে পাইকারি বাজারেও। তার ফলে আবার কৃষকদের থেকে পণ্য কেনা কমিয়ে দিচ্ছে তারা। বেশিরভাগ খাদ্যপণ্যই অল্প দিনে পচে যায়। ফলে, কৃষিপণ্য নষ্ট হচ্ছে প্রায় সর্বত্র। নগদের অভাবে বীজ-সার কেনা কঠিন হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে খেতমজুরদের টাকা মেটাতেও। ফলে এ বার কৃষি উৎপাদন মার খাওয়ার সম্ভাবনা। সে ক্ষেত্রে ক’মাসের মধ্যে খাবারের দাম ফের লাফিয়ে বাড়তে পারে। এমনকী, সেই আশঙ্কা দেখা দিলে মজুতদারির নিয়মে দাম বাড়া শুরু হতে পারে আগেই।

টাকার অভাব চাষে

কৃষিতে আর একটা সমস্যাও আছে। চাষের কাজ একেবারেই নগদ টাকার কারবার। এই সময়টাও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এখনই খারিফ শস্য কাটা হয়, আর কিছু দিনের মধ্যেই রবি শস্যের বীজ বোনা হয়। অর্থাৎ ফসল বোনা ও কাটা, দু’য়ের জন্যই নগদ টাকা প্রয়োজন। তার একটা ব্যবস্থা সরকার করেছে। কেন্দ্রীয় অর্থসচিব বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, কৃষিঋণের টাকা বা এপিএমসি মান্ডি থেকে আসা টাকা তোলার ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক ঊর্ধ্বসীমা হচ্ছে ২৫,০০০ টাকা। কয়েকটি ক্ষেত্রে আরও ২৫ হাজার মিলিয়ে চাষিরা মোট তুলতে পারবেন ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু প্রশ্ন হল, ভারতীয় কৃষির কত শতাংশ এই টাকায় চলে, আর কত শতাংশ জোগান মহাজনরা? মহাজনের থেকে ধার পাওয়া এখন মুশকিল। কারণ, তাঁদের হাতেও নগদ নেই। টাকার অভাবে কৃষিতে কী প্রভাব পড়বে, আর তার ফলে খাবারের দাম কতখানি বাড়বে, এখনও স্পষ্ট নয়।

ধাক্কা অর্থনীতিতে

শহরে যতই টাকা উড়ুক, ভারতীয় অর্থনীতির নাড়ির গতি এখনও নির্ভর করে গ্রামের ওপর। আর গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত নগদনির্ভর। কৃষিতে ধাক্কা লাগলে, গ্রামে চাহিদা কমবে। স্বল্প মেয়াদে ব্যবহারের ভোগ্যপণ্যের (এফএমসিজি) ব্যবসা ইতিমধ্যেই ধাক্কা খেতে আরম্ভ করেছে। বাজারে চাহিদা বেশি দিন তলানিতে থাকলে, উৎপাদনও কমবে। এর প্রভাব পড়বে জাতীয় আয়ের অঙ্কে। সেই চিনের থেকে পিছিয়ে পড়ার গল্প।

দেশ জুড়েই ধাক্কা খেয়েছে গাড়ি, মোটরসাইকেল, ব্র্যান্ডেড জামাকাপড়় ইত্যাদির ব্যবসা। তবে তা সম্ভবত সাময়িক। মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছে সোনা ও গয়নার বাজার।

সবচেয়ে বড় বিপদ হল, বাজার আরও খারাপ হবে, এই আশঙ্কায় আগে থেকেই বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন কমতে আরম্ভ করতে পারে। বাজারে টাকার জোগান স্বাভাবিক হওয়ার পরেও উৎপাদন পুরনো স্তরে ফিরে আসতে অনেকটা সময় লাগার সম্ভাবনা।

সঞ্চয়ের কী হবে?

ইতিমধ্যেই অনেকগুলি ব্যাঙ্ক মেয়াদি আমানতে (ফিক্সড ডিপোজিট) সুদ কমিয়েছে। এটাও টাকা বাতিলের ফল।

ব্যাঙ্ক থেকে প্রতিদিন অতি সামান্য টাকা তোলা যাচ্ছে। উল্টো দিকে, জমা পড়ছে প্রচুর। ফলে এখন ব্যাঙ্কের হাতে প্রচুর নগদ। সেই টাকা ধার দিয়ে বাজারে খাটাতে পারলেই লাভ। অন্য দিকে, যে হেতু লগ্নিকারীরা বাজারের অনিশ্চয়তায় ভয় পাচ্ছেন, তাঁদের উৎসাহ দিতে ঋণের ওপর সুদের হারও কমানো জরুরি। তাই ঋণ এবং আমানত দু’য়েই সুদ এখন নিম্নমুখী থাকার সম্ভাবনা।

ব্যাঙ্কে সঞ্চিত টাকার সুদ কমলে, হয়তো পিএফ আর পিপিএফের সুদও কমবে। আবার শেয়ারে টাকা ঢাললেও নিশ্চিত লাভের ভরসা নেই। ৮ নভেম্বর নোট বাতিলের ঘোষণার পর ৯ তারিখ থেকে ১৮ তারিখ অবধি সেনসেক্স পড়েছে প্রায় দেড় হাজার পয়েন্ট।

ফ্ল্যাট সস্তা হবে?

সম্ভবত। বাড়ির বাজারে কালো টাকার মহিমা মারাত্মক। তার জেরে চাহিদা কমেছে সিমেন্ট, লোহার মতো কাঁচামালের। কালো টাকায় টান পড়ায় ফ্ল্যাটের বাজারে চাহিদাও তলানিতে। অতএব, দামও কমার কথা।

আর পরিষেবা?

বেড়াতে যাওয়া থেকে দামি রেস্তোরাঁ— সব ব্যবসাতেই নগদের টান পড়েছে আপাতত। টাকার জোগান স্বাভাবিক হওয়ার পরেও যদি বাজার চাঙ্গা না হয়, তবে এই ক্ষেত্রে প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। তবে, ব্যাঙ্কের ব্যবসা বাড়ছে। ই-ওয়ালেটের ব্যবসারও রমরমা প্রায় নিশ্চিত।

চাকরির বাজারে মেঘ?

অসংগঠিত ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে অনেকে কর্মহীন। নগদের জোগান বাড়লে, সেই সমস্যা মিটবে। সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানে এখনও প্রভাব পড়েনি। অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি যদি না হয়, তবে কর্মসংস্থান নিয়েও দুশ্চিন্তার বড় কারণ নেই। কিন্তু, বৃদ্ধির হারে বড়় ধাক্কা লাগলে ফল কী হবে, তা আঁচ করা মুশকিল।

মরবে দুর্নীতির অসুর?

যার জন্য এত কাণ্ড, সেই দুর্নীতির গায়ে আঁচ কতখানি? এবং কতটাই বা স্থায়ী হবে? এখনই বোঝা অসম্ভব। তবে বড় নোট বাতিল হওয়ায় ও ভয়ের আবহ তৈরি হওয়ায়, অন্তত কিছু দিন টাকায় ঘুষ চাওয়ার প্রবণতা কম থাকবে বলেই অনুমান। তবে নোট এড়িয়ে দুর্নীতি নতুন পথ খুঁজে নেবে কি না, তার উত্তর দেবে সময়ই।

অন্য বিষয়গুলি:

demonetization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy