‘উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি শুধু একগুচ্ছ চাবি
ছোট বড় মোটা বেঁটে
নানা রকমের নানা ধরনের চাবি
...যেখানেই যাই সামনে দেখি প্রকাণ্ড এক দরজা’।
আজকের নিবন্ধ লিখতে বসে ছোটবেলায় পড়া সলিল চৌধুরীর এই কবিতাটা মনে পড়ে গেল। কবি উত্তরাধিকার সূত্রে একগুচ্ছ চাবি পেয়েছিলেন। মা তাঁকে পরামর্শ দিচ্ছেন, তিনিও যেন মেয়ের হাতে ওই চাবির গোছা দিয়ে যান।
কবিতার অর্থ আলাদা। কবি বলেছিলেন সত্যের চাবির কথা। কিন্তু আমাদেরও তো উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া চাবির গোছা হাতেই কঠিন পথ পার হতে হয়। খুলতে হয় বড় বড় দরজা। আর সেই সমস্ত চাবিরই অন্যতম হল বিষয় সম্পত্তি এবং প্রয়োজনীয় নথি। কী কী সেগুলি? কী ভাবেই বা জোগাড় করবেন? তা নিয়েই কয়েকটি কথা আজ বলব।
ডেথ সার্টিফিকেট
নিকটতম অভিভাবকদের মৃত্যুর ধাক্কা সামলে যে সমস্ত পদক্ষেপ করতে হয়, সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই ডেথ সার্টিফিকেট হাতে পাওয়া। কারণ, মৃতের যে কোনও ধরনের সম্পত্তি দাবি করতে গেলে এটি অবশ্য প্রয়োজনীয়। পুরসভা, পুরনিগম কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সৎকার শংসাপত্র জমা দিলে হাতে পাওয়া যায় ডেথ সার্টিফিকেট। সম্পদ সংক্রান্ত যে যে প্রয়োজনে তা জমা দিতে হয় তা হল:
• মৃতের ব্যাঙ্ক বা যে কোনও আর্থিক প্রকল্পের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা।
• সম্পদ অথবা বিনিয়োগ প্রকল্পের হাতবদল।
• সম্পত্তি বা আর্থিক তহবিলের অধিকার দাবি।
• মৃতের সম্পত্তি বিক্রি করা।
মনে রাখতে হবে, একটি নয়, ডেথ সার্টিফিকেটের বেশ কয়েকটি আসল (অরিজিনাল) কপি নিয়ে রাখতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী ভবিষ্যতেও স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে তা জোগাড় করা যায়। কারণ, সম্পত্তি হাতবদলের কয়েকটি ক্ষেত্রে আসল কপি জমা দিতে হয়। যেমন, সম্পত্তির মিউটেশনের হাতবদল। সেই সঙ্গে অনেকগুলি ফটোকপি তো অবশ্যই করাতে হবে। সার্টিফিকেটে সমস্ত তথ্য ঠিক লেখা রয়েছে কি না, তা ভাল করে দেখে নিতে হবে। না হলে কিন্তু ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে।
সাকসেশন সার্টিফিকেট
দ্বিতীয় পদক্ষেপ। যদি মৃতের উইল থেকে থাকে, তা খুঁজে বার করা। উইলের বিকল্প নেই। তা থাকলে যে কোনও ধরনের সম্পত্তির হস্তান্তর সহজতর হয়। আর সেই উইল রেজিস্ট্রি করানো থাকলে বিতর্কের আশঙ্কাও কমে। কোন সম্পত্তি, কাদের মধ্যে, কত ভাগে, কার তত্ত্বাবধানে ভাগ হবে তা স্পষ্ট ভাবে লেখা থাকে উইলে।
কিন্তু প্রয়াত ব্যক্তির যদি উইল না-থাকে? তা হলেও দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটে। তখন জোগাড় করতে হয় সাকসেশন সার্টিফিকেট। অস্থাবর সম্পত্তির অধিকার দাবির ক্ষেত্রে যা প্রয়োজন হয়। এটি জোগাড় করতে হয় জেলা আদালত থেকে। অস্থাবর সম্পত্তির যদি উইল কিংবা নমিনি কোনওটাই না-থাকে, অথবা উইল না-রেখে মা-বাবা দু’জনেই প্রয়াত হন, তা হলে সাকসেশন সার্টিফিকেট অবশ্যই প্রয়োজন।
বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি-সহ স্থাবর সম্পত্তির নিয়ম অবশ্য আলাদা। সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আইন (ইন্ডিয়ান সাকসেশন অ্যাক্ট, হিন্দু সাকসেশন অ্যাক্ট বা মুসলিম পার্সোনাল ল’) অনুযায়ী উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তা ভাগ হয়। যদি ছেলেমেয়েরা সেই সম্পত্তির অধিকার না-চান এবং মা কিংবা বাবার (যিনি জীবিত) হাতে তা রাখতে চান, তা হলে লিখিত ভাবে তা জানাতে হবে।
আর্থিক নথি
জানি কঠিন কাজ। মানসিক ভাবে যন্ত্রণাদায়কও। কিন্তু না-করে উপায় কী? ডেথ সার্টিফিকেট এবং সাকসেশন সার্টিফিকেটের প্রক্রিয়া চলাকালীনই খুঁজে বার করতে হবে মা-বাবার যাবতীয় আর্থিক নথি। কেউ কেউ এই সমস্ত বৈষয়িক কাজে সারাটা জীবন যত্নশীল থাকেন। সমস্ত রকম নথিপত্র গোছানো থাকে নির্দিষ্ট জায়গায়। তাঁদের ক্ষেত্রে সমস্যা হয় না। হাতের কাছেই পাওয়া যায় যাবতীয় নথি। সে লগ্নি তহবিলেরই হোক, বিভিন্ন ধরনের করেরই হোক অথবা হোক ঋণের। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই তো তা হয় না! তাই ধৈর্য ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজে বার করতে হয় ওই সমস্ত কাগজপত্র।
আরও একটি নথি গুরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ কর্মরত অবস্থায় মারা যান, তা হলে সবচেয়ে আগে জরুরি তাঁর কর্মস্থল সংক্রান্ত কাগজপত্র খুঁজে বার করা। অনেকের ক্ষেত্রে সেগুলি খুঁজে না-পাওয়ার জন্যই দীর্ঘদিন দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিমা ও অন্যান্য পাওনা বুঝে নিতে সময় লাগে। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্যের মৃত্যু হলে কিন্তু এই নথিগুলিই অন্যতম অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জোগাড় করতে হবে।
খরচ ও দেনা
সংসারের খরচ কিংবা দেনা। সব কিছুর দায়িত্ব এক দিন হঠাৎই এসে পড়ে উত্তরসূরির কাঁধে। আপনি যত বড় সমস্যাতেই পড়ুন না কেন, ঋণের কিস্তি তো ব্যাঙ্কের দরজায় ধাক্কা দেবে মাসের নির্দিষ্ট দিনেই। টানতে হবে সংসারের খরচও। সময় মতো মেটাতে হবে বিভিন্ন বিল। তাই তৈরি করে ফেলতে হবে খরচ ও দেনার একটি তালিকা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ঋণ কিংবা আর্থিক প্রকল্পের (এসআইপি, রেকারিং প্রভৃতি) কিস্তি ইসিএসের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকেই কেটে নেওয়া হয়। এতে যেমন এক দিকে ঝক্কি কম, তেমনই অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট টাকা থাকাটাও নিশ্চিত করতে হয়।
যখন প্রথম বার সংসার খরচের দায়িত্ব কাঁধে আসে তখন অনেক খরচের কথাই মাথায় থাকে না। তাই রোজের খরচ বাদ দিয়েও অন্যান্য খরচের একটি তালিকা তৈরি করতে হবে আগেই। (দেখে নিন সারণিতে) এই তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। রোজের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই তা করতে হবে। ব্যাঙ্কে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট থাকলে সেখান থেকে টাকা তুলতে সমস্যা হয় না। তাই ব্যতিক্রম ছাড়া জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করার কথাই বলেন আর্থিক পরামর্শদাতারা। আর একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে ঋণের কিস্তির ক্ষেত্রে। ঠিক সময়ে তা মেটানো না হলে কিন্তু সুদ ও জরিমানা বাবদ খরচ চড়তে থাকবে।
ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান
সমস্ত আর্থিক নথি খুঁজে বার করার পরবর্তী বড় কাজ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে গ্রাহকের মৃত্যুর কথা জানানো। ডেথ সার্টিফিকেট জমা দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, বিমা সংস্থা, লগ্নি সংস্থা, কর বিভাগ, ঋণদাতা (ব্যাঙ্ক বা ক্রেডিট কার্ড সংস্থা)। এর মধ্যে কোনও ক্ষেত্রে আর্থিক তহবিল আপনার হাতে আসবে, কোনও ক্ষেত্রে আবার ঋণের দায়িত্বও নিতে হবে আপনাকে। কখনও সিঙ্গল অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে হতে পারে, আবার বদলাতে হতে পারে গ্রাহকের নাম। ইপিএফ এবং পেনশন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বেশি দেরি করবেন না যেন।
আয় ও লগ্নি
পরিবারের কোনও সদস্যের মৃত্যুর পর এই দুই আর্থিক শর্তে বড় রকম বদল ঘটে। তাই পূর্বসূরির সমস্ত আর্থিক নথি হাতে এলে সেগুলিকে গুছিয়ে ফেলুন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারণ, সংসারের দায়িত্ব আপনার কাঁধে আসার পরে নিজের সামর্থ অনুযায়ী খরচ এবং লগ্নিকে সাজাতে হবে।
করের রিটার্ন
এই বিষয়টি অনেক সময়ে চোখ এড়িয়ে যায়। পরিবারের রোজগেরে সদস্যের মৃত্যু হলেও সংশ্লিষ্ট অর্থবর্ষে যত দিন তিনি জীবিত ছিলেন, তত দিনের আয়কর রিটার্ন দাখিল করার কথা। উত্তরসূরি হিসেবে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে আপনাকে। ফলে আর্থিক নথির খোঁজ যখন করবেন, তখন অন্যান্য বছরগুলির রিটার্নের নথিরও খোঁজ করুন। তাতে রিটার্নের ফর্ম পূরণ করতে সুবিধা হবে। এ ব্যাপারে আর্থিক পরামর্শদাতারও পরামর্শও নিতে পারেন।
আর্থিক বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত না-হলেও আরও একটি ব্যাপার নিশ্চিত করা দরকার। তা হল কোনও সোশ্যাল মিডিয়ায় যেন মৃতের উপস্থিতি না থাকে। সেই অ্যাকাউন্টগুলি বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে সেগুলির অপব্যবহার হতে পারে। বন্ধ করতে হবে ইমেল-সহ সমস্ত রকম অনলাইন উপস্থিতি। কেটে ফেলতে হবে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড। এমনকি, যে সমস্ত কাগুজে নথি আর কাজে লাগবে না সেগুলিও। তবে যদি মনে করেন সেই নথিগুলি ভবিষ্যতে কাজে লাগতেও পারে, তা হলে গুছিয়ে আলমারির নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিতে হবে।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত )
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy