Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

চাঁদ থেকে মাটিতে ফিরুক সরকার, রুজি যেন না-হারায়, আর্জি অর্থনীতিবিদদের

কিন্তু চাঁদের মাটিতে যন্ত্রের চাকা গড়ানোর আগে সকলের খাওয়া-পড়ার ব্যবস্থা করা জরুরি নয় কি?

উদ্বেগ: মানেসরে মারুতি কারখানার সামনে অপেক্ষারত কর্মীরা। রয়টার্স

উদ্বেগ: মানেসরে মারুতি কারখানার সামনে অপেক্ষারত কর্মীরা। রয়টার্স

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:৩৭
Share: Save:

দেশীয় প্রযুক্তির ডানায় ভর করে চাঁদ প্রায় ছুঁয়ে ফেলা অবশ্যই কৃতিত্বের। মন ছুঁয়ে যাওয়া দৃশ্য ইসরোর ভেঙে পড়া চেয়ারম্যানকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে টেনে নেওয়াও। কিন্তু অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে কাজ হারানোর ভয়ে কাঁটা কর্মীদের অনেকেই বলছেন, অন্তত এখনকার মতো চাঁদ ভুলে রুজি-রুটিতে মন দিক কেন্দ্র। পাখির চোখ করুক অর্থনীতির হাল ফেরানোকে। হালে যার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ায় কাজ খোয়াচ্ছেন অনেকে।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটকের কথায়, ‘‘শুধু শেষ প্রকাশিত বৃদ্ধির হারে (৫%) নয়, অর্থনীতির হোঁচট খাওয়ার বিবর্ণ ছবি ফুটে উঠেছে সব ক্ষেত্রেই। গাড়ি বিক্রি তলানিতে ঠেকার কথা মুখে মুখে ফিরছে ঠিকই। কিন্তু চাহিদায় ভাটা বিস্কুটের মতো তুলনায় অনেক কম দামের পণ্যেও।’’ এই অবস্থায় সবার আগে অর্থনীতির হাল ফেরানোই কেন্দ্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

আইএসআই-কলকাতার অর্থনীতির অধ্যাপক অভিরূপ সরকারের প্রশ্ন, ‘‘বিজ্ঞান, গবেষণায় সরকারি উৎসাহ অবশ্যই স্বাগত। কিন্তু চাঁদের মাটিতে যন্ত্রের চাকা গড়ানোর আগে সকলের খাওয়া-পড়ার ব্যবস্থা করা জরুরি নয় কি? ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির মতো বহু দেশ তো বিজ্ঞানে উন্নত। তা হলে তারা চাঁদের দিকে হাত বাড়ায়নি কেন?’’ যেখানে অর্থনীতির সামনে মন্দার কোলে ঢলে পড়ার চোখরাঙানি, কাজ খোয়াচ্ছেন বহু মানুষ, সেখানে আগে তাতে নজর না দিয়ে দেশের নজর চাঁদে নিবদ্ধ করার চেষ্টা তাঁর মতে ‘দেখানেপনাই’।

আইআইএম-কলকাতার অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক অনুপ কুমার সিন্‌হার মতেও, ‘‘চাহিদা তলানিতে। অর্থনীতি ধুঁকছে। সঙ্কটে আমজনতার রুজি-রুটি। অথচ কেন্দ্রের ভাবখানা এমন যেন, এতে নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। নিজে থেকে সঙ্কট মেটাবে বাজারই।’’ শিল্প থেকে শুরু করে কারখানার কর্মী— সকলের সমস্যার এই সময়ে অর্থনীতির মেরামতি কেন্দ্রের অগ্রাধিকারের তালিকায় শীর্ষে থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনিও।

নাম প্রকাশে নারাজ এক শিল্প কর্তার টিপ্পনি, চাঁদের বুকে রোভারের চাকা না-গড়ানোয় এত হা-হুতাশ। অথচ দেশে মুখ থুবড়ে পড়েছে আস্ত গাড়ি শিল্পই। ক্ষত কতটা গভীর, তা স্পষ্ট কর্মী ইউনিয়নগুলির নেতাদের কথায় কান পাতলে। এআইটিইউসি-র ডেপুটি জেনারেল সেক্রেটারি অনিল পানোয়ার বলছেন, ‘‘শুধু গুরুগ্রামে এক চক্কর ঘুরে আসুন। ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন গাড়ি শিল্পের অন্তত ৫০,০০০ কর্মী। প্রতি দিন সেখানে কাজ যাচ্ছে অনেকের। একেবারে হালে যেমন এক যন্ত্রাংশ কারখানায় কাজ গিয়েছে ১২-১৮ বছরের পুরনো ৩০০ কর্মীর। উৎপাদন বন্ধ রাখছে মারুতির মতো সংস্থা। ফলে কাজ নেই ঠিকা কর্মীদেরও। অথচ সরকার সমস্যার কথা মানতেই রাজি নয়! চাঁদ দেখে তো আর পেট ভরে না।’’

আইএফটিইউ-র দিল্লি শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট মৃগাঙ্ক প্রকাশেরও অভিযোগ, ‘‘ঠিকা শ্রমিকদের কথা তো ছেড়েই দিন। কাজ যাচ্ছে স্থায়ী কর্মীদেরও। কারখানা থেকে শুরু করে তার সামনের চায়ের দোকান— বিক্রি তলানিতে সকলের। কিন্তু সে দিকে না তাকিয়ে কেন্দ্র কি না কাশ্মীর আর চাঁদে মজে! এ আসলে মূল সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর কৌশল।’’

কিন্তু পাঁচ বছরে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হয়ে ওঠার স্বপ্নের কথা তো প্রায় রোজ বলছেন নরেন্দ্র মোদী। বলছেন তার জন্য পাঁচ বছরে পরিকাঠামোয় ১০০ লক্ষ কোটি টাকা ঢালার কথা। ব্যাঙ্কিং ও বিভিন্ন শিল্পের সমস্যা বুঝতে দফায় দফায় তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। গাড়ি-সহ শিল্পকে চাঙ্গা করতে হয়েছে একগুচ্ছ ঘোষণাও। ভাবা হচ্ছে গাড়িতে জিএসটি কমানোর কথা।

তা হলে?

মৈত্রীশের মতে, গাড়িতে জিএসটি কমানো কিংবা ওই শিল্পকে সামান্য ভর্তুকি অনেকটা মারাত্মক ভাবে জখম কাউকে ব্যান্ড-এড লাগানোর মতো। আসল সমস্যা চাকরি যাওয়া ও আয় কমায় চাহিদায় টান। তার উপরে ‘কর-সন্ত্রাস’ আর নিত্যনতুন নিয়মের জটিলতায় সিঁটিয়ে রয়েছে শিল্প। তাই সবার আগে চাহিদাকে চাঙ্গা করতে পরিকাঠামোয় লগ্নি বাড়ানোর পক্ষপাতী তিনি। একই সঙ্গে পরামর্শ, কর ও নানা নিয়ন্ত্রণের চোখরাঙানি থেকে বেরিয়ে লগ্নিবান্ধব পরিবেশ তৈরির। অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করাতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করাচ্ছেন অন্য অর্থনীতিবিদদের বড় অংশও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy