করোনার ধাক্কা বাজারেও।
বাজার খুলতে শুরু করেছে। লোকজনও গুটিগুটি কাজে যেতে শুরু করেছেন। কলকারখানা খুলছে। অনেকেই মনে করছেন, আগামী তিন মাসে আর্থিক সংকোচনের হার কমবে। ১২ শতাংশের মতো। পরের ত্রৈমাসিকে আরও।
যা হয়। এ বার এ নিয়েও শুরু হয়েছে রাজনৈতিক আকচা আকচি। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিকই। একদম বন্ধ ছিল দেশ। তারপর বাজার খুললে তো আয় বাড়বেই। প্রশ্ন বাজারের চাকা ঘুরলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? ঘরে ঘরে লক্ষ্মীলাভ হবে?
এই প্রশ্নের উত্তরের আগে দেখে নেওয়া যাক, বাজারের চল ও বৃদ্ধি বলতে কী বুঝি। সহজ করে বলার কিছু সমস্যা আছে তা মেনে নিয়েই এগনো যাক। কারখানা চালু হলে উৎপাদন হবে। আর উৎপাদন হলে তা বিক্রি করার চেষ্টা হবে। বাজারে তা বিক্রি হলে, কারখানার মালিকের আয় হবে। আর তা দিয়ে কর্মীদের মাইনে হবে, কাঁচা মালের দাম মিটবে। এই অঙ্কটা তো নেহাত বাচ্চাও বোঝে। এ বার বাজারে দোকান থেকে শুরু করে কৃষি মিলিয়ে সব ক্ষেত্রে যা বিক্রিবাটা হবে, তা যোগ করলে গোটা অর্থনীতির কর্মকাণ্ডের যে হিসাব পাওয়া যায়, সহজ করে বললে তাকেই আমরা জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) বলি। এ বার বিভিন্ন সময়ের জাতীয় উৎপাদনের তুলনা করে আমরা একটা বৃদ্ধির অঙ্ক পাই, সেই অঙ্ককেই আমরা বৃদ্ধির হার বলি।
বাজার খুললেও ক্রেতার ভিড় কম।
আরও পড়ুন: শেষ গম্বুজটাও ভেঙে পড়তে দেখলাম ৪টে ৪৯ মিনিটে
বৃদ্ধির হার বাড়লে আমরা বললি দেশের বাজার বাড়ছে। কমলে মাথায় হাত। কারণ, কমা মানেই তো কারখানা, দোকান হাট ইত্যাদিতে বিক্রিবাটা কমা। আর তা কমলেই চাকরি যাওয়া, বাজারে চাহিদা কমা আর তাতে আরও ব্যবসায় ঝাঁপ পড়ার সম্ভাবনা বাড়া। এই কারণেই, বৃদ্ধির হার কমলে সবাই এত চিন্তিত হয়ে কারণ খুঁজতে শুরু করে।
যেমন, এই কোভিডের সময় আমরা দেখছি। গত ছয় বছর ধরেই দেশে বৃদ্ধির হার পড়ছে। কিন্তু লকডাউনে কৃষি ছাড়া সব কিছুই বন্ধ ছিল। তাই এপ্রিল থেকে জুন মাস, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে আগের বছরের ত্রৈমাসিকের তুলনায় আর্থিক সংকোচন হয়েছে (-)২২.৬ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরে এই সময়ে দেশে যা কাজ হয়েছে তার তুলনায় ২২.৬ শতাংশ কাজ কম হয়েছে এই ত্রৈমাসিকে।
এ সব আমরা ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছি। এখন বাজার খুলছে। একটু একটু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন শুরু হচ্ছে। এমনকি, রেস্তরাঁতে আমরা যেতে শুরু করেছি। রাস্তায় ভিড়, ট্রাফিক জ্যাম শুরু হয়েছে আর কোভিডও বাড়তে শুরু করেছে। এখন বিভিন্ন মহলের ধারণা, চলতি ত্রৈমাসিকে সংকোচনের হার কমে ১২ শতাংশে দাঁড়াবে। এটাও স্বাভাবিক। কাজকর্ম শুরু হলে রোজগার বাড়বে। বাজারে চাহিদাও তৈরি হবে, আরও কারখানার ঝাঁপ খুলবে। প্রথম তিন মাসের তুলনায় তাই বাজারে আরও চাহিদা বাড়বে এবং দেশের আয়ও বাড়বে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, নয় নয় করে যদি বাজার ঘুরে দাঁড়ায় তাতে তো কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বরং খুশিই হওয়া উচিত। নিশ্চয়ই। তাই এ বার ‘কিন্তু’র জায়গাটা একটু দেখে নেওয়া যাক। কারখানার মালিক উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করার জন্য। বাজারে চাহিদা কমতে থাকলে কারখানার উৎপাদনও কমতে থাকবে। আমাদের দেশের জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ১৮.৩ শতাংশ আসে উৎপাদন শিল্প থেকে আর দেশের মোট চাকরির ১২ শতাংশের জোগানদারই হল উৎপাদন শিল্প।
লকডাউনের জের কাটেনি এখনও।
আরও পড়ুন: অবশেষে কাল বাবরি ধ্বংস মামলার রায়, চার নজরে ২৮ বছর
গত পাঁচ বছর ধরে যেমন জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হার পড়ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়ছে উৎপাদন শিল্পের বৃদ্ধির হারও। আর এর পিছনে রয়েছে কিন্তু বাজারে চাহিদার পতন। কারখানার মালিক উৎপাদন করে চলতি চাহিদা মেপে। আর তার সঙ্গে যোগ হয় আগামী দিনে বাজারে চাহিদা কী রকম বাড়বে তা নিয়ে তাঁর আশা। এ বার উৎপাদনের পরে বাজারে সেই জিনিস না কাটে তাহলে গুদামে পচবে। একই সঙ্গে বাজারের চাহিদা নিয়ে কারখানার মালিকের আশায়ও জল পড়বে। আর বাজারে চাহিদা নিয়ে তাঁর সংশয় বাড়তে থাকবে। কারখানার মালিক বাজার নিয়ে সংশয়ের কারণে উৎপাদন কমাবেন। তাতে শ্রমিক কাজ হারাবেন। চাকরির বাজারে সংশয় শুরু হবে। সাধারণ মানুষ আগামীর আশঙ্কায় খরচে রাশ টানবে, চাহিদা আরও কমবে, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও কমবে উৎপাদন...।
আর এইখানেই আসে সরকারের ভূমিকার কথা। আমাদের দেশে সরকারই বাজারের সব থেকে বড় ক্রেতা। মাথায় রাখতে হবে, আমাদের দেশে যা তৈরি হয় তার ৭০ শতাংশের বেশিই দেশের বাজারের চাহিদার উপরই নির্ভরশীল। আর সেই চাহিদার একটা বড় অংশই আসে সরকারের ঘর থেকে। সরকার খরচ বাড়ালে বাজারে চাহিদার পালে হাওয়া আসে।
কোভিডের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থনীতি।
সরকারও তা জানে। তাই কোভিডের কারণে মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে দাবি ছিল উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই আমাদের দেশে সরকার বাজারে আর্থিক ত্রাণে নেমে পড়ুক। এই নিয়ে আর আলোচনার মানে নেই। কারণ এই দাবির সারবত্তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের জাতীয় আয়ের যে তথ্য সরকার প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে পরিষেবা ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক খাতে সরকারের খরচ বাড়ার বদলে সংকুচিত হয়েছে। কতটা? সরকারের হিসাবই বলছে (-) ১০.৩ শতাংশ। যার মানে হল, সরকারও সাধারণ মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খরচ কমিয়েছে। এমনিতেই গুটিয়ে থাকা বাজারের পালে নতুন হাওয়া দেওয়ার বদলে নিজের দায় এড়িয়ে সেই পাল আরও গোটাতে সাহায্য করেছে!
তার মানে সরকারের দাবি আর বাস্তবের মধ্যে একটা আপাত ফারাক কিন্তু জাতীয় আয়ের হিসাবই দেখিয়ে দিচ্ছে। এর অভিঘাত কিন্তু সরাসরি ভোগ করতে হবে সাধারণ মানুষকেই। তাই সংকোচনের হার কমা নিয়ে এমন মনে করার কোনও কারণ নেই যে সুদিন আসছে। আমার আপনার ঘরে লক্ষ্মী আপাতত চঞ্চলাই থাকবেন, সরকার যা-ই দাবি করুক না কেন। কোভিডের আগে দেশের যে হাল ছিল সেখানে ফিরতে পারলেই কিন্তু অনেক হবে আপাতত। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে বাজার সেখানে ফিরবে কি না, তা নিয়ে কিন্তু জিজ্ঞাসা চিহ্নটা আরও স্পষ্টই হচ্ছে! যদি না সরকার খরচ বাড়িয়ে বাজারে চাহিদাচাঙ্গা করার চেষ্টা করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy